বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবার, মানে এই ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছে। প্রকাশ করেছে ওয়েবসাইটে। তারপর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখছি, নানান প্রতিক্রিয়া।
প্রথমে চোখে পড়ল, অভিনন্দন জানিয়ে প্রতিক্রিয়া। তারপর নিন্দা জানিয়ে। জানা গেল, অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৯তম বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় আছে!
আমি একটুও অবাক হইনি। না, এমন নয় যে আমি জানতাম রাজাকারের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া। জানতাম না। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যতসামান্য যে কাজ করেছি- করছি, তাতে দেখেছি তখন পাকিস্তানিদের নিয়োগ করা শান্তিকমিটির কোনো কোনো সদস্য গোপনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন।
২০০৯ সালে বানিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধে স্বজনহারাদের স্মৃতিমূলক ধারাবাহিক প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ‘কান্দে আমার মা’। বছরব্যাপী এটিএন বাংলা ৩১৫টি এপিসোড প্রতিদিন প্রচার করেছে। ‘কান্দে আমার মা’ বানাতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী নাকি শান্তি কমিটির সদস্য- এই দ্বন্দ্বে পড়েছিলাম।
‘কান্দে আমার মা’র জন্য দেশের আনাচে-কানাচে মুক্তিযুদ্ধে স্বজনহারা- ইতিহাসের পাতায় নাম না-থাকা বহু মানুষের যুদ্ধস্মৃতি ধারণ করেছিলাম। অবশ্যই গবেষণা করেছিলাম কাজটি। তবে সরকারি নথিপত্র ঘেঁটে করা নয় সে গবেষণা। যে পদ্ধতিতে করেছিলাম কাজটি- গবেষণা স্পেশালিস্ট হলে হয়তো এই কাজটিকে ‘গণ-গবেষণা’ উপাধি দেওয়া চলতো। তো যা-ই হোক।
মুন্সিগঞ্জ সদরে ‘কান্দে আমার মা’র শুটিং করতে গিয়ে প্রকাশ্য শান্তি কমিটির সদস্য, গোপনে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী একজনের প্রসঙ্গ এলো। দুই/তিনজনের সাক্ষাতকারে ওই একই মানুষের কাছে সাহায্য পাওয়ার কথা বললেন। সাক্ষাতকারেই জানলাম, তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু রাজাকার হিসেবে নয়- সকলেই অন ক্যামেরা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী হিসেবে বর্ণনা করলেন। চিত্রগ্রহণকালেই বিষয়টি খেয়াল করলেও ওটা নিয়ে ওখানে আর ভেরিফাই করিনি। সময় ছিল না।
সম্পাদনায় বসে বিষয়টি নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়লাম, দুশ্চিন্তা হলো। সেবার মুন্সিগঞ্জে যাদের সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম তাদের মধ্যে একজন ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তার ভাই মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন।
সাক্ষাতকারে তিনি অবশ্য সেই ‘প্রকাশ্য শান্তি কমিটি কিন্তু আসলে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী’ ব্যক্তির কথা বলেননি। ভাইকে বাঁচাতে সেই মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারীর সাহায্য নিতে হয়নি। কারণ সাহায্য চাওয়ার আগেই পাকিস্তানিরা তার ভাইকে হত্যা করেছে।
এই দিদি এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মুন্নী সাহার স্কুল শিক্ষক। শুটিং করতে যখন গেছিলাম- তখন তিনি বলেছিলেন আমাকে। যেকোনো জায়গায় শুটিং করতে গিয়ে মানুষের সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক হয়ে যায় আমার। মনে হয় পরে আবার কোনো সময় শুধু বেড়াতেই যাবো। সব সময় ফোন নম্বর বিনিময় হয়। তো মুন্নী সাহার স্কুল শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধে ভাই হারানো ওই দিদির ফোন নম্বরও ছিল আমার কাছে। সম্পাদনার টেবিলে বসে সেই দিদিকে ফোন করে ‘শান্তি কমিটির সদস্য নাকি মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী’ দ্বন্দ্ব দূর করা গেছিল তখন। তিনিই বলেছিলেন, পাকিস্তানীদের তালিকাভুক্ত শান্তি কমিটির ওই সদস্য এলাকার এক মান্যজন- তিনি গোপনে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারীদের একজন ছিলেন।
ছোটবেলা থেকে ‘রাজাকার’ শব্দটি শুনেছি অনেক। আমাদের সমাজে পাকিস্তানপন্থী বোঝাতে ‘রাজাকার’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো। আমিও সব সময় এটাই ভেবে এসেছিলাম।
এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বিষয়ক প্রামাণ্যছবি ‘কারো দানে পাওয়া নয়’ বানাতে গিয়ে দলিলপত্র, প্রমাণাদি ঘাটতে হচ্ছে প্রচুর। এই ছবি বানাতে গিয়েই আমি প্রথমবারের মতোন জানলাম, তখন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সরকার হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য পরিপত্র জারি করে ‘শান্তি কমিটি’ গঠন এবং ‘রাজাকার’ বাহিনী নিয়োগ করে।
সেই নির্দেশ অনুযায়ী তখন প্রতিটি মহকুমা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং এলাকার মান্যগণ্য অনেকের নাম কাগজেপত্রে ‘শান্তি কমিটি’তে ছিল। এদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। তবে কারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন- কারা পাকিস্তানীদের পক্ষে সেটা সেই এলাকার মানুষ জানেন। নথিপত্র ঘাঁটলেও তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। শান্তি কমিটির সদস্যদের কোনো ভাতা দেওয়া হয়েছিল কিনা সেটা অবশ্য আমার জানা নেই।
‘রাজাকার’ তখনকার পাকিস্তান সরকারের নিয়োগ করা একটি বাহিনী। এই বাহিনী এখনকার আনসার বাহিনীর মতোন। তাদেরকে অস্ত্র চালনা শেখানো হয়েছিল- মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করার জন্য। তখনকার হিসাবে মাসিক বেশ মোটা অঙ্কের বেতনও দেওয়া হতো। খুব বেশিদিন নয়- বছরখানেক হবে এই বিষয়টা জানতে পেরেছি। আমার এখনকার প্রামাণ্যছবিটি বানাতে গিয়েই জেনেছি এটা।
‘রাজাকার’ শব্দটি যে শুধুমাত্র পাকিস্তানপন্থী বোঝাবার শব্দ নয়- সেটা এই প্রামাণ্যছবির গবেষণা করতে গিয়ে নথিপত্র না ঘাঁটলে আমার হয়তো জানা হতো না।
রাজাকার এবং শান্তি কমিটি তখনকার পাকিস্তান সরকারের নিয়োগ করা। জামায়াতে ইসলামীর সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন আলবদর, আলশামস। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে গণহত্যায় সহায়তা করা ছিল তাদের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তারা গণহত্যা করেছে, করেছে মানবতা বিরোধী অপরাধ।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রথম পাঠ আমার মায়ের কাছে। ছোটবেলা থেকে বহুবার মা আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাড়ি ছেড়ে পালাবার কথা বলেছেন, লাশের গন্ধে বহুদিন ভাত না খেতে পারার কথা বলেছেন। তখনই তিনি আমাদের এলাকার চেয়ারম্যানের কথা বলতেন। দরজার কপাট খুলে তাকে ট্রেচার বানিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের রাতের অন্ধকারে ওই চেয়ারম্যানের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন আমার বাবা-কাকারা। এই কথা আমি মায়ের কাছেই শুনেছি।
বছর দুয়েক আগে আমার মায়ের মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতি ক্যামেরায় ধারণ করেছি। ধারণ করাকালে জানতে পেলাম, আমাদের ইউনিয়নের ওই চেয়ারম্যানকে যুদ্ধের পর পাকিস্তানপন্থী হিসেবে অতি উৎসাহী কেউ কেউ অপদস্থ করতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধারাই নাকি তাঁকে তখন বাঁচিয়েছিলেন।
ছোটবেলায় মা যখন মুক্তিযুদ্ধের একই গল্প বারবার বলতেন- তখন কিন্তু এই অংশটুকু বলেন নাই কখনও! বুঝতে পারলাম, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের খবর দৈনিক কাগজে পড়ায় এই বিষয়টিও যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সেটা তার চেতনায় ঢুকে পড়েছে।
আমার প্রামাণ্যছবি ‘কারো দানে পাওয়া নয়’র গবেষণাকালে ২৯ মার্চ, ১৯৭২ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকে পড়ি:
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যায় সহযোগিতা করার অভিযোগে যারা গ্রেপ্তার হইয়াছে, যথাশীঘ্র সম্ভব এবং সুষ্ঠু ও ন্যায়ানুগ পন্থায় তাহাদের বিচার অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ সরকার গতকাল ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা ঘোষণা করেন।
সরকারের ট্রাইব্যুনাল আদেশে বলা হয়, একজন সেশন জজ অথবা একজন এডিশনাল সেশন জজ অথবা একজন এ্যাসিসট্যান্ট সেশন জজ লইয়া প্রতিটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হইয়াছে।
১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ The Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order, 1972 (PRESIDENT’S ORDER NO. 8 OF 1972) নামে একটি আইন করা হয়। এটি ‘দালাল আইন’ নামে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব রাজাকার, আলবদর, আলশামস পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করে অপরাধ করেছে, তাদের বিচারের জন্য এই আইনটি করা হয়েছিল।
১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই আইনের আওতায় ২,৮৮৪টি মামলা হয়। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ৩৭ হাজার ৪৭১ জনকে।
দ্রুত বিচার করার জন্য সারা দেশে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আটক থাকা প্রায় ১১ হাজার আসামির বিচার তখন চলছিল। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দুই হাজার ৮৮৪টি মামলার নিষ্পত্তি হয়।
বিচারে ৭৫২ জনের সাজা হয়। প্রমাণিত দোষীরা মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড পায়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দেওয়া এবং পাকিস্তান সরকারে যোগ দেওয়া আওয়ামী লীগের গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের ২৩ জনকে তখন দলীয় প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বহিষ্কারও করেছিলেন।
পাকিস্তানিরা যখন শান্তি কমিটি গঠন করে তখন আওয়ামী লীগের কর্মী ছাড়া সকল থানা, মহকুমা ও জেলায় স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রায় সবার নামই কমিটিতে যুক্ত করে দেয়। তালিকাভুক্ত শান্তি কমিটির অনেক সদস্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। এদেরকে মামলার বাইরে রাখার জন্যই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছিল।
১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমাসংক্রান্ত প্রেসনোটে পরিস্কার বলা হয়, ‘ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, ঘরবাড়ি অথবা জাহাজে অগ্নিসংযোগের দায়ে দণ্ডিত ও অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রদর্শন প্রযোজ্য হইবে না।’
এবার ৪৯তম বিজয় দিবসে বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে যে রাজাকার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে সেটা নিয়ে বিতর্ক থেকে আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম বিষয়টি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রথমে বলা হলো, রাজাকারের এই তালিকা পাকিস্তানীদের তৈরি করা তালিকা। এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া সেই তালিকাটি হুবহু তারা মানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কোনো পরিবর্তন ছাড়া ওয়েবসাইটে আপ করেছে।
তালিকাটি দেখে মন্তব্যের ঘরের মন্তব্যগুলো পড়ে আমার মনে হলো, এটা ১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ The Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order, 1972 (PRESIDENT’S ORDER NO. 8 OF 1972) নামের আইনের অধীনে গঠিত ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যায় সহযোগিতা করার অভিযোগে আটক থাকা প্রায় ১১ হাজার আসামির বিচারাধীন আসামীর তালিকা।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দুই হাজার আটশ চুরাশিটি (২৮৮৪) মামলার নিষ্পত্তি হয়। প্রতিটি নামের পাশে মন্তব্যের ঘরে লেখা কথাগুলো পড়ে এই ধারণা করছি আমি।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমাকে হত্যা করার পর ১৯৭৫ এর ৩১ ডিসেম্বর এক সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে The Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order, 1972 (PRESIDENT’S ORDER NO. 8 OF 1972) ‘দালাল আইন’ বাতিল করা হয়। থেমে যায় যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম। সে সময় চারটি সুনির্দিষ্ট অপরাধে কারাগারে আটক ১১ হাজার আসামি, এমনকি সাজাপ্রাপ্তরাও জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যায়।
বিচার চলাকালে, পুরো প্রক্রিয়াটি থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় যদি পাকিস্তানিদের রাজাকার বাহিনীর তালিকা ওয়েবসাইটে দিয়ে এটাকে রাজাকারের তালিকা বলেন তবে সেটা অবশ্যই বিভ্রান্তিকর হবে। কারণ পাকিস্তানিদের তালিকাভুক্ত শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সকলে তাদের পক্ষ হয়ে কাজ করেননি।
আজ ৪৯তম বিজয় দিবসে ‘রাজাকারের’ তালিকা প্রকাশে বিভ্রান্তির এটাই সম্ভবত একটা বড় কারণ।
প্রামাণ্যছবি ‘কারো দানে পাওয়া নয়’-র জন্য দলিলপত্র ঘাটতে গিয়ে পেয়েছি অনেক কিছু। প্রামাণ্য দলিলের অভিজ্ঞতা থেকে জানলাম, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, বাংলাদেশ’ ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি নয় কেবল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহায়তাকারীদের গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের কথা শুরু হয়েছিল দেশ পুরোপুরি স্বাধীন হবার আগেই।
১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ হয়েছে দালাল আইন, ১৯৭৩ সালের ১৪ জুলাই জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধী বিচার আইন প্রণয়নের জন্য সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বিল গৃহীত হয়েছে। (সূত্র: দৈনিক আজাদ, ১৫ জুলাই, ১৯৭৩) ১৯৭৩ সালেই প্রণীত হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত অ্যাক্ট।
‘কারো দানে পাওয়া নয়’ ছবির জন্য প্রামাণ্য বহুকিছু পেলেও যাকিছু দরকার তার অনেককিছুই পাইনি, পাচ্ছি না। আগারগাঁওয়ের জাতীয় আর্কাইভে গেছি। শুরুতে গবেষণাকালে গিয়ে যে দলিল পেয়েছি, পরে চিত্রগ্রহণের সময় গিয়ে তার কিছু আর পাইনি। উদারহরণসহই বলতে পারি, The Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order, 1972 (PRESIDENT’S ORDER NO. 8 OF 1972) -র কথা। প্রথম দফায় পেয়েছি, পরে সরকারি গেজেটের সংকলন থেকে উধাও হয়ে গেছে! তার মানেটা কি? মানেটা হলো যে, কেউ না কেউ নজর রেখেছেন আমি কি নিয়ে কাজ করছি। পরে কায়দামতোন সময়ে সেটা সংরক্ষণ থেকে সরিয়ে ফেলেছে। ওই রকম সংরক্ষিত জায়গায় কি বাইরের কেউ গিয়ে এই কাজ করতে পারবে?
রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা বিতর্ক শেষ করতে হলে আমাদের নির্ভর করতে হবে প্রামাণ্য সব দলিলের উপর। এই প্রামাণ্য দলিল মানে কেবল কাগজপত্র নয়। কাগজপত্রের সাথে মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষকারী মানুষের স্মৃতিও প্রামাণ্যেরই অংশ।
কেবল দলিলপত্রে নির্ভর করলে আমাদের ইউনিয়নের শান্তি কমিটিতে নাম থাকা মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী চেয়ারম্যান হয়ে যেতেন ‘রাজাকার’। আমার মায়ের কাছে এই চেয়ারম্যানের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার কথা না শুনলে তাঁকে আমি রাজাকারই ভাবতাম!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)