মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শরণার্থী শিবির গুলোতে গিয়ে গিয়ে মানুষকে গান শুনিয়ে বেড়িয়েছেন একদল শিল্পী। তাদের একটি ট্রাক ভ্যানই হয়ে উঠেছিল গণমানুষকে জাগানোর অস্ত্র। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের সেই দিনগুলোর বিরল ফুটেজগুলো সম্পাদনা করে তারেক মাসুদ নির্মাণ করেছিলেন তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্ম ‘মুক্তির গান’ নামের প্রামাণ্যচিত্র।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে শত শত মানুষ পাড়ি জমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। মুক্তির গানের গান মূলত তাদের নিয়ে।ফুটেজগুলো ধারণ করেছিলেন মার্কিন সাংবাদিক লিয়র লেবিন ও তার দল। কিন্তু এই অমূল্য দলিলগুলোর ফুটেজ আনুমানিক বিশ বছর ধরে অবহেলায় পড়ে ছিল। তারেক মাসুদই প্রথম এই অমূল্য খনির সন্ধান পান এবং এগুলোকে রূপ দেন অসাধারণ এক প্রামাণ্যচিত্র আকারে। মুক্তির গান তাই কেবল গান নয়। এ গান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বয়ান।
সংগ্রহীত সবগুলো ফুটেজ মিলিয়ে দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২০ ঘণ্টা। সেখান থেকে তারেক মাসুদ নির্মাণ করেন ৮০ মিনিটের এই ছবি। মুক্তির গানের শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বিপুল ভট্টাচার্য, দেবব্রত চৌধুরী, স্বপন চৌধুরী, শারমিন মুর্শিদ, নায়লা খান, লুবনা মারিয়াম, লতা চৌধুরী ও দুলাল চন্দ্র শীল। বেণু ছিলেন সেই শিল্পী দলের নেতা। আর ছবির গল্প কথকের ভূমিকায় ছিলেন তারিক আলী।
ফুটেজের বেশ কিছু গানকে তারেক মাসুদ মূল শিল্পীদের দিয়ে আবার ডাবিং করিয়েছিলেন। ব্যবহৃত কয়েকটি গান ছিল ‘পাক পশুদের মারতে হবে’, ‘এই না বাংলাদেশের গান’, ‘কিষান মজুর বাংলার সাথি রে’, ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’, ‘বলো রে বাঙালির জয়’, ‘যশোর খুলনা বগুড়া পাবনা’, ‘বাংলা মা-র দুর্নিবার আমরা তরুণ দল’। এছাড়া ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘দেশে দেশে ভ্রমি’, ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানগুলো।
মুক্তির গান মানুষকে জুগিয়েছিল অফুরান প্রেরণা। গান হয়ে উঠেছিল অস্ত্রের বিকল্প। বিপন্ন সেই সময়ে মুক্তির গানের সেই সাংস্কৃতিক সৈনিকরা হয়ে উঠেছিলেন যুদ্ধের নেপথ্য যোদ্ধা। যুদ্ধকালীন সময়ের মানবিক সংকটও পাশ কাটিয়ে যায়নি তারেক মাসুদের নির্মাণ থেকে। মুক্তির গান তাই মুক্তিযুদ্ধের এক প্রামাণ্য দলিল।