চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মা সবসময় বলতেন, তুমি বিসিএসে প্রথম হবে: সাকলায়েন

গোলাম সাকলায়েন শিথিল। ৩০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন তিনি। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মোক্তারপুর গ্রামের পদ্মার পাড়ে জন্ম। তার স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়া পর্যন্ত যে গ্রামে পৌঁছেনি বিদ্যুতের অালো। শৈশব আর দুরন্ত কৈশরটা কেটেছে সেখানেই। বর্তমানে তিনি কর্মরত অাছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সিনিয়র সহকারি পুলিশ কমিশনার হিসেবে।

চ্যানেল আই অনলাইনকে দেয়া একান্ত এক সাক্ষাতকারে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন তার সফলতার পেছনের গল্প। সেই সাফল্যে অনুপ্রেরণা দিয়ে যারা অবদান রেখেছেন; জানিয়েছেন তাদের কথাও।

অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়া সাকলায়েন ২০০১ সালে সারদা গভ. পাইলট একাডেমি হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ৪.৬৩ নিয়ে এসএসসি পাশ করেন। ফলাফল ভাল হওয়ায় দুরদুরান্ত থেকে সেসময় মানুষ এসেছিলেন সাকলায়েনকে দেখতে।

এসএসসি পাশের পর উচ্চমাধ্যমিকে রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হওয়াটাকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত মনে করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সাকলায়েনের সেসময়টা ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বাবার মেরুদণ্ডের সমস্যা থাকায় চিকিৎসার পেছনে খরচ হত অনেক অর্থ। এমনকি সাকলায়েনকে সেসময় রাজশাহী শহরের মেসে রেখে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে চারঘাট থেকে রাজশাহীতে কলেজ করে আবার বাড়িতে ফিরে যেতে হত।

বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। এলাকায় ছিল না কোন প্রাইভেট পড়ার প্রচলন। উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাসটা অনেক বড় হওয়াতে বুঝতে পারছিলেন না কিছুই। বিশেষ করে গণিতটা দুর্বোধ্য হয়ে উঠছিল প্রতিনিয়তই। সমাধানের কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এরই মাঝে তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে নজরুল স্যার। জীবনের প্রথম প্রাইভেট পড়া নজরুল স্যারের কাছেই। সারদা কলেজের এ শিক্ষক পরীক্ষার অাগে ১ মাস অংক শিখেছিলেন সকলায়েনকে। তাই স্যারের অবদানটা কোনভাবেই ভুলতে পারেন না এই কর্মকর্তা।

রাজশাহীতে কোন আত্মীয় না থাকায় এইচএসসি পরীক্ষাও দিয়েছেন বাড়ি থেকে রাজশাহীতে যেয়ে। এত সংগ্রামের মাঝে পরীক্ষা দেয়ায় ফলাফলটা খারাপ হয় সাকলায়েনের। এইচএসসিতে পান ৩.৮০। এ নিয়ে বাবা মায়ের কোন অভিযোগ না থাকলেও সাকলায়েন নিজেই কষ্ট পেতে থাকেন।

এরপর পড়াশোনা থেকে দুরেই সরে যাচ্ছিলেন এই কর্মকর্তা। বুয়েট বা মেডিকেলে পরীক্ষা দিতে হবে এমনটা কখনো মাথায় আসেনি। আর তাই ভর্তি পরীক্ষার জন্য করেননি কোন কোচিংও। এরই মাঝে জানতে পারেন এইচএসসি পাশের পর আর্মিতে কমিশন পদে পরীক্ষা দেয়া যায়। অংশ নেন পরীক্ষায়। সকল ধাপ সফলতার সঙ্গে অতিক্রম করে যোগ দেন আইএএসএসবি-৫৯ লং কোর্সে মিলিটারি একাডেমিতে। কিন্তু দুরন্ত সাকলায়েন প্রতিনিয়িই হাফিয়ে উঠছিল সেখানে। সাইকেল চালিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়ানো। ইচ্ছে হলেই আম বাগানে চলে যাওয়া। মায়ের সঙ্গে চুলোর পাড়ে বসে ঘন্টার পর ঘণ্টা গল্প করা ছেলেটি বদ্ধ পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না কিছুতেই।

বিষয়টি সবচেয়ে ভাল বন্ধু মা’কে জানালে,  ছেলের কষ্টের কথা শুনে মা ছেলেকে মিলিটারি একাডেমি থেকে নিয়ে আসেন। আবার সেই পুরনো দুরন্ত জীবনে ফিরে যান সাকলায়েন। এর মধ্যে জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেন ১টি বছর। বন্ধুদের সবাইকে দেখতে পান উচ্চ শিক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে।

এবার যেন কিছুটা টনক নড়ে তার। প্রস্তুতি নিয়ে দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা। মোট ১৪ টি বিষয়ে পরীক্ষা দেন। এর মধ্যে ১টি বাদে সবগুলোতেই সফল হন সাকলায়েন। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হন তিনি। তবে নিজের কাঙ্ক্ষিত সাবজেক্ট ইংরেজিতে পড়ার সুযোগ না পাওয়ায় মুষড়ে পড়েন। মা-বাবাসহ সবার পরামর্শে ভর্তি হন সমাজবিজ্ঞান বিভাগে।

তবে এক ধরণের হীনমন্যতায় ভুগতে থাকেন ভর্তির পর থেকেই। বিশেষ করে যখন দেখতে পান অন্যান্য বন্ধুরা বুয়েট বা মেডিকেল কলেজে পড়ছে। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক আর বন্ধুদের সহায়তা, আর বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় মানিয়ে নেন নিজেকে। ফলাফলও ভাল করতে থাকেন। এর মধ্যেই সাধারণ জ্ঞানের  শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং সেন্টারের সঙ্গে।

এসময় সকাল ৬টা থেকে রাত পর্যন্ত করাতেন টিউশনি। নিজে কখনো প্রাইভেট না পড়তে পারলেও গ্রামের খেঁটে খাওয়া মানুষকে সেসময় প্রায় ৬ বছর ধরে পড়িয়েছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। বিনামূল্যে কিনে দিয়েছেন বই। তার পড়ানো প্রায় ৫০০ ছেলে-মেয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।

সাকলায়েন চতুর্থ বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার পর অ্যাপিয়ার্ড হিসেবে অংশ নেন ৩০তম বিসিএসে। অর্থনীতি বিভাগের এক সিনিয়র বড় ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করেন বিসিএসে ক্যাডার চয়েস নিয়ে। সেই বড় ভাই বলেন, “সবচেয়ে ভাল ফরেন ক্যাডার। সেখানে চান্স পেতে হলে সুদর্শন, স্মার্ট ও ইংরেজিতে ভাল হতে হবে। অনেক ভেবে দেখলাম এ ৩টার একটা গুণও নেই আমার। সেজন্য নিজে থেকেই বার বার বিভিন্ন ক্যাডারগুলো দেখতে থাকলাম। নিজের ইচ্ছায় না বুঝেই প্রথম চয়েস দেই পুলিশ ক্যাডার।”

তবে এই চয়েস দেয়ার পেছনে এই কর্মকর্তার জীবনে রয়েছে ছোট্ট একটি গল্প। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি সারদা পুলিশ একাডেমির পাশেই হওয়াতে এক বন্ধুর সঙ্গে জুম্মার নামাজ পড়তে গেছিলেন সারদা বাজারের মসজিদে। সেখানে দেখতে পান লম্বা লাইন দিয়ে একদল ছেলে মসজিদে ঢুকছে নামাজ পড়তে। এদের মধ্যে সবার সামনে দাঁড়ানো লাল পাঞ্জাবি পরা একটি ছেলেকে দেখে চোখ আটকে যায় সাকলায়েনের। বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারেন সেই ছেলেটি ২৭ তম বিসিএসে পুলিশে প্রথম। বিষয়টা খুব ভাল লাগে সাকলায়েনের। সেই মূহুর্তে লাল পাঞ্জাবী পরা মানুষটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ মনে হচ্ছিল তার।

বিসিএসে’র প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ইংরেজি ও অংকের বেসিকটা ছোট থেকেই ভাল ছিল। সাধারণজ্ঞান এর শিক্ষক হওয়ায় সে বিষয়টাও বিশেষ পড়তে হয়নি। সবচেয়ে বেশি পড়াশোনা করেছেন বাংলা ও বিজ্ঞান নিয়ে।

প্রিলিমিনারি পরীক্ষা আশানুরূপ হয়। এরপর দেন লিখিত পরীক্ষা। এরই মাঝে এই কর্মকর্তা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পরীক্ষায় প্রথম হন। একই সঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে সফল হন সহকারি উপজেলা অফিসারে। পোস্টিং হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সেখানে সহকারি উপজেলা অফিসার থাকা অবস্থায়ই দেন ৩০তম বিসিএস’র ভাইভা।

যেদিন ফল প্রকাশিত হয় সেদিন সারাদিন ব্যস্ত ছিলেন তিনি। এক কাজিনের মারফত জানতে পারেন বিসিএসে’র ফল প্রকাশিত হয়েছে। অফিসে নিজের কম্পিউটারটি খুলে পিএসসি’র ওয়েবসাইটটি লগইন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন বার বার। যখন লগইন করতে সক্ষম হন প্রথম শুরু করেন শিক্ষা ক্যাডার দিয়ে। শিক্ষা ক্যাডারে নিজের নামটি না দেখে হতাশ হন। এরপর দেখেন নিজের প্রথম পছন্দ পুলিশ ক্যাডারের তালিকা। সেখানে প্রথম রোল হিসেবে দেখতে পান নিজের রোল।

“২০৯৩৪২ এই রোলনম্বরটিতে চোখ আটকে যায়। এটা আমার রোল বিশ্বাস হতে চায় না। চারপাশ কেমন যেন ফাঁকা লাগতে শুরু করে। এর মাঝে ফোন করি মায়ের কাছে। মা শোনামাত্রই কাঁদতে শুরু করেন। আর বলতে থাকেন, আমি সবসময়ই আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম আমার ছেলে বিসিএসে প্রথম হবে। মা সবসময় বলতেন তুমি বিসিএসে প্রথম হবে।”

ফল প্রকাশের কিছুদিন পর যান সারদা পুলিশ একাডেমিতে বুনিয়িাদি প্রশিক্ষণে। প্রথম হওয়ায় তিনি ছিলেন কোর্স সিনিয়র আর তাই প্রশাসনিক যাবতীয় ঝঁক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাকেই। তবে ট্রেনিংয়ের পুরোসময়টাই অনেক উপভোগ্য ছিল সাকলায়েনের। বাড়ি পাশেই হওয়ায় অন্যান্য ব্যাচমেটদের মতো বাড়ি ছেড়ে দুরে থাকার কষ্টটা পেতে হয়নি তাকে। ইচ্ছে হলেই দেখতে পেতেন বাবা-মাকে।

মেধাবী এ কর্মকর্তা নিজের যোগ্যতা ও প্রজ্ঞায় বুনিয়াদী প্রশিক্ষণেও হয়েছেন সেরা। পেয়েছেন বেস্ট প্রবিশনারি অ্যাওয়ার্ড। বেস্ট একাডেমিক এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স  অব পুলিশ সায়েন্সে হয়েছেন প্রথম।

ট্রেনিং এর পর প্রথম পোস্টিং ছিল নওগাঁ জেলায়। সেখানে যেয়েও উপভোগ করতে থাকেন পুলিশে প্রথম হওয়ার সুফলটা। পেতে থাকেন এক বাড়তি সম্মান। সবকিছু ভাল লাগলেও মা-বাবার অনুরক্ত এই কর্মকর্তার খারাপ লাগত শুধু একটি বিষয়ই। অপেক্ষায় থাকতেন কখন ছুটি হবে, কখন যাবেন স্নেহময়ী মায়ের কাছে।

কর্মজীবনে প্রতিনিয়তই সম্মুখীন হয়েছেন বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জের। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল  ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কপিল বাড়ৈ হত্যাকাণ্ডের আসামি ধরতে সিলেটের তামাবিলে যাওয়া । সেখানে ছদ্মবেশে স্যান্ডোগেঞ্জি ও লুঙ্গি পরে হাওড়ের মধ্যে নেমেছিলেন আসামি ধরতে।

চ্যানেল অাই অনলাইনের মাধ্যমে সকল বিসিএস পরীক্ষার্থীদের শুভকামনা জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতিটি বিষয়ের জন্য আগে থেকে কতগুলো টপিক ঠিক করে নিতে হবে। তারপর সে বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। এক্ষেত্রে ছোট ছোট চিরকুট তৈরি করা যেতে পারে। সুযোগ পেলেই একটু চোখ বুলিয়ে নিতে হবে। যে বিষয়টাতে বেশি দক্ষ সে  বিষয়টাতে সময় বেশি দিলে বেশি নম্বর পাওয়া সম্ভব। আর ভাইভার ক্ষেত্রে বিনীত আচরণ, ও পজিটিভলি সব কিছুর উত্তর দেয়ার কোন বিকল্প নেই।’

চীনা প্রবাদ ‘হার্ডওয়ার্ক সাপোর্টেড বাই গুড ইনটেনশন মেকস মিরাকল’ অনুপ্রাণিত হন এই কর্মকর্তা জীবনের প্রতিটিক্ষেত্রেই বিশ্বাস করেন, কঠোর পরিশ্রম করলে এবং সৎ উদ্দেশ্য থাকলে সফলতা আসবেই।