একাত্তরের মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে ময়মনসিংহ চলে গিয়েছিলেন সে সময়কার নবাগত অভিনেত্রী নূতন। যুদ্ধের নয়মাস এখানে ওখানে লুকিয়েছিলেন জীবন আর সম্ভ্রম বাঁচাতে। কত স্মৃতি! দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম ছবি ‘ওরা ১১ জন’-এ হ্নদয়কাড়া অভিনয় করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা শুনি অভিনেত্রী নূতনের মুখে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মনে পড়তেই ভীষণ বিষন্ন হয়ে ওঠেন সোনালী যুগের বড় পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী নূতন। খুব মন খারাপ হয়ে যায় তাঁর। কেননা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিনই ছিল তাঁর কাছে ভীষণ দুঃসহ ও বেদনার। পাক হানাদার আর রাজাকারদের আক্রোশ থেকে জীবন বাঁচানোর তাগিদে প্রিয় মাকে নিয়ে ময়মনসিংহ শহর ছেড়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন অচেনা অজানা ত্রিশালের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।
পাক হানাদারদের ভয়ে কখনও ঝোঁপ-জঙ্গলে লুকিয়েছেন। কখনও গাছে চড়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছেন। কখনও কখনও শুধু ভাতের ফ্যান খেয়েছেন।
যুদ্ধকালে অভিনেত্রী নূতন তখন সবে তরুণী। ফুটফুটে মায়াবী চেহারার এক মেয়ে। তরুণদের চোখে একেবারে রাজকন্যা। ডাগর কালো চোখ আর সাদা মেঘের হাসি ছড়ানো দূরন্ত এক উঠতি তরুণী। নাচ, গান তাঁর ভীষণ পছন্দ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ঢাকায় এসে গুণী অভিনেত্রী সুমিতা দেবীর কলাবাগানের বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন।
‘নূতন প্রভাত’ নামে একটি ছবিতে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে নূতন যেনো সবার কাছে আরও নূতন হয়ে ওঠেন। অনেক পরিচালকই তাঁকে কাস্ট করার জন্য যোগাযোগ করতে থাকেন। নাবগত অভিনেত্রী নূতনও সিনেমা জগত নিয়ে বিস্তর স্বপ্নের এক ঘোরে পড়েন। সুজাতা, কবরী, শাবানা, ববিতার পরেই আকর্ষণীয় চেহারার নূতনের দিকে পরিচালকদের নজর। নূতনও অভিনয়ের নূতন সুবাস ছড়িয়ে চলেছেন।
এরমধ্যে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। সব পরিকল্পনা, স্বপ্ন তাই দ্রুতই তাই এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। একসময় সুমিতাদেবী নূতনকে বলেন, তিনি ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঢাকায় থাকা আর নিরাপদ মনে করছেন না। নূতন খানিকটা দুঃশ্চিন্তায় পড়েন। ময়মনসিংহ শহরে রয়েছে তাঁর মা সহ অন্য বোনোরা। নূতন সিদ্ধান্ত নেন মায়ের কাছে চলে যাবেন। ঢাকা থেকে ঝুঁকি নিয়ে তাই চলে যান ময়মনসিংহ নিজ বাড়িতে। অভিনেত্রী নূতনের মুখ দিয়েই শুনি পরের ঘটনাবলী।
নূতন বলেন, ‘একাত্তরে ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পরই বুঝতে পারি দেশে বড় কিছু হতে যাচ্ছে। আসলে এর আগে অনেককিছুই টের পাই। চলচিত্রে পা রাখার পর জহির রায়হানের মতো দেশপ্রেমিক পরিচালককেও দেখি আন্দোলন সংগ্রাম করতে। চলচ্চিত্রের মানুষগুলো দেশের জন্য রাস্তায় নেমেছে। তাঁরাও আন্দোলন করেছে। ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকসেনারা অতর্কিত নৃশংস হামলা চালালে ভীষণ ভয় পাই। আমি তখন কলাবাগানে সুমিতা দি’র বাসায় থাকি। উনি আমার অভিভাবক। আমার শ্রদ্ধাভাজন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর একদিন সুমিতা দি জানালেন তিনি ভারতে চলে যাবেন। আমি ভারতে যাওয়ার জন্য সাঁই দিলাম না। কেননা মা আমার বাড়িতে থাকে।
আমাদের বাড়ি ময়মনসিংহ শহরের চরপাড়াতে। আমি ময়মনসিং চলে গেলাম। নানান ভয়ভীতি আর ঝুঁকির মধ্যে ময়মনসিংহে থাকতে লাগলাম। চারিদিকে সংশয়। নানান কথামালা। হিন্দু পরিবারগুলো প্রতিদিন ভারতের দিকে ছুটে চলেছে। আমরা বাসাতেই। কিন্তু বারবার ভাবি এই বুঝি কেউ এল, আক্রমণ হলো। একসময় খবর পেলাম পাকবাহিনী আমাদের এলাকাতে আসতে পারে। হামলা করতে পারে। আমার মা তাই সবাইকে নিয়ে খুব চিন্তা করতে লাগলেন।’
সেই সময়ের স্মৃতি মনে করে নূতন আরও বলেন, ‘আমার বাবা ছিল না। অভিভাবকহীন সংসারে আমার মা’ই ছিল সব। নিরাপত্তার কথা ভেবে একদিন মা আমাদের পুরো পরিবার নিয়ে দূরে কোথাও সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ময়মনসিংহের পাশেই ত্রিশাল থানা। আমরা চলে গেলাম ত্রিশালে। ওখানে ভূঁইয়া বাড়ি বলে একটি বাড়িতে আশ্রয় নিলাম । ঐ বাড়িতে ছিল ৭ ভাই আর ১ বোন।
আমরা ওখানেই উনাদের আশ্রয়ে থাকতে লাগলাম। একদিন সত্যি ওখানে পাকসেনা আর রাজাকাররা আসে। সেদিন আমরা সবাই মিলে একটা গাছে আশ্রয় নিই। ঐ বাড়িতে ছিল অনেক গাছ ও জঙ্গল। এই দিনটির কথা আমি ভুলতে পারব না। সেদিন প্রতিটি মানুষকে দেখেছি বাঁচার জন্য যে যেখানে পারছে পালাচ্ছে। সে সময় একটা ঘটনা ঘটেছিল যা আমার স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। একদিন ঐ জনপদে পাকসেনারা ঢুকে। অনেক মা-বোনের ইজ্জ্বত তারা নষ্ট করে। খবর পেলাম পাশেই আপন দুইবোন আত্মহত্যা করেছে শুধু পাকবাহিনীর কাছ থেকে নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য। সেই দুইবোনের খবর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পাতায় আছে কিনা জানিনা।’
নূতন বিষন্ন কণ্ঠে বলেন, মার্চ মাস। আমাদের স্বাধীনতার মাস। এসব ঘটনা মনে পড়লে খুব খারাপ লাগে। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিটি দিনই কষ্ট করতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে কোনো কাজ করার উপায় ছিল না। মানুষ হাটবাজার করতে পারতো না। অর্থসংকট চিল চারিদিকে। কত বেলা যে না খেয়ে থেকেছি তার ঠিক নেই। একবেলা খেয়েছিতো আর একবেলা খেতে পারিনি।’
নূতন জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ট্রেনে চড়ে নূতন আবার ঢাকা এসে সুমিতা দেবীর কলাবাগানের বাসায় ওঠেন। সেদিন অন্যদের সাথে বোরখা পরে রওয়ানা দেন। ১৬ ডিসেম্বর নিজ চোখে দেখেন ঢাকার রাজপথে মানুষের উল্লাস আর পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম পরাজয়।
সবশেষে নূতন বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারিনি। তবে পুরো যুদ্ধ হ্নদয়ে ধারণ করতে পেরেছিলাম নিরন্তর ভালোবাসায়। এ কারণেই বোধ হয় স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম কালজয়ী ‘ওরা ১১ জন’ ছবিতে অভিনয় করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছি। এই ছবি আমার সারাজীবনের গর্ব, আমার উত্তরাধিকারদেরও গর্ব হয়ে থাকবে। আমিও মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত একজন।’