মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় এক অধ্যায়। আর সেই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখো শহীদের নাম। তাদেরতে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন প্রবাসী অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান।
এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘ছবিটি চিরকালই আমার দৃষ্টি কেড়েছে। মাথায় আফগানী টুপি, বক্ষপটের ওপর আড়াআড়িভাবে কার্তুজের বন্ধনী, যার প্রান্তসীমায় খাপে ভরা পিস্তল, পুরো সাদা পোশাকে কোমরে দু’হাত দিয়ে মুখে একটা বেপরোয়া হাসিতে উদ্ভাসিত এক কিশোর-তরুণ। ছবিটি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমীর, যার জন্মদিন গেল গতকাল ২৯শে মার্চ।
আমার মনে হয় এক সময়ের মানুষের মুখে মুখে ফেরা, প্রতি ঘরে ঘরে উচ্চারিত, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ভারী আদরের সন্তান শহীদ রুমী নামের মানুষটির জন্মদিনটি কেমন যেন বড় নি:শব্দে চলে গেল। বেঁচে থাকলে গতকাল রুমীর বয়স ৬৭ হতো।
না, সমসাময়িক হওয়া সত্ত্বেও রুমীর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। চাক্ষুষ দেখা হয়েছে কয়েকবার। আমরা ভিন্ন বলয়ের মানুষ ছিলাম। দুটো বলয়েই কিছু অভিন্ন বিন্দু ছিল বন্ধুরূপে, কিন্তু তা আমাদের চলাফেরার বলয় দুটোকে কাছে নিয়ে আসেনি। তাই আমার কাছে শহীদ রুমী একজন স্বপ্নের মানুষই রয়ে গেছে।
কিন্তু আমার আরো কত বন্ধু, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়েছে, তারাতো আমার কাছে স্বপ্নের মানুষ ছিল না। তাদের সঙ্গে প্রায়শই দেখা হতো, আড্ডা মারতাম, উত্তপ্ত তর্ক করতাম ১৯৬৯ আর ৭০এ – কলাভবনের বারান্দায়, পাঠাগারের চাতালে, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সবুজ মাঠে।
কখনও মনে হয়নি এরা একদিন একটা অসাধারণ কাজ করে ফেলবে – আত্মপ্রকাশ করবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, প্রাণ দেবে দেশের জন্য, ছিনিয়ে আনবে স্বাধীনতার লাল সূর্য। কখনও ভাবিনি এরা সময়ের একটা বিন্দুতে দাঁড়িয়ে অমরত্ব লাভ করবে – সময় তার থাবা বসাতে পারবে না এদের ওপর, জরা এদের ছুঁতে পারবে না, বার্ধক্য পরাজয় মানবে এদের কাছে। এদের কর্মকাণ্ড আমাদের মতো মানুষদের পরিণত করবে অতি সাধারণে।
মনে পড়ছে শহীদ নিজামুদ্দীন আহমেদের কথা, যাকে আমরা আজাদ নামেই ডাকতাম। সম্ভবত: প্রয়াত বাল্যবন্ধু মাসুদ আহমেদ মাসুদই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ছাত্র ইউনিয়নের উঁচুদিকের নেতাই ছিল আজাদ। ওর বাবা রাষ্ট্রদূত কামরুদ্দীন আহমেদের পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক ইতিহাস নামক প্রামান্য গ্রন্থটি আমার খুব প্রিয় ছিল। পরিচয়ের প্রথম পর্বেই বোধ হয় বলেছিলাম, আজাদ শুধু হেসেছিল- মনে আছে।
সলিমুল্লাহ হলের অনাবাসিক ছাত্র ছিল সে। দলের সাংগঠনিক কাজের কারণে সন্ধ্যার পরে অনেক সময়ে তাকে পাওয়া যেত হলে। প্রায়শই সে চলে আসত আমাদের ৩৩ নম্বর ঘরে- যতটা না আমার সহকক্ষবাসী কমরেড তাজুল ইসলামের সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন বিষয়ে আলোচনা করতে, তার চেয়ে অনেক বেশি আমার কাছে রুশ সাহিত্যের গল্প শুনতে।
জানি না, কেমন করে সে যেন টের পেয়েছিল যে প্রগতি প্রকাশনীর কল্যাণে রুশ সাহিত্যের বেশ কিছু ধ্রুপদী গ্রন্থ আমার পড়া। টলস্টয়, গোর্কি, চেকভ, তুর্গেনিভ, দস্তয়েভস্কির বহু লেখা বা গল্প আজাদকে আমি মুখে মুখে শুনিয়েছি। আমার বিছানায় সে শুয়ে থাকত আর আমি আমার পড়ার টেবিলের চেয়ারে বসে কথা বলে যেতাম। কখনও কখনও তাকিয়ে দেখতাম, আমার কথা শুনতে শুনতে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। বুঝতে পারতাম সারাদিনের দলের কাজ আর ছোটাছুটির কারণে ক্লান্তি ভর করেছে তার শরীরে। ছোট শিশুর মতো তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হতো।
কখনো সখনো গল্প করতে করতে রাত বাড়ত। তখন বাড়ি ফিরে খাবার বদলে আমাদের সঙ্গেই ছাত্রাবাসের খাবার ঘরেই খেয়ে নিত আজাদ। মাসুদও আসত মাঝে মাঝে- যোগ দিত নানান আলোচনায়। তার পড়াশোনার ব্যপ্তি ছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। মনে আছে এমিল জোলার ‘জার্মিনাল’ উপন্যাসটি সেই প্রথম পড়তে দিয়েছিল আমাকে- ‘এঁতিয়ে’ চরিত্রটি আমাকে মুগ্ধ করেছিল।
সবশেষে সেলিম জাহান লিখেছেন, আড্ডা কখনও কখনও গভীর রাত পর্যন্ত চলত। অনেক রাতে চায়ের জন্য প্রবল তৃষ্ণা বোধ করতাম আমরা। আমরা মানে আজাদ, মাসুদ, তাজুল ভাই ও আমি। গ্লাসে গরম চা নিয়ে বসতাম পলাশী ব্যারাকের ছক্কু মিয়ার দোকানে। আলোচনা একটি সরল রেখায় চলত না, সে তার নিজস্ব মেজাজমর্জির ওপরে ভর করে এগোতো। কি না ছিল সে কথা-বার্তায় – বিশ্ব সমস্যা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র – আরো কত কি! একসময়ে ছক্কু মিয়া দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করার জন্য তাড়া দিত। আমাদের উঠতে হতো। গভীর রাতের বিরল যানের সড়কে একটি রিক্সা জোগাড় করে আজাদ চলে যেত ধানমন্ডির দিকে আর তাজুল ভাই এবং আমি রাস্তা পেরিয়ে ফিরে আসতাম আমাদের ডেরায়।
না, আজ শহীদ আজাদের জন্মদিন নয়। কিন্তু গতকাল তো শহীদ রুমীর জন্মদিন ছিল। সে কথাটা মনে হতেই বহুদিন পরে শহীদ আজাদের কথা মনে পড়ল। নাই বা থাকল শহীদ রুমীর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়, কিন্তু আজ সে ই তো আমাকে নিয়ে গেল আমার বন্ধু শহীদ নিজামুদ্দীন আহমেদ আজাদের স্মৃতির কাছে। আসলে মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদেরাই আমাদের পরম চেনা- হৃদয়ে, বোধে আর চেতনায়। সেখানে সব রকম বিভাজন যে লুপ্ত হয়ে যায়।’