চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মুক্তা ভাই, আর দেখা হবে না

চারদিকে চলছে সবকিছু গোটানোর আয়োজন। একে একে সাঙ্গ হচ্ছে একেকটি জীবনকাব্য। মৃত্যুর মতো সহজ সত্য প্রতিদিন শেখাচ্ছে আরও সহজিকরণ সূত্র। নিঃশব্দে প্রিয় বন্ধু, স্বজন আর কাছের মানুষেরা বলে যাচ্ছেন ‘আসি। আর তাহলে দেখা হচ্ছে না।’

জাকারিয়া মুক্তা ভাই চলে গেলেন। সাংবাদিক মুক্তা ভাই। অনেকদিন অসুস্থ থাকার পর শনিবার সন্ধ্যায় ফেসবুকের খবর হলেন তিনি আর নেই। তারুণ্য আর হাসিমাখা মুখটা রেখে গেলেন।

জাকারিয়া মুক্তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটি ছিল নিশুতি সংবাদ শ্রমিকের। রাতে শুরু হতো কাজ। রাত ঘন হতো কাজের মগ্নতা আর দৌড়ঝাঁপ বাড়তো। আমি হাজীপাড়ার খোলাকাগজ থেকে বহুপথ মাড়িয়ে নয়াপল্টন মসজিদ গলিতে দৈনিক সবুজ দেশ এ যেতাম। রাত তখন নিজেই আমাদের সঙ্গে দৌড়ায়। ফরম্যাটেড সংবাদের ট্রেসিং বের করে যেতাম পেস্টিং এ। আমাদের হাত ছিল শ্রমিকের হাত। সংবাদকে মনে হতো কাঁচামাল মাত্র। খাওয়ার মতো খবর হাতে নিয়ে মচমচে একটি শিরোনাম যুক্ত করে টেনেটুনে মেকাপ দিতাম। তখন সংবাদপত্র ছিল বানানোর জিনিস।

মুক্তা ভাইকে দেখতাম, ‘মোর দ্যান আ জার্নালিস্ট’ হিসেবে। সংবাদপত্রের এত কাজ কোনো সাংবাদিকের হতে পারে না। ট্রেসিং-কাগজ কেনা থেকে শুরু করে প্রেসের কালির গন্ধ মেখে বিট পিওনকে বিতরণের হিসাব বুঝিয়ে দেয়া পর্যন্ত। তাতেও শেষ হতো না। কাজ কখনও শেষ হতো না। নির্লিপ্ত পকেটের শূন্যতা তুচ্ছ করে ভূতেই যোগাতো কাপের পর কাপ চা আর সিগারেট।

কম্পিউটারের যুগ তারপরও অক্ষর গুনে সংবাদের শিরোনাম বানানোর রেওয়াজ মেনে চলতেন মুক্তা ভাই। নিজ হাতে করতেন মেকাপ ডিজাইন সব। সংবাদের ঘাটতি হলে রাত গভীরে সংবাদ পর্দায়ও করতে হতো। এডিটরিয়াল পোস্ট এডিটরিয়াল থেকে শুরু করে নানান বিভাগীয় পাতার আইটেমগুলো রাখতে হতো এক মাথায়। একই কাজ করতে হতো আমাকেও। মুক্তা ভাইকে আরো যেটি করতে হতো তা হলো, প্রেস মালিকের বাণিজ্যিক শর্তের আরো আট দশটি পত্রিকার সব আইটেম ভিন্ন শিরোনামে ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি করা। আমার কাজে তিনি ছিলেন বেশ এক প্রেরণা।

মুক্তা ভাইকে দেখেই মনে হতো, পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে। একটি শ্রেণিকে রাতে দেখা যায় আরেকটি শ্রেণিকে দেখা যায় দিনে। দিবাভাগে কোনোদিন কোথাও মুক্তা ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হতো না।

বলছি ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সময়ের কথা। তার বছর দশেক পরে বইমেলায় এক সন্ধ্যায় মুক্তা ভাইকে দেখলাম ভূত দেখার মতো। রাতের সেই বিষণ্ণ ফ্যাকাশে চেহারা পাল্টে গেছে। সঙ্গে তার সহধর্মিণী। বোঝা গেল সবকিছুতে এসে গেছে ছন্দ, হালের আর পাঁচজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকের মতো। এখন তার সাংবাদিকতাও চাকচিক্যময় সময় বাঁধা সুখের। কিন্তু সেই ঝড়ো গতি আর রাতের অস্বাভাবিক উন্মাদনা যেন মিলিয়ে গেছে কোথায়! সবকিছুকে হজম করে যাওয়ার সেই ন্যুজ স্বভাবটাও নেই। সময়ই ভেতর থেকে বের করে এনেছে আসল জাকারিয়া মুক্তাকে।

তারপর দুয়েকদিন দেখা হয়েছে কি হয়নি। ফোনে কথা হয়েছে। ফেসবুকে সাড়াও পাওয়া গেছে দুয়েকবার। কিন্তু আমার কাছে তিনি থেকে গেছেন রাত বিহারের সেই শ্রমিক সাংবাদিক। অনেক কিছুই করতেন ভেতরে ভেতরে। ছিলেন দক্ষ সংগঠকও। আমি বার বার ভুলেই যেতাম মুক্তা ভাই এখন বসে আছেন গতিশীল গণমাধ্যমের চঞ্চল ও রঙিন সংবাদকক্ষে, কাজে ও শ্রান্তিতে। শেষতক কাজ করতেন সময় টিভিতে বার্তা সম্পাদক হিসেবে। বুঝেই নিয়েছি আজকের ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠও জানতে বাকি ছিল না তার।

মুক্তা ভাই চলে গেছেন। আর কখনো কোনো রাতে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এখন বলাই যায়, এই তো জীবন, এই জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে, সচল রাখতে এতবেশি কষ্ট না করলে কি হতো না! অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে, সহজে, কম দায়িত্ব নিয়েও তো কাটিয়ে দেয়া যায় মাত্র এই ক’টা দিন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)