ফাঁসিতে ঝোলানোর পর পাটাতনটি সরে গেলো। নীচের দিকে নেমে গেলো মেজর রওশন ইয়াজদানীর শরীর। পা বাঁধা অবস্থাতেই তিনি সেখান থেকে বের হয়ে আসার শেষ চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত খুব কষ্টের মধ্যেই মৃত্যু নিশ্চিত হয় তার।
এভাবে একজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় সেই স্বাধীন দেশে যে দেশের জন্য তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান হত্যাকোণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৯৮১ সালের এদিন মেজর রওশন ইয়াজদানীসহ ১২ সামরিক কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। আহত এবং অসুস্থ থাকায় একজনের ফাঁসি হয় দুই বছর পর।
তবে রওশন ইয়াজদানীর বন্ধুদের অভিযোগ, ইয়াজদানীসহ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতরা বেশিরভাগই মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় ক্ষমতা আকাঙ্খী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি তাদের জিয়া হত্যায় জড়িয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। ওই সেনা কর্মকর্তাদের নিকটজনরা এ বিষয়ে খুব বেশি কথা না বললেও কেউ কেউ সেই ইতিহাস লিখে রেখেছেন। তাদের একজন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ৬ষ্ঠ ব্যাচের ছাত্র রওশন ইয়াজদানীর সহপাঠী সাইফুদ্দাহার শহীদ।
তার লেখাটি ইংরেজিতে হওয়ার কারণে পরে ক্যাডেট কলেজ ব্লগে ওই লেখাটির অনুবাদসহ আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন ফৌজদারহাটেরই সাবেক ছাত্র সাংবাদিক সানাউল্লাহ।
লেখাটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে সাইফুদ্দাহার শহীদ বলেছেন, ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রওশন ইয়াজদানীর বিরুদ্ধে যে অন্যায় এবং মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে এবং প্রহসনের বিচারে তাকে ফাঁসিতে হত্যা করা হয়েছে সেই ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসাই ছিলো তার উদ্দেশ্য।
ফাঁসি কার্যকর হওয়ার খবরটি তিনি যেভাবে জেনেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে: রওশন ইয়াজদানীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার খবরটি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরিফ আমাকে ফোনে নিশ্চিত করলো। ও আরো জানালো, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইয়াজদানী বাঁচার চেষ্টা করেছে, বেঁধে রাখা পা দিয়েই অন্ধকূপ বেয়ে ওঠার চেষ্টা করে সে তার মৃত্যুকে বিলম্বিত করেছে এবং কষ্ট পেয়েছে। একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে এটাই তো আশা করা যায়। নিজের বিরুদ্ধে সব অপ-তৎপরতার কথা জানা ছিল যদিও, তবুও মৃত্যুতে ইয়াজদানী লড়াই চালিয়ে গেছে।
‘আমি খুব ভালো করে জানি ভারী ওজনের একজন মানুষকে যখন ফাঁসির কাঠে ঝোলানো হয়, নিজের শরীরের ওজনেই তার ঘাড় ভেঙ্গে যায় এবং তার মৃত্যু দ্রুত ও কম যন্ত্রণার হয়। কিন্তু যার ওজন কম, এমন মানুষের ফাঁসিতে মৃত্যূ! শরীরের ভারে তো ঘাড় সহজে ভাঙ্গে না। গলায় আটকানো ফাঁসির রশিতে ভীষণ শ্বাসকষ্ট হয়, মৃত্যুযন্ত্রণা বাড়ায়। হাত-পা এমনকি মাথাটা পর্যন্ত কালো কাপড়ে বাঁধা! ফুসফুস তাজা বাতাসের জন্য তখন আকুপাকু করে! শান্তির মৃত্যু তখন ওই মানুষটার জন্য কতোটা আকাঙ্খার! আহ্, আমি আর এর বেশি কিছু ভাবতে পারি না,’ বলে বন্ধুর কষ্টে আরো নীল হয়েছেন ইয়াজদানীর বন্ধু।
বাঁচানোর অনুরোধে শেষ টেলিগ্রাম
ক্যাডেট কলেজ জীবনে ইয়াজদানীর সাহসিকতার উদাহরণ দিয়ে সাইফুদ্দাহার লিখেছেন: পরে কখনো কখনো আমি ভাবি, কেন আমরা পরের জীবনে রওশনের জীবন বাঁচাতে একই ধরণের জোরালো বন্ধুত্ব এবং সহমর্মিতা দেখাতে পারিনি? বাংলাদেশে এটা বলা হয়, যথাযথ সম্পর্ক এবং যোগাযোগটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রওশনের বেলায় এটা কেন কাজ করলো না? ক্যাডেট কলেজে রওশনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল আশরাফ। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফ তখন নিরাপত্তা গোয়েন্দার কর্তা এবং তখনকার লৌহমানব (?) এরশাদের খুব কাছের লোক। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ ছিল এরশাদের পিএস। আমিন (সিএসপি) রাষ্ট্রপতির পিএস ছিল এবং হত্যাকাণ্ডের সময় জিয়ার সঙ্গে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ছিল। আনিস (আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পরে এরশাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিল) সেই রাতে জিয়ার সঙ্গে কথা বলেছিল। সবাই ছিল রওশনের খুব ঘনিষ্ঠ এবং জানতো ও ষড়যন্ত্রকারী বা হত্যাকারী ধরণের মানুষ ছিল না। রওশন সব সময় ন্যায়ের পক্ষে থাকতো এবং এটাই ছিল ওর বিশ্বাস।
মর্মস্পর্শী লেখাটিতে বলা হয়েছে, শেষ ইচ্ছা হিসাবে জেল কর্তৃপক্ষ রওশনকে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে একটি সংক্ষিপ্ত টেলিগ্রাম পাঠানোর সুযোগ করে দিয়েছিল। এনএসআই পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফ পেয়েছিল রওশনের টেলিগ্রামটি। এতে শুধু লেখা ছিল, ‘আমাকে বাঁচাও।’
গোপন বিচারে ২৩ বছর বয়সী অফিসারসহ ১৩ জনের ফাঁসি
কিন্তু তাকে কেউ বাঁচাতে পারেননি। যেমন বাঁচানো যায়নি তখন মাত্র ২৩ বছর বয়সী লেফটেন্যান্ট রফিকুল হাসানকে। চৌত্রিশ বছর আগে এদিন তারও ফাঁসি হয়।
ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের তালিকাটা এরকম: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মহসীন উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম, কর্নেল নওয়াজিশ উদ্দীন, কর্নেল এম আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ ওয়াই এম মাহফুজুর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম দেলওয়ার হোসেন, মেজর এ জেড গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঞা, মেজর কাজী মোমিনুল হক, মেজর এম মজিবুর রহমান, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুস সাত্তার, ক্যাপ্টেন জামিল হক এবং লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ মোহাম্মদ ফজলে হোসেন ওই সময় আহত এবং অসুস্থ থাকায় তার ফাঁসি কার্যকর হয় আরো দুই বছর পর, ১৯৮৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর।
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে নিহত হওয়ার পর ১ জুন থেকে ৩ জুন জিয়া হত্যার অভিযোগে ১৮ সেনা অফিসারকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছরেরই ১০ জুলাই গোপন সামরিক আদালতে শুরু হয় তাদের বিচার। এই কোর্ট মার্শালের প্রধান ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত মেজর জেনারেল আবদুর রহমান।
২৮ জুলাই পর্যন্ত তিন সপ্তাহেরও কম সময় ধরে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গোপনে বিচার চলে। গোপন বিচারে ১৩ কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পাঁচ সেনা অফিসারের হয় বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড।
ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হয়
এই বিচার এবং ফাঁসি কার্যকর প্রসঙ্গে বিএনপিপন্থী এবং খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক শফিক রেহমান লিখেছেন: গোপনে, দ্রুতগতিতে এবং অভিযুক্তদের পক্ষ সমর্থনে ন্যায়সঙ্গত সুযোগ না দেওয়ায় এই মৃত্যুদণ্ডগুলো সমালোচিত হয়েছিল। দণ্ড কার্যকর হবার পরে নেপথ্য থেকে সামনে চলে আসেন জেনারেল এরশাদ।
‘ডিসেম্বর ১৯৮১-তে নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্রপতি হন আবদুস সাত্তার। ২৪ মার্চ ১৯৮২-তে তাকে পদচ্যুত করে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। এই ক্যু-তে সহযোগী মেজর জেনারেল আবদুর রহমানকে ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ দেন এরশাদ। সেখানে প্যারিসে ১৯৮৪-তে আবদুর রহমানের মৃত্যু হয়,’ বলে জানান শফিক রেহমান।
তিনি লিখেছেন: ঢাকায় বনানী কবরস্থানে ব্রিগেডিয়ার মহসীন উদ্দিন আহমেদের সমাধিফলকটি বিখ্যাত হয়েছে সেখানে উৎকীর্ণ নিচের পঙক্তিগুলোর জন্য:
এ দেশের মাটি একদিন কথা বলবে/ ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হয়/ আল্লাহ তোমাকে চিরশান্তি দিন।
ফিরোজা মহসীনা (স্ত্রী)/ কবিতা, কুতু ও তানিম/ ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮১
স্বপ্নের খামার থেকে যৌথ জীবনের খামার
সাইফুদ্দাহার জানাচ্ছেন, রওশন একজন আধুনিক কৃষক হতে চেয়েছিলেন।
তিনি লিখেছেন: রওশনের বাবা দত্তনগর সরকারি কৃষি পরীক্ষাগারে কাজ করতেন। সেখানকার খামারে ট্রাক্টর চালানোর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আমাদের বলতো রওশন। মেয়েদের নিয়ে ওকে কখনো তেমন একটা কথা বলতে আমি শুনিনি। সবসময় সে বলতো তার স্বপ্নের খামারের কথা। সে চাষের জন্য ট্রাক্টর, টিলার, সেচ পাম্প এবং উন্নতমানের বীজ ব্যবহার করে তার আদর্শ খামারকে অন্য কৃষকদের সামনে অনুসরণীয় করে তুলতে চেয়েছিল। অসাধারণ বাঁশি বাজাতো ও। গভীর রাতে ও যখন বাঁশিটা বের করে সুর তুলতো, আমরা তখনো ওর স্বপ্নের খামারের কথা ভাবতাম।
‘আমার মনে হয়, আমাদের মধ্যে রওশনই ছিল একমাত্র ক্যাডেট, যে কৃষক হতে চেয়েছিল। কলেজ থেকে বেরিয়ে আমাদের বন্ধুদের বেশির ভাগ যখন কাকুলের (পাকিস্তানে অবস্থিত) মিলিটারি একাডেমি, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো; রওশন তখন ময়মনসিংহে গিয়ে ভর্তি হলো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।’
তিনি জানান: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে রওশন তার স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধে যোগ দিল, সেনাবাহিনীতে কমিশন পেল। সেনাবাহিনীতে ও যোগ দিয়েছিল দেরিতে, তাই তার বন্ধুরা যখন কর্নেল বা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তখনো সে ছিল মেজর পদমর্যাদায়।
শেষ সময়েও দুর্বলের পাশে
সাইফুদ্দাহার লিখেছেন: আমি যতদূর জানতে পেরেছি, রওশন জিয়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল না। ওই রাতে (৩০ জুন, ১৯৮১) যারা চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে গিয়েছিল কিম্বা পরিকল্পনায় যারা জড়িত ছিল তাদের মধ্যে ও ছিল না।
‘যখন চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন সে ছিল জেনারেল মনজুরের স্ত্রী ও পরিবারের সঙ্গে। ও ওই পরিবারটির জন্য একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজছিল। ততক্ষণে মনজুরকে হত্যা করা হয়েছে। আবারো সেই রওশন- যে অসহায়, দুর্বলের পাশে তাদের সাহায্যের জন্য ছিল।
তিনি লিখেছেন: যখন অন্যরা মনজুরকে ছেড়ে এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে, রওশন তখন পরিত্যক্ত জেনারেলের পরিবারকে রক্ষার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
পূর্ণিমা রাতের বাঁশির সুরের উল্টোপিঠেই ফাঁসির রশিতে ঝুলন্ত বন্ধুর মুখ
কলেজের দিনগুলোর পর সাইফুদ্দাহারের সঙ্গে রওশনের আর দেখা হয়নি। ‘একবার আমি ময়মনসিংহে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে সে তখন সেখানে ছিল না।’
তিনি তার লেখাটি শেষ করেছেন এভাবে: আমি এখনো রওশনের একটা স্মৃতি বয়ে বেড়াই। যে স্বপ্নের সাম্রাজ্যটা ওর কখনো বাস্তবে রূপ নেয়নি, একটা আদিগন্ত ধানের ক্ষেতে পূর্ণিমা রাতে দাঁড়িয়ে ও বাঁশি বাজাচ্ছে। কিন্তু এক সময় এই সুখের চিত্রটি মুছে গিয়ে স্মৃতিতে ভেসে উঠে ফাঁসির রশির প্রান্তে অসহায়ভাবে ঝুলন্ত আমার প্রিয় বন্ধুর মুখ। নিরবে নিজের চোখের পানিটুকু মোছা ছাড়া ওই সময় আমি আর কিছুই করতে পারি না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের
নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে
প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)