চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

মুসকান ঘটনায় ওয়াইসির বক্তব্যে যা শিখতে পারে বাংলাদেশ

ভারতের কর্নাটকে হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠী বিজেপির নেতাকর্মীরা বোরখা পরা ছাত্রীর সাথে যে কাণ্ড ঘটিয়েছে, সেই ঘটনা এখন শুধু ভারতবর্ষেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরেও উত্তাপ ছড়িয়েছে। বিশেষ করে উপমহাদেশের দেশগুলোতে সোশ্যাল মিডিয়া সয়লাব এই হিংসাত্মক ঘটনার পক্ষ-বিপক্ষে। ভারতের অনেক মানুষ বিজেপির এমন সাম্প্রদায়িক কাণ্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সুশীল সমাজ, সংবাদমাধ্যমসহ সাধারণ অনেক মানুষ ও প্রতিষ্ঠানই সাহসী মুসকানের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আবার সেই ছাত্রীর বিরুদ্ধেও একটা অংশ কথা বলছে। এদের বেশিরভাগই অবশ্য সেখানকার শাসক দল বিজেপির সমর্থক।

বিজেপি সবসময়ই ধর্মের কার্ড দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ  হাসিল করেছে, করছে এবং করবেও। তবে এবারকার বোরখা কার্ডে বিজেপি যে শুধু উত্তরপ্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছে, তাই নয়। ভারত এবং ভারতের বাইরে ধর্মান্ধ অনেক শক্তিই একে নিজেদের কার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। এমনকি ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানও এ বিষয়টিকে ‘ট্রাম্পকার্ড’ হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি ভারতকে তোপ দাগাতে ভোলেননি। এক টুইটে তিনি লিখেছেন: ‘মুসলিম মহিলাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় লঙ্ঘন। কাউকে এটা না দেওয়া আর তাকে হিজাব পরার জন্য সন্ত্রস্ত করা একেবারেই অত্যাচারী ঘটনা।’ এ বক্তব্য এমন একটা দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে আসলো, যারা নিজেরাই নারী শিক্ষার পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। দেশটির ধর্মীয় গোঁড়ামির জ্বলন্ত প্রমাণ হচ্ছে মালালা ইউসুফজাই। নারী শিক্ষার কথা বলায় পাকিস্তানের মৌলবাদী গোষ্ঠী মালালাকে মৃত্যুর দুয়ারে নিয়ে গিয়েছিল। এমনকি নিজ দেশে থাকতে পারেননি মালালা। এছাড়া বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর হিসেবেও পরিচিত পাকিস্তান।

এ বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ভারতীয় মুসলিম রাজনীতিবিদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। তিনি বলতে গেলে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ শাহ কোরেশিকে ‘নিজের চরকায় তেল দিতে’ বলেছেন। ভারতের উত্তরপ্রদেশে এক জনসভায় ওয়াইসি বলেন: ‘মহিলাদের শিক্ষা নিয়ে পাকিস্তানের পাঠ পড়ানোর দরকার নেই। মালালার উপর হামলা পাকিস্তানে হয়েছে… পাকিস্তানের সংবিধানের নিয়মে কোনও অমুসলিম সেখানে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন না। আমরা পাকিস্তানিদের বলব, এদিকে দেখো না…ওদিকেই দেখো…তুমি তোমাদের বালুচিদের সমস্যা… আর কী কী ঝগড়া রয়েছে সেগুলো দেখো…এই দেশ আমার, তোমাদের নয়। আমাদের ঘরের মামলা। আপনারা এতে নাক গলাবেন না। পাকিস্তান নিজের দেশের মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, তাদের আর ভারতকে জ্ঞান দেওয়ার দরকার নেই।’

কর্নাটকের বোরখাকাণ্ডে বাংলাদেশ সরকারের কেউ কোনো ধরনের মন্তব্য করেননি। এটাই স্বাভাবিক। কারণ এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তবুও ভারতীয় মুসলিম রাজনীতিবিদের এমন বক্তব্য পাকিস্তানের উদ্দেশে হলেও বাংলাদেশের অতি উৎসাহীদের জন্যও প্রযোজ্য। আমাদের এখানে ফেসবুকে যারা ভারতের এ ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়া কাঁপাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই আজন্ম ভারতবিদ্বেষী। ইসলাম এখানে তাদের জন্য উছিলা মাত্র। এ ঘটনা ভারতে না হয়ে যদি ইউরোপ আমেরিকায় হতো তাহলে এরা এতটা উন্মাদনা তৈরি করত না। এর মানে এই নয় যে নারী কী পোশাক পরবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা থাকবে না। স্বাধীনতা বোরখার জন্যও যতটা থাকবে, অন্য পোশাকের বেলায়ও ঠিক তাই। এক্ষেত্রে ভারতীয় কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর বক্তব্য  উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন: ‘বিকিনি হোক, ঘোমটা হোক, জিন্স বা হিজাব হোক, একজন নারী কী পরতে চান সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার নিজের। ভারতীয় সংবিধান সেই অধিকার নিশ্চিত করেছে। নারীদের হয়রানি বন্ধ করুন।’

তবে বাংলাদেশে এখন বোরখাকাণ্ডে তারাই ঝড় তুলছে, যারা নারীদের জিন্স কিংবা অন্য পোশাকের ঘোর বিরোধী। এমনকি ধর্ষণ কিংবা নারীর সাথে হওয়া যেকোন অন্যায়ের জন্য তারা নারীর পোশাককে আগে দোষ দিয়ে থাকেন। এমনকি হেফাজতের তাণ্ডবের সময় শুধু নারী হয়ে সাংবাদিকতা করার কারণে তাদের আক্রমণে মৃত্যুর দুয়ারে চলে যেতে হয়েছিল সংবাদকর্মী নাদিয়া শারমিনকে। ভাগ্যক্রমে সেই নারী সংবাদকর্মী জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে আবার সাংবাদিকতায় ‍ফিরতে পেরেছেন।

এছাড়া সিলেটের একটি ঘটনাও এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় মেয়ের পোশাকের জন্য একটি পরিবারকে সমাজচ্যুত করার ঘটনাও ঘটেছিল। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা যায়, ‘সিলেটের একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক পাস করেন উচ্চশিক্ষার জন্য গত ২৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে যায় নুরুননাহার চৌধুরী ঝর্ণা নামের এক শিক্ষার্থী। সেখানে যাওয়ার পর ঝর্ণা সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু ছবি পোস্ট করে, যেটা স্বাভাবিকভাবেই আমরা সবাই করে থাকি। কিন্তু এটাকে স্বাভাবিকভাবে না নিয়ে এসব ছবি দেখে তার গ্রামের লোকজন আপত্তিকর মন্তব্য শুরু করে। শুধু তাই নয় তার বাবাকে ভাটেরা বাজার জামে মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির কিছু লোক ডেকে বলে মেয়ে কেন এমন পোশাক পরেছে। সেজন্য ঝর্ণার বাবাকে সমাজচ্যুত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।’

এমন ছবির কারণে মৌলভীবাজারে সমাজচ্যুত ঝর্ণার পরিবার

 

নিজ দেশে নারীর পোশাকের জন্য একটি পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হলেও তো এদের কোনো আওয়াজ ওঠে না। একবারের জন্যও তো তখন ফেসবুকে কেউ পোস্ট দিয়ে বলল না যে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে একজন নারী কী পরবে সেটা সে ঠিক করবে। এজন্য হাজার হাজার মাইল দূরে তার গ্রামে কেন পরিবারকে সমাজচ্যুত করবে? এই সাহস এরা কোত্থেকে পেল?’ না একথা এখনকার সরব ফেসবুকাররা বলেননি। বলবেনও না। যেমন অধিকাংশই সংখ্যালঘু নির্যাতন ও তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার সময়ও কথা বলেন না। কিন্তু ভিনদেশের ঘটনায় এরা সরব হয়ে ওঠেন।

এজন্য ভারতীয় মুসলিম রাজনীতিবিদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসির ভাষায় বলতে হয়: ভারতের এ ঘটনায় পাঠ পড়ানোর বদলে নিজের চরকায় তেল দিন। নিজের দেশের নারীদের আগে সম্মান দিন। তাদের অধিকার ও সম্মান রক্ষায় আগে সরব হোন। নিজের ঘর সামলাতে না পারলে অন্যের ঘর নিয়ে কথা বলা যায় না। ভারতের এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদ করার জন্য ভারতীয়রাই আছেন, বাংলাদেশের এমন অন্যায় ঘটনাগুলোর জন্য সেই মুসকানের মতো আপনিও শিরদাঁড়া সোজা করে প্রতিবাদ করুন। এরপর বিশ্বের সব নারীর সম্মান রক্ষায় দাঁড়ানো এবং কথা বলা যাবে।

এটাই যদি না হয়, তাহলে বিজেপি আর আপনাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)