একটু বাতাসের জন্য ছটফট করছে ফুসফুস। শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রতিমুহূর্তে যে বাতাস দেহের ভেতরে ঢুকছে আর বের হচ্ছে, যার জন্য কোনো দাম বা কর দিতে হয় না মানুষকে। কিন্তু সেই বাতাসই যেন এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী বস্তু। বদ্ধ পাটাতনের ফাঁক গলে একটু দম নেয়ার জন্য মুখটা এগিয়ে ধরেন আব্দেল।
বলা হচ্ছে, ২৭ আগস্ট লিবিয়া উপকূলের কাছে পৃথক দুই নৌকাডুবির ঘটনায় জীবিত উদ্ধার অভিবাসন প্রত্যাশীদের সাগর জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। ২৫ বছর বয়সী যুবক আব্দেল তাদেরই একজন। ইউরোপ পাড়ি জমাতে তিনি সুদান থেকে এসেছিলেন।
শুধু বাতাস নয়, বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন, তার সবকিছুই যেন ওই নৌকায় অনুপস্থিত। খাবার ও পানির সঙ্কটে তাদের অনেকেই এখন মৃত্যুপথযাত্রী। এ অবস্থায় সাগরে ভাসাদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটে মৃত্যুযন্ত্রণায়। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে অনেকের নৌযানেই মৃত্যু হয়েছে।
নৌকাডুবির ঘটনায় প্রায় তিনশ অভিবাসন প্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছে লিবিয়ার কোস্টগার্ড। অভিবাসীদের বেশির ভাগই সিরিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের। অভিবাসন প্রত্যাশীদের মাঝে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার নাগরিক ছাড়াও দেখা মিলছে বাংলাদেশীদেরও। নৌকাডুবির ঘটনায় এখনো পর্যন্ত যে ৫২ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে ২৪ জন বাংলাদেশী।
আব্দেল বলেন, বদ্ধ পাটাতনে আমাদের বন্দী করে রেখেছিলো ওরা। ভেতরে যেতে চাইতাম না আমরা। ওরা আমাদের পিটিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। বদ্ধ পাটাতনের ভেতর ছিল না কোনো বাতাস। একটু বাতাসের জন্য ছটফট করতে করতে আমরা উপরে উঠে আসার চেষ্টা করতাম। কিন্তু অন্য যাত্রীরা নৌকা ডুবে যাওয়ার ভয়ে আমাদের টেনে নিচে নামিয়ে আনতো। তারাও আমাদের পেটাতো।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, নৌকাতেই ৫২ জন অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়। এরা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও সুদানের নাগরিক ছিলেন। এদের মধ্যে একজন পানি খাওয়ার জন্য পাটাতনের উপরে উঠে আসার চেষ্টা করলে তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। তিনি সুদানের নাগরিক ছিলেন। বাকিরা মারা গেছেন দম বন্ধ হয়ে।
বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় দিনগত রাতেই জীবিতদের পাশাপাশি মরদেহগুলোও পালেরমো বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। জীবিত উদ্ধার অভিবাসন প্রত্যাশীদের কয়েকজন জানিয়েছেন, নৌকার পাটাতনের উপরে চড়ে সাগর পাড়ি দিতে তারা মানবপাচারকারীদের হাজার ইউরো/ডলার দিয়েছিলেন।
শর্ত মতো অনেকটা শান্তির ভ্রমণ প্রত্যাশা করলেও নৌকার অবস্থা দেখে তারা মর্মাহত হয়। স্বামী, তিন মেয়ে ও শিশুর ছেলের সাথে নৌকায় চড়া ৪৫ বছরের হাসনা বলেন, ‘জাহাজ দেখে আমি ফিরে আসতে চেয়েছিলাম। এটি শুধু একটি মাছ ধরার নৌকা ছিলো এবং আমাদের জীবন ছিলো আমাদের হাতে । এটা আসলে একটি ‘মৃত্যুর নৌকা’ ছিলো’।
বিপদসংকুল পথে স্বামী সঙ্গে না থাকায় নিরাপদ ভ্রমণ নিয়ে এমনিতেই ভয়ে ছিলেন দামেস্ক থেকে আসা ১৮ বছরের আমিনা। তিনি বলেন, এটা ছিলো খুবই বিপদজনক। তার ওপর আমি খুবই অল্প বয়সী। এছাড়া আমাদের সাথে কোনো খাবার বা পানিও ছিলো না।’
শ্বশুর, ননদ আর ননদের দুইমাসের বাচ্চা নিয়ে লিবিয়া ছেড়ে ছিলেন আমিনা। সাগরের তিন দিন থাকার বর্ণনায় তিনি শুধু বলেন, ‘খুবই কঠিন’।
ইরাক থেকে আসা অর্থোপেডিক সার্জন মাহদী ৩ হাজার ইউরো দিয়েছেন শুধু স্ত্রী আর বাচ্চাকে পাটাতনের উপরে তোলার জন্য। তার পরিবার জানায় জঙ্গিদের চিকিৎসা না করায় তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। মাহদী বলেন, ‘আমি আমার পরিবারে সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি দেখেছি জঙ্গিদের কথা যারা না শুনেছে তাদের কি অবস্থা হয়েছে।’
ইউএনএসসিআর এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইএমও) এর মতো সংস্থাগুলো বলছে, অভিবাসী সমস্যা সমাধানে ইউরোপের রাষ্ট্রনেতাদের আরো আন্তরিক হওয়া উচিত। ক্রমেই মারাত্মক হয়ে উঠছে অভিবাসী সঙ্কট। যা চরমে উঠেছে ইউরোপের দেশগুলোতে। প্রতিদিনই সাগর ও স্থলপথে আসা অভিবাসন প্রত্যাশীদের চাপ সামলে নিতে হিমশিম অবস্থা।
আর বিশ্লেষকদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক মানবিক সঙ্কট হয়ে এসেছে এই অভিবাসন সমস্যা। প্রতিদিনই ভূমধ্য সাগরে অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন হাজারো মানুষ।
ইউএনএনসিআর শুক্রবার জানায়, চলতি বছরে ভূমধ্য সাগর দিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমানো অভিবাসন প্রত্যাশীর সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়েছে। অভিবাসন প্রত্যাশীদের সবচেয়ে বেশি এসেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে। এরপরে আছে ইরিত্রিয়া, নাইজেরিয়া আর সোমালিয়ার দরিদ্র জনগণ। এই তালিকায় আছে বাংলাদেশও।