১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি লে. সেলিমসহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি অগ্রবর্তী দল অবরুদ্ধ মিরপুরে অ্যামবুশের শিকার হয়ে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সামরিক ইতিহাসে এ ঘটনা একটি বেদনাবহ দ্রষ্টব্য হয়ে আছে। এছাড়া ৩০ জানুয়ারী’৭২ এ মিরপুর থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যান স্বনামধন্য চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, পুলিশের এসপি জিয়াউল হক খান লোদিসহ প্রায় শতাধিক মানুষ।
মুক্ত মিরপুরে যদিও আজ আর তাদের দৃশ্যমান কোনো অস্তিত্ব নেই! একান্ত ব্যক্তিগত বোধের তাড়নায় কেউ কেউ হয়তো এ দিনটি এলে শুধু নিরবে চোখের অশ্রু ফেলেন।
বেদনাবহ এ দিনটি প্রসঙ্গে লে. সেলিম এর ছোট ভাই ডা. এম এ হাসান লিখেছেন, ‘এই মিরপুরের বধ্যভূমির সাথে আমার একটি গভীর আবেগের সম্পর্ক রয়েছে। স্বাধীনতার ৪৬ দিন পর অবরুদ্ধ মিরপুর মুক্ত করতে গিয়েই শহীদ হয়েছে আমার ভাই শহীদ লে. সেলিম। এই মিরপুরের প্রতিটি ধূলিকনায় মিশে আছে আমার ভাইয়ের রক্ত। ওখানকার প্রতিটি ধূলিকনাই আমার জন্য রক্তসিক্ত বাংলাদেশ। যুদ্ধের ৯ মাস লালপুর, তেলিয়াপাড়া, হরষপুর, মুকুন্দপুর, ফেনী, ফুলগাজী, বেলোনিয়া, আখাউড়া ইত্যাদি যুদ্ধে শত্রুর যে বুলেট কানের কাছে শিস দিয়েও বুক ছোঁয়নি, সেই বুলেটটাই বির্দীর্ণ করলো সেলিমের বুক ৩০ জানুয়ারী,’৭২-এ’। (সূত্র: যুদ্ধাপরাধীর তালিকা ও বিচার প্রসঙ্গ)
ফিরে দেখা: ২৯ জানুয়ারি ১৯৭২
স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স ৪৫ দিন। কিন্তু রাজধানী-ঢাকার হৃদপিন্ডে―‘মিরপুর’ তখনও ‘পাকিস্তান’! ইন্ডিয়ান আর্মির ‘১০ বিহার রেজিমেন্ট’ মিরপুর ঘিরে রেখেছিল কিন্তু আক্রমণে যায়নি। পলাতক-পাকিস্তানি সেনা আর বিহারি-ঘাতকদের গড়া ‘মিনি-ক্যান্টনমেন্ট’ মিরপুর তখন এতোটাই দুর্ভেদ্য যে―শহীদুল হক মামা, বাবর, হানিফ ও তৈয়বুর গ্রপের নেতৃত্বে স্থানীয় বিএলএফের মুক্তিযোদ্ধারা বারবার আক্রমণে যেয়েও শেষ পর্যন্ত পেরে উঠেননি। পলাতক-পাকিস্তানি সেনাদের নেতৃত্ব ও পেশাদারি দক্ষতায়―অবরুদ্ধ-মিরপুর পুরোটাই তখন ‘বুবি-ট্রাপ’। মিরপুরের সর্বত্র―ওৎ পেতে ছিল ‘মৃত্যু’!
২৯ জানুয়ারি দুপুরের দিকে মিরপুর মাজারের কাছে পজিশনে থাকা তৈয়বুর গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা ‘রফিক’ পাকিস্তানি স্নাইপারের গুলিতে ‘স্পট ডেড’ হলে মিরপুরের নেতৃস্থানীয়রা শহীদ রফিকের মৃতদেহ নিয়ে মিছিল নিয়ে দেখা করে বন্ধবন্ধু’র সাথে। এরপর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে, জেনারেল ওসমানীর অধিনায়কত্বে, কর্নেল কে এম শফিউল্লাহর তত্বাবধানে, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন গাফফার ও পুলিশের এসপি জিয়াউল হক লোদীর নেতৃত্বে―শুরু হয় ‘মিরপুর’কে শত্রুমুক্ত করার সেনা-পুলিশ যৌথ অভিযান।
১৬ ডিসেম্বরের পর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির প্রথম ‘গার্ড-কমান্ডার’ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সেলিম কামরুল হাসান বঙ্গভবনের দায়িত্বে ছিলেন। মিরপুরে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের সাথে লে. সেলিমকেও মিরপুর অভিযানে শরিক হতে নির্দেশ দেয়া হয়। যদিও ২৭ জানুয়ারী কোরবানীর ঈদটা তিনি তাঁর মা’র সাথে বরিশালে উদযাপন করে এসেছিলেন। ২৯ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁচ্ছেই ৩০ জানুয়ারি সকালে লে. সেলিম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে রওনা হন অবরুদ্ধ মিরপুরে। সকাল এগারোটায় মিরপুর ১২ নাম্বার সেকশনের কাছাকাছি পৌঁচ্ছাতেই তাঁর অগ্রবর্তী দলটি এ্যামবুশের মুখে পড়ে। এ সময় চতুর্দিকের প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদ-জানালা-ঘর থেকে অতর্কিতে তাদের ওপর স্বয়ংক্রিয় মারণাস্ত্র দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ও গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। আক্রমন-প্রতিআক্রমনের প্রথম পালায় নিহত হন সুবেদার মোমেন, নায়েক তাজুলসহ প্রায় ৪১ জন সেনা সদস্য। বাকিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে এবং কেউ কেউ জীবন বাচাঁতে বন্ধুর পথ ধরে পিঁছু হটেন। মাটি কামড়ে পড়ে থাকা লে. সেলিমই জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে তুলে নেন যুদ্ধ-পরিচালনার তাৎক্ষণিক দায়-ভার। মারাত্মক আহত হয়ে তিনি কখনও সম্মুখযুদ্ধ কখনও চোরাগুপ্তা হামলা মোকাবেলা করে সামনে এগুতে থাকেন। প্রতিরোধের এক পর্যায়ে তিনি বুকে গুলিবিদ্ধ হন। রক্তক্ষরণ উপেক্ষা করে গায়ের শার্ট খুলে বুকের ক্ষতস্থান বেঁধে সে অবস্থাতেই লড়তে থাকেন দিনভর। কখনও এগিয়ে, কখনবাও পিছিয়ে, কখনও আক্রমণ, কখনও আক্রমণের জবাব দিয়ে লড়াই চালিয়ে যান সহযোদ্ধাদের নিয়ে। অপলক প্রতিটি মূহুর্ত সতর্ক থেকে সহযোদ্ধাদের আশ্বস্তও করেন-গায়ে একবিন্দু রক্ত থাকতে কাউকে তিনি ফেলে যাবেন না!
এভাবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে একটু একটু করে নিস্তেজ বিবর্ণ হতে থাকেন লে. সেলিম। বিকেলের দিকে মিরপুর কালাপানির ঢালে সহযোদ্ধাদের তিনি শেষ নির্দেশ দেন ঘাতকদের দিকে লাগাতার গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের দিকে সবাইকে সরে যেতে। এর জন্য তিনি নিজেই কাভার-ফায়ারের দায়িত্ব নেন। সহযোদ্ধারা নিরাপদে সরে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি একাই কাভার-ফায়ারের দায়িত্ব পালন করলেন শরীরের সব শক্তি নিঃশেষ করে।
এরপর বিকেল গড়িয়ে রাত হলো। মিরপুর ১২ নং সিরামিকের ঝোঁপে, শীতের কুয়াশা ভেজা নরম মাটিতে, চাপ চাপ রক্তের মধ্যে পড়ে থাকা নিঃসঙ্গ সেলিম তখন কখনও চেতন, কখনও অচেতন। আকাশ থেকে তখন ছড়িয়ে পড়ছিল পূর্ণিমার চাঁদের অপরূপ আলোর দ্রুতি! আলোকের সেই ঝর্ণাধারাকে সঙ্গী করে লে. সেলিম পৌঁচ্ছালেন না ফেরার দেশে― সে রাতেরই কোনো এক সময়ে।
যশোরের অভয়নগরে জন্ম নেয়া ভয়ডরহীন ‘সেলিম’ শৈশবেই ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। তারুণ্যে আপসহীন ছাত্রনেতা ও কৃতি অ্যাথলেট। যৌবনে অসমসাহসী মুক্তিযোদ্ধা। ‘ভাই’ লেফটেন্যান্ট আনিস (ডা. এম এ হাসান) আর এক প্লাটুন পুলিশ নিয়ে, একাত্তরের ২৫ মার্চেই প্রথম ‘প্রতিরোধ’ গড়েছিলেন ঢাকার তেজগাঁওয়ে! এরপর ফ্রন্টে ফ্রন্টে কতো না ‘যুদ্ধ’ বীর বিক্রমে! লালপুর, তেলিয়াপাড়া, হরষপুর, মুকুন্দপুর, ফেনী, বেলোনিয়া আর আখাউড়ায় সেলিম যেনো আজও এক জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে আছেন! পাকিস্তানের জন্য ‘ত্রাস’ হয়ে ওঠায়, এই দুই ভাইকে নিয়ে এবিসি টেলিভিশন ডকুমেন্টারি পর্যন্ত তৈরি করে!
‘ব্রাভো’ কোম্পানির কমান্ডার, যুদ্ধজয়ী ‘সেলিম’কে―একাত্তরের অবরুদ্ধ-মিরপুর দাঁড় করিয়ে দেয় জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ক্রমাগত রক্তক্ষরণে আচ্ছন্ন হয়েও চেতনা যখন ফিরেছে তাঁর, ভেবেছেন―‘রিইনফোর্সমেন্ট’ আসবে, উদ্ধার হবেন। আবারও ব্যর্থ হবে মৃত্যু, পরাস্ত হবে শত্রু। হ্যাঁ, ৩১ জানুয়ারির সকালে ‘রিইনফোর্সমেন্ট’ এসেছে ঠিকই, পরাস্ত হয়েছে শত্রুও, মুক্ত হয়েছে মিরপুর―কিন্তু তা লে. সেলিমের শেষ রক্তবিন্দুটুকুরও বিনিময়েই!
অবরুদ্ধ ‘মিরপুর’কে মুক্ত করতে―আমাদের পুলিশ ও সেনাসদস্য প্রাণ দিয়েছেন ১২২ জন। কিন্তু সরকারি খাতায় নাম নেই কারও! নেই স্মারক-স্তম্ভ-ভাষ্কর্য, নেই যুদ্ধের স্বীকৃতি! হ্যাঁ, ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবখানা দিয়েই দায় সেরেছে মুক্তিযুদ্ধের ‘বাংলাদেশ’!