চট্টগ্রামের আপোষ আর সমঝোতার রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ প্রায় ২৮ বছর চট্টগ্রামেরই জামাত শিবিরের ‘মিনি ক্যান্টনমেন্ট’ চট্টগ্রাম কলেজ আর মুহসিন কলেজে ‘জয়বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান দিয়ে শিবিরকে উৎখাত করেছিলেন একজন নুরুল আজিম রনি।
যে কাজটি নানান কারণে কিংবা অকারণে কিংবা ‘কৌশলী রাজনীতি’র কারণে কোনদিনই করার দুঃসাহস দেখাতে পারেননি রনির নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং আজম নাসির, সেই কাজটিই করে বসলেন রনি। ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শাহদাতকে জবাই করে হত্যার মধ্য দিয়ে যে চট্টগ্রাম কলেজে স্বাধীনতা বিরোধী জামাত শিবিরের ক্যান্টনমেন্ট আর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি গড়ে তোলা হয়েছে, দিনের পর পর নানা সরকার ক্ষমতায় এসে এবং গিয়েও যেখানে ছাত্রদল কিংবা ছাত্রলীগ পা ফেলতে পারেনি, সেখানে কিভাবে সম্ভব এটা ! একজন সাবেক ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হিসেবে এবং একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে আমি খোঁজ খবর নিতে শুরু করলাম এবং বিম্ময়ে অবাকও হলাম।
মাত্র তিন বছর আগে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়া, মুরাদপুরের মধ্যবিত্ত পরিবারের এক সন্তান এবং ওমরগনি এমইএস কলেজের একজন ছাত্র নুরুল আজিম রনি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে আমিতো অবাক । এওকি সম্ভব যে, যার দল ক্ষমতায়, সেই ছাত্র সংগঠনের একজন নেতা চাঁদাবাজ নন, সন্ত্রাসী নন কিংবা ধর্ষকও নন। শুধুই ছাত্রনেতা ! এবং তার বিরুদ্ধে তেমন কোন অভিযোগও নেই ! না, প্রথমে বিশ্বাস হয়নি আমার। খোঁজ নিতে শুরু করলাম আরো, কথা বললাম আরো অনেকের সাথে,মূলত: প্রায় সবাই সংবাদকর্মী, যারা সচরাচর মানুষের ভুলই খুঁজে বেড়ায় !
কিন্তু রনি সম্পর্কে জেনে এবং শুনে আমি সত্যিই এই ছেলেটির ভক্ত হয়ে গেছি আমি। মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর দায়িত্ব রনি ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল নগরীর কাজেম আলী স্কুলে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ আন্দোলনে রাজনীতির নানা হিসাবের ফাঁদে পড়ে সফল না হলেও রাতের বাইরে চলা ছাত্ররাজনীতি নতুন করে পথ দেখিয়েছেন।
লালদীঘির খেলার মাঠ দখলের প্রতিবাদ, গণ পরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া করার দাবি (২ সেপ্টেম্বর ২০১৫), সড়ক দুর্ঘটনা রুখতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে ফুটওভার ব্রিজ ও ট্রাফিক পুলিশ রাখাসহ (১৪ জুন ২০১৫) অতিরিক্ত ফি বিরোধী আন্দোলন ( ১৪ই নভেম্বর ২০১৫) ও তিন দশক পর চট্টগ্রাম ও মহসিন কলেজে প্রগতিশীল সংগঠনের পতাকা উড়ানো থেকে শুরু করে, এমন কোনো আন্দোলন ছিলনা এ নুরুল আজিম রনি করেননি। যে ছেলে সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ২৮ বছর পর চট্টগ্রাম কলেজে, মুহসিন কলেজে বঙ্গবন্ধুর ছবি উত্তোলন করে,সেই ছেলেকে স্যালুট না দিয়ে কি পারা যায় !
যে ছেলে ছাত্রলীগের নেতিবাচক হাজারো সংবাদের ভীড়ে ইতিবাচক সংবাদের নির্মাতা হয়,তাকেতো শ্রদ্ধা জানাতেই হয়। আমি বিপন্ন বিস্ময়ে আরো বেশি মুগ্ধ হয়েছি, এই কারণে যে, যে শহর চট্টগ্রামে বরাবই আওয়ামীলীগ নেতা জামাত শিবির তোষনের রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকেন সবসময়,সেই শহরে জামাত-শিবিরের সাথে আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতাদের দহরম মহরম, আর রাতের রাজনীতি, আঁতাতের রাজনীতি ‘পাবলিক ইস্যু’ সেখানে একজন নুরুল আজিম রনি যখন জামাতের বুকে হাত দিয়ে বসে,তখন জামাত বান্ধব আওয়ামীলীগ নেতারা কেনোইবা তা মেনে নিবেন ! হয়েছেও তাই।
দেশব্যাপি একতরফা ইউপি নির্বাচনে একজন রনি হাটহাজারিতে গিয়ে কোন আত্মীয়ের প্রচারণায় ‘গুন্ডামি’ করেছেন আর তাকে অস্ত্র সহ পুলিশ টেনে হেঁচড়ে গ্রেফতার করেছে,বিষয়টি আসলে তা নয়। হাটহাজারি বিপ্লবী হওয়া আইনশৃংখলা বাহিনী সারাদেশে কি ভূমিকা পালন করেছে তাও দেখেছে সবাই। সুতরাং রাজনীতির হিসেবটা অত সরল নয় এখানে। যেদিন রনিরা চট্টগ্রাম কলেজ আর মুহসিন কলেজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে,সেদিন থেকেই জীবনের ঝুঁকিতে রনি। নিজেদের সবচে বিশ্বস্ত, শেকড় এবং নির্ভরতার ঠিকানা হারানো জামায়াত তাকে ছাড়বেনা এটাই স্বাভাবিক।
আমিতো ভাবছিলাম, যেকোনদিন ছেলেটার মৃত্যুর সংবাদ পাবো। কিন্তু হায়, সেই রনিতে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হলো, যখন সশস্ত্র ছাত্রলীগ সারাদেশেই বেপরোয়া এবং উশৃংখল আচরণের জন্য সমালোচিত হয়েছে গত কয়েকবছরে বারবার, কিন্তু আইনশৃংখলাবাহিনী নড়েচড়েনি। আমি তবুও খুশি রনি গ্রেফতার হয়েছে,ওকে অন্ততঃ ক্রসফায়ার দেয়া হয়নি। চট্টগ্রামের সাংবাদিকরা বলছেন, তারা ধারণা করেছিলেন, প্রশাসনের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা জামাত আর আওয়ামীলীগের নৌকায় পাড়ি দেয়া জামাত লীগ এবং চট্টগ্রামের জামাতবান্ধব বিশেষ ভবনের বসরা মিলে রনিকে ‘ক্রসফায়ার’ই দিবেন।
তবুও সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে, রনি এখনো বেঁচে আছে। চট্টগ্রামে যারা আমরা ছিলাম, সাংবাদিকতা করতাম এবং চট্টগ্রামের রাজনীতির খোঁজ খবর রাখি, তারা জানি, এই শহরে কিভাবে প্রতিটি স্তরে স্তরে জামাতের এজেন্টরা আছে। সেটা প্রশাসনে যেমন, তেমনি আওয়ামীলীগ আর বিএনপিতেও, ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিক সংগঠনেও। এরা নানানভাবে শেষাবধি জামাতের পৃষ্ঠপোষক হিসেবেই ভূমিকা রাখেন।
চট্টগ্রামের সাংবাদিক হোসেন তৌফিক ইফতেখার লিখেছেন, ‘ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারি বললেই মনের গহীনে প্রথম ধাক্কায় যে প্রতিমূর্তি ভেসে ওঠে — সেটা চাঁদাবাজের। নুরুল আজিম রনি ওই জায়গায় ব্যতিক্রম, নগর ছাত্রলীগের এই সাধারণ সম্পাদককে দেখলে অমনটি ভাবা কঠিনই। অন্য কিছু বাদ থাকুক, খানিকটা বিস্ময় নিয়ে আমি এই প্রথম দেখলাম, নগর ছাত্রলীগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কেউ চাঁদাবাজি-ভূমি দখল কিংবা টেন্ডারবাজিতে নয় — ফেসবুকেই সর্বক্ষণ সক্রিয়, দলের পক্ষে তর্ক-বিতর্কে।
গত শনিবার হাটহাজারী থানার পুলিশ আর ম্যাজিস্ট্রেট হারুনুর রশিদের ভ্রাম্যমাণ আদালত মারফত আমরা জানলাম, এই রনি আটক হয়েছেন গুলিসহ একটি পিস্তল নিয়ে। আটক হতেই পারে, অবৈধ অস্ত্রও পাওয়া যেতেই পারে – রনি তো আর নিশ্চয়ই ধোঁয়া তুলসীপাতা নয়। কিন্তু, কেন যেন মনে হচ্ছে নেপথ্যে কিছু কিন্তু আছেই। পুলিশ-বিজিবি যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ছিঁচকে চোরের মতো টেনেহিঁচড়ে তাকে হাজতে পুরেছে, সেটা ছিল চোখে পড়ার মতো। ভ্রাম্যমাণ আদালত যে ক্ষিপ্রতায় গ্রেপ্তারের ঠিক পরপরই তাকে দণ্ডিত করেছেন দুই বছরের কারাবাস দিয়ে, সেটাও অস্বাভাবিক ঠেকেছে অনেকের কাছেই।
সরকার-প্রশাসন আর নির্বাচন কমিশনের সৌজন্যে পুরোপুরি একতরফা ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মানেই যেখানে বিজয়ী, সেখানে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কেউ যুদ্ধংদেহী অবস্থান নেবে — এর কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ খুঁজে পাই না। রনির পক্ষে যারা তারা তো বটেই, প্রতিপক্ষ যারা তাদেরও কেউ কেউ আকস্মিক এই ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করছেন। নেপথ্যে আছে নাকি কোনো চেনা মাফিয়ার হাত, স্বার্থের দ্বন্দ্ব কিংবা নারায়ণগঞ্জ কায়দায় নগদ টাকায় কেনাবেচার খেলা? নাকি সরকারেরই প্রশ্রয়ে প্রায় ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব হয়ে ওঠা পুলিশ আর প্রশাসন এবার নিজেই নিজের পথ চলতে চাইছে? জবাব হয়তো মিলবে সামনে! ’
শুধু আমি নই চট্টগ্রামের রাজনীতির হাড়ির খবর যারা রাখেন তারা সবাই বুঝে গেছেন,রনির অপরাধটা আসলে কোথায় ? চট্টগ্রাম কলেজ এবং মুহসিন কলেজকে জামাত-শিবির মুক্ত করে নিজ দলেরই কিছু সিনিয়র নেতার যুগের পর যুগ ধরে করে আসা,আপোষ আর সমঝোতার রাজনীতির সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়াটাই অপরাধ হয়েছে রনির।
এই অপরাধের কি আর ক্ষমা মিলে !! তো রনিরাতো বলি হবেনই। তবে এটা সম্ভবত: চট্টগ্রামের রাজনীতিতে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠলো। রনিদের নেতৃত্বে বৃত্তভাঙ্গার রাজনীতি নাকি সিনিয়দের আপোষ আর সমঝোতার রাজনীতি, কোনটা টিকে থাকবে,এরই যেনো প্রমাণ মিলবে এবার।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)