চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরসূরিদের প্রতি এত ক্ষোভ কাদের?

কোটা না রাখলে মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসূরিদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা রাখার দাবি

কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর ‘কোটা বাতিল’ ঘোষণার পর মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাদের উত্তরসূরিদের সম্মিলিতভাবে কোন বড় ধরনের প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। তবে রাজধানীতে আয়োজিত কৃষিবিদ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা অনুষ্ঠানে আসা বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধারা দেরীতে হলেও সরব হন। অনুষ্ঠান মঞ্চে দেয়া বক্তব্য এবং চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথোপকথনে তারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকা না থাকা এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের অনলাইন-অফলাইন প্ল্যাটফর্মে মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা ও তাদের উত্তরসূরিদের হেয় করার তীব্র সমালোচনা করেন।

মুক্তিযুদ্ধে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের অস্তিত্বের স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম।

১৯৭১ সালে ১১ নম্বর সেক্টরের এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন: প্রথম কথা আমরা সার্টিফিকেটের জন্য যুদ্ধে যাইনি। দেশকে ভালোবেসে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে গিয়েছি তরুণ বয়সে। তখন আমাদের সম বয়সীদের অনেকেই যুদ্ধে না গিয়ে মাথা নিচু করে কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়েছে। আমাদের সন্তানদের জন্য বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকতেই কোটা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। আজকে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে উপহাস করে, আমি মনে করি তারা বাংলাদেশকে নিয়ে উপহাস করে। বাংলাদেশকে যারা স্বীকার করে, বাংলাদেশের অস্তিত্বকে যারা স্বীকার করে তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান এবং তাদের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে হবে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ যেনো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ থেকে বিচ্যুৎ না হয়, সেজন্য অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত যাদের গায়ে বইছে তাদের সরিয়ে ফেলা যাবে না।

তবে সংস্কার যে সময়ের প্রয়োজন এই বাস্তবতা তুলে ধরে এই কৃষিবিদ মুক্তিযোদ্ধা বলেন: আমাদের সময় তো ফুরিয়ে আসছে। আর ১০-১৫ বছর পর বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধারাই হয়তো জীবিত থাকবেন না। তো তাদের মৃত্যুর পর এই দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে? ১০ হাজার টাকা ভাতাই কি রাষ্ট্রের দেয়া সম্মান? রাষ্ট্র আমাদের অবদানের প্রতি সম্মান জানাতে বিশেষ সুবিধা দিয়ে আসছে। সেটা নিয়ে হিংসা কাদের হতে পারে, কাদের এতো ক্ষোভ জাগতে পারে সেটা ভেবে দেখতে হবে। আর সরকারি চাকরির বয়সীমা আছে আমাদের এমন সন্তানদের সংখ্যাও কি কমে আসছে না?

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন: দেশটা আমরা স্বাধীন না করলে বিসিএস ক্যাডার হওয়া তো দূরে থাক বিশ্ববিদ্যালয়েও হয়তো অনেকের পড়তে পারতো না। আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে খাটো করে এরা যে পদে আসতে চায় সেই পদে আসার যৌক্তিকতাও তারা হারিয়েছে। এদের সংখ্যাই বেশি কারণ ১৯৭১ সালে সবাইতো যুদ্ধে যায়নি। মুসলিম লীগের সমর্থকদের পরবর্তী প্রজন্ম নেই এটা বলা যায়?

৭ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করা আরেক মুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন বলেন: আমার মনে হয় কোটা সংস্কার হওয়া উচিৎ। কিন্তু কোটা সংস্কারের আন্দোলনে আমাদের বিরুদ্ধে যেসব প্রচারণা দেখেছি তাতে আমার মনে হয় আমরা যেনো মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে অপরাধ করেছিলাম। পরিস্থিতি এমন করা হয়েছিলো যে প্রধানমন্ত্রী বাতিল ঘোষণা করেন। বাতিল করা হলেও আমার মতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য বিকল্প কোন ব্যবস্থা রাখা উচিৎ। সন্তানদের পরবর্তী প্রজন্ম কী করবে সেটা রাষ্ট্র ভেবে দেখতে পারে।

১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা রেজ্জাকুল ইসলাম বলেন: আমরা কারও বাঁশি-হুইসেল শুনে যুদ্ধে যাইনি। কিংবা চীন-রাশিয়ায় পড়ে এসে বিপ্লবের অলীক স্বপ্নে মাও-লেলিনের পথ ধরিনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে নির্দ্বিধায় যুদ্ধে গিয়েছি। সার্টিফিকেট পাবো, আমাদের কোটা দেয়া হবে আমরা এই ভেবে যুদ্ধে যাইনি।  লোভীরা নিঃস্বার্থে যুদ্ধে যেতে পারে না। এখন আমাদের মতো নির্লোভী আবেগী বৃদ্ধ এবং লুকিয়ে-পাক বাহিনীকে হুজুর বলাদের উত্তরসূরিরা মুখোমুখি। এতোদিন এই কোটা নিয়ে কোন কথা হয়নি। সরকারি চাকরিতে বেতন বৃদ্ধির পর লোভীদের স্বার্থের পথে সবচেয়ে বড় বাধা মুক্তিযোদ্ধা কোটা।

কিন্তু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের নেয়া সার্টিফিকেট ধারী উত্তরসূরির জামায়াত-শিবিরপন্থী হওয়ার রূঢ় সত্যকে নাকচ করেননি মুক্তিযোদ্ধারা।

তবে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’ তৈরিতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাও দায় এড়াতে পারেন না বলে মনে করেন তারা।
মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা নূর তালুকদার বলেন: আমরা সার্টিফিকেটের জন্য যুদ্ধে যাইনি। এরপর রাষ্ট্র স্বীকৃতি হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়েছে, রাষ্ট্রীয় সুবিধা দিয়েছে। আমার কোন সার্টিফিকেট নাই। আজকে অনেক ফেক ‘মুক্তিযোদ্ধা’ রাষ্ট্রীয় সুবিধা পেতে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানের ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে।

এখন এই কলঙ্ক দূর করার এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সদা সচেষ্ট শক্তির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সময় এসেছে এবং বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের সন্তানদের সুবিধা দেবার জন্য প্রথমে এ কোটা চালু করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে প্রথম এই কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়।  কিন্তু ক্রমান্বয়ে এই কোটার পরিধি বেড়েছে।

এখন মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনীদের জন্য এ কোটা প্রযোজ্য হচ্ছে। ৬৪টি জেলার জন্য কোটা আছে।
বাংলাদেশের সরকারী চাকরীতে এখন ২৫৮ ধরনের কোটা আছে।

বাংলাদেশের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সূত্রমতে, প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে মোট পাঁচটা ক্যাটাগরিতে কোটার ব্যবস্থা রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায়।