মৃত কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার আলোচনা প্রায় শেষ। তার মৃত্যুতে পরিসমাপ্তি ঘটেছে এক জীবনের, আর অভিযুক্তের নামপ্রকাশে আপাত-সমাপ্তি ঘটেছে মৃত্যু-রহস্যের উন্মোচন কিংবা বিচার প্রক্রিয়ার। মধ্যিখানে মেয়েটির চরিত্র নিয়ে টানাটানি হয়েছে। তাকে লোভী-নষ্টা বলে ফরমায়েশি অপচেষ্টায় চিত্রিত করতে চেয়েছে একদল। তারা সফল হয়নি ঠিক, তবে অভিযুক্তের আর্থিক-সামাজিক এবং অথবা রাজনৈতিক প্রভাবে দৃশ্যের অন্তরালে চলে গেছে বিচারিক পর্যায়ের প্রাথমিক ধাপ তদন্ত।
মুনিয়ার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলা হচ্ছে। হয়ত এটা আত্মহত্যা, হয়ত একটা হত্যা। তদন্তসাপেক্ষ বিষয়, তবে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হয়েছে। মামলার বাদী মুনিয়ার বড়বোন নুসরাত জাহান। মামলায় অভিযুক্ত বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর। অভিযুক্তের এই পরিচয়েই থমকে গেছে সব, শঙ্কায় পড়েছে বিচারের সম্ভাবনা।
দেশের ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী অন্যতম করপোরেট হাউস বসুন্ধরা গ্রুপ। প্রভাবশালী একাধিক মিডিয়ার মালিকও তারা। তাদের অর্থের প্রভাব সমাজের নানা ক্ষেত্রে। বিবিধ এই প্রভাবের কারণে তারা অনেককিছুই করতে পারে যা আমাদের চিন্তারও বাইরে। এই প্রভাবের কারণে আমরা যা দেখলাম তাতে পরিস্কার হয়ে গেছে তাদের শক্তি। নিজেদের মিডিয়ায় সংবাদ ব্ল্যাকআউট থেকে শুরু করে পরিচিত-অপরিচিত অনেক মিডিয়ায় কলেজছাত্রী মুনিয়ার চরিত্রহননের অপচেষ্টা হয়েছে। বসুন্ধরার এমডির হত্যার প্ররোচনায় জড়িত থাকার অভিযোগ সত্ত্বেও বেশিরভাগ মিডিয়া তার নাম প্রকাশে শুরুতে বিরত থেকেছে।
আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ এসেছে নানা গণমাধ্যমে। তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশের উদ্যোগ লক্ষণীয় হয়নি। এই মামলা নিয়ে পুলিশ ও সরকারের ভূমিকাও রহস্যজনক। এইধরনের আলোচিত মামলা নিয়ে মন্ত্রী ও পুলিশ প্রশাসনকে তৎপর দেখা যায় এক্ষেত্রে তেমন কিছুই নেই। বলা যায় এই ইস্যুতে অদ্ভুত এক নীরবতা ভর করছে সবখানে। ফলে হত্যাকাণ্ডের এক মাসের মধ্যেই মাটিতে মিশে গেছে মোসারাত জাহান মুনিয়া নামের মেয়েটি, হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তার মৃত্যু নিয়ে আলোচনা, গণমাধ্যম-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সবজায়গা থেকে উধাও হয়ে গেছে অভিযুক্তের বিচারের দাবি। মৃত্যুর একমাসের মাথায় যখন এই নিবন্ধটি লিখছি তখন গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোথাও নাম নাই মুনিয়ার, আলোচনা নাই তার মৃত্যুর, রহস্য-উন্মোচনের দাবি নাই; নাই, একদম নাই!
আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে আমরা দেশের নানা প্রান্তে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে মানববন্ধন, প্রতিবাদ কর্মসূচি দেখে থাকি। মুনিয়ার ক্ষেত্রে তেমনটা লক্ষ্য করা যায়নি। বড় পরিসরে কেন হয়নি কে জানে! করোনার প্রভাব, রমযানের প্রভাব? উত্তর অবশ্য নাই। এইধরনের কর্মসূচিগুলোর আয়োজকেরা বিক্ষিপ্তভাবে দেশের নানা প্রান্তে থাকেন এবং এখানে নির্দিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষ না থাকার কারণে হয়ত এর উত্তর মিলবে না। গণমাধ্যমের নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ থাকে, সেখানে অনেকের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব থাকে, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম; ওখানে ত কোন কর্তৃপক্ষ নাই, কেউ কারও কাছে জবাবদিহি করে না, প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র। তাহলে ওখান থেকেও কেন উধাও হলো সায়েম সোবহান আনভীরের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবি? এসব নিয়ে ভাবতে পারেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তবে সবাই কি ধরে নিচ্ছে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডির প্রভাবে সরকার-প্রশাসনের সবাই চুপ করে বসে আছে, এই মৃত্যুরহস্যের উন্মোচন হবে না! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাক্টিভিস্টরাও কেন পিছু হটল বিচারের দাবি থেকে?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অ্যাক্টিভিস্টরা বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক ইস্যুতে ব্যস্ত থাকেন বছরব্যাপী। এই সময়ে নানা ইস্যু আসে, নানা ইস্যু যায়। এক ইস্যু ছেড়ে আরেক ইস্যুতে দ্রুতই লটকে পড়ে তারা। এতে করে অনেক প্রতিবাদ স্রেফ মাঝপথেই থেমে যায়। মুনিয়ার ঘটনাও তাই। এই ঘটনাও হারিয়ে গেছে। এবার এই ঘটনার হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে অন্য কোন ঘটনার যোগসূত্র না থাকলেও এটা হারিয়ে গেছে আচমকাই।
মোসারাত জাহান মুনিয়া কলেজছাত্রী, কতই বা বয়স তার? ১৭/১৮! মা-বাবা নেই। তার দাফনের পর জানা গেছে তার পিতৃ-মাতৃহীন অবস্থার কথা। অথচ কী নোংরামোই না করে গেছে একদল লোক, একদল ফরমায়েশি মিডিয়া তাকে ও তার পরিবারকে ঘিরে কত কাহিনীই না ছড়াল! এদিকে, মুনিয়ার আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ যার বিরুদ্ধে সেই বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর বিবাহিত। অথচ একটা কিশোরী মেয়েকে নানা প্রলোভনে কিংবা বাধ্য করে রেখেছিল তার নিয়ন্ত্রণে। স্খলনের চূড়ান্ত ধাপে জড়িত ছিল এই ব্যবসায়ী। প্রকাশিত কথোপকথনের সূত্রে জানাও গেল মৃত্যুর আগে আর্থিক ঘাপলার অভিযোগও করেছিলেন সায়েম সোবহান আনভীর। এখানে রূঢ়ভাষী আনভীরের যে রূপ প্রকাশ্য হয়েছিল সেও কি মুনিয়ার মৃত্যুর অন্যতম অনুঘটক নয়? ক্ষীণ তবু আশা করি তদন্তে এটাও ওঠে আসবে।
মুনিয়ার সঙ্গে আনভীরের কেন সম্পর্ক, মুনিয়ার বাস কোথায়- এগুলোর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো মৃত্যু ঘটনাটাই। মৃত্যুর আগের দিন বোনের সঙ্গে কথোপকথনে বিপদে পড়ে যাওয়ার কথা, আনভীরের শাসানোর ভঙ্গি এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে রায় দেওয়ার পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দেয়। এরপর আনভীরের পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ, আনভীরের পরিবারের সদস্যদের দেশত্যাগের সংবাদ, বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন মিডিয়া থেকে সংবাদ ব্ল্যাকআউট, চেনা-অচেনা মিডিয়ায় মুনিয়াকে চরিত্রহীনা বলে প্রচারের অপচেষ্টা, বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন মিডিয়াগুলোর কর্মীদের ‘গর্বিত’ হয়ে থাকার ফেসবুকীয় বয়ানগুলো এই মৃত্যুর সঙ্গে আনভীরের সম্পৃক্ততাকে কাছাকাছি এনে দিচ্ছে। অথচ অবাক করা বিষয় হচ্ছে, আনভীর কোথায় এটা কেউ জানে না, পুলিশ-সরকার-মন্ত্রী-মিডিয়া-সোশ্যাল মিডিয়ার কেউই আগ্রহী না।
এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগ। এই সময়ে ফেসবুকের আলোচনা থেমে যাওয়া মানে সব জায়গা থেকে আলোচনা থেমে যাওয়া। মুনিয়ার মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনের দাবিও থমকে গেছে। যখন ফেসবুক ছিল না, অনলাইন গণমাধ্যম ছিল না, বেসরকারি টেলিভিশন ছিল না তখনও মানবিক বাংলাদেশ ছিল। আলোচিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরব হতো দেশ, সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছিল কবিতা-গানে-নাটকে। শারমিন রীমা হত্যায় মুনির-খুকুর ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা সেই মানবিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন ত ইতিহাসই। অথচ এখন সংস্কৃতিও পুঁজির কাছে বন্দি, ব্যাপ্তিক্ষেত্রও স্রেফ ফেসবুকে; ইস্যুতে-ইস্যুতে। ইস্যু শেষ মানবিকতাও শেষ!
কিশোরী মুনিয়ার মৃত্যুর রহস্য উন্মোচন হবে কিনা আমরা জানি না। আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ যার বিরুদ্ধে সেই সায়েম সোবহান আনভীর প্রবল প্রতিপত্তিশীল। তার অর্থ আছে, অর্থে উদ্ভূত ক্ষমতাও আছে, দেশের মিডিয়ার বড় অংশ তারা নিয়ন্ত্রণ করেন। এতকিছু নিয়ন্ত্রণ যারা করে তারা হয়ত আইনকে কাগজে ফেলে রেখে দেওয়ার ক্ষমতাটাও রাখেন। আমরা তাদের এই ক্ষমতায় উদ্বিগ্ন, আমরা তাদের এই ক্ষমতায় আশাহীন।
মোসারাত জাহান মুনিয়া, আমরা ক্ষমতাহীন; ক্ষমা চাইতে এই ‘অজুহাত’ দাঁড় করাচ্ছি। আমাদের ক্ষমা করো। আনভীরদের বিচারের মুখোমুখি করতে ক্ষমতা রাখে যারা, যারা আনভীরদের বাঁচাতে মরিয়া নানা উপায়ে তাদের ক্ষমা করো না!
তোমাকে ভুলে যেতে এক মাসও লাগেনি আমাদের, মুনিয়া!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)