চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

মা রান্না করে বসে আছেন

ধানমন্ডি বয়েজ হাইস্কুলের ছাত্র আমি। আজ অফিসে রিকশা নিয়ে, হেঁটে গেছি। আসাদগেট আড়ং এর সামনে অনেকক্ষণ তোমাদের দেখলাম। ফিরে গেলাম স্কুল জীবনে।

চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গেলো ফ্রেমগুলো। আমাদের শ্রদ্ধেয় স্যারকে বাস ধাক্কা দিয়েছে। আমরা সবাই রাস্তায়, ২৭ নম্বর মোড় থেকে আড়ং এর আগ পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ, আমাদের দাবি মানতে হবে, দাবি কি? স্যারের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা এবং বাসের গতি নিয়ন্ত্রণ করে চলতে হবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিনের পরীক্ষা দিলাম না আমরা। বিকেল ৪টায় দাবি মানলো বাস মালিক। স্কুলের শিক্ষকরা বললেন, ‘ক্লাশে যাও সবাই’, আমরা ক্লাশে চলে গেলাম।

প্রিয় বাংলাদেশের লক্ষ্মী সন্তানেরা, তোমাদের একটা কথা বলি। যদিও আমার মতো একজন খুব ইম্পর্টেন্ট না এমন একজনের কথা তোমাদের শুনতে ইচ্ছে করবে কিনা জানিনা, তবুও বলি..

আমাদের সময়টা ছিলো একটু ভিন্ন। সোশ্যাল মিডিয়া ছিলোনা, মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার প্রশ্নই আসেনা।  তার মধ্যেও আমাদের মধ্য থেকে নেতা গোছের বন্ধুগুলো সমঝোতা বা বোঝাপড়ার জন্য দশ পা এগিয়ে গিয়েছিলো। সমাধান হয়েছিলো। আমরা ক্লাশে ফিরে গিয়েছি।

তোমাদের ইস্যু অনেক বড়। তোমরা যা করছো তোমাদের নিহত সহপাঠীদের (আল্লাহ তা আলা তাদের বেহেস্ত নাসিব করুন, আমিন) জন্য, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

শুধু ক্ষতিপূরণ আদায় করোনি তোমরা!!!

তোমরা পুলিশ, সাধারণ মানুষ, মিডিয়া, হাসপাতাল, বিত্তবান, সুশীল সমাজ, নেতা, কর্পোরেট, শিক্ষক, সমাজ এমনকি একটা রাষ্ট্রকে দেখিয়ে দিয়েছো কিভাবে রাস্তায় পরিবহনব্যবস্থা সুন্দর করা যায়। তোমরা ভীষণ সুন্দর সহমর্মিতা দেখিয়েছো দুর্বল খেটে খাওয়া মানুষদের, রোগীদের।  সম্মান করেছো ডাক্তার, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্সকে। হু ক্যান বি স্মার্টার দ্যান ইউ/ইওরস? হু ক্যান বি কেয়ারিং দ্যান ইউ/ইওরস? আই স্যালুট।

সারা বাংলাদেশের মানুষ আজ সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে তোমাদের ভালো কাজ, দেখিয়ে দেয়া কাজগুলো দেখেছে, শিখেছে। জানো, তোমাদের কাজগুলো দেখে চোখে পানি চলে এসেছে কত মানুষের? কত মায়ের দোয়া তোমরা পেয়েছো?

রাষ্ট্রের মন্ত্রীসভার ৪ জন গুরুত্বপুর্ণ মন্ত্রী, তারা সভা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তোমাদের কথা শুনেছেন। তোমাদের বন্ধুর পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।

তোমরা তোমাদের মায়েদের এত ভালবাসার আদরের মানিক এবং বাংলাদেশের মানুষের এত দোয়া, আশির্বাদ তোমরা পেয়েছো যে তোমাদের আসলে যা বলার ছিলো তা বলা হয়ে গেছে। যা করে দেখানোর কথা ছিলো তা করে দেখানো হয়ে গেছে।

আমি ঢাকা শাহীন কলেজের ছাত্র। আজ আমার অনেক গর্ব হয়েছে যে আমাদের শাহীন কলেজের মাননীয় প্রিন্সিপাল স্যার অধিকারের কথা বলার সাথে শাহীন স্কুলের ছাত্রদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন।

প্রতিটা আন্দোলনে দাবি-দাওয়া থাকে এবং সেটা মেটানোর ব্যাপার থাকে এবং সেটার একটা সময় থাকে। সেই সময়টা পর্যন্ত সকলে এত সুন্দর একত্রিত থাকতে পারা নিজেদের কথা বলতে পারাটাই, বিজয়। সেই সময়টা তোমরা তৈরি করে নিয়েছো এবং তোমরা যা বলবার তা বলেছো এবং দেখিয়েও দিয়েছো।

এখন তোমাদের প্রতিটা স্কুল থেকে একজন করে প্রতিনিধি ঠিক করে দাবিগুলো লেখো। তারপর সরকারের কাছে জমা দাও। স্কুলেই মিটিং করতে পারো সকল প্রতিনিধি মিলে। ইয়েস ইউ ক্যান মেক দ্য বেস্ট বাংলাদেশ।

আমার একটা চাওয়া থাকবে তোমাদের কাছে, রাস্তার সর্ববামের লেনটা শুধু বাসের জন্য রাখার জোড় দাবি, বিদেশে যখন কাজে গেছি তখন তাই দেখেছি, আমাদের চাইতেও অনেক সরু রাস্তায় আমাদের চাইতেও অনেক সুন্দর দামি বাস চলে। সবাই কত সুন্দর করে ওঠে আর নামেন।

একটা কথা মনে পড়ে গেলো। সেটা বলে লেখা শেষ করি। ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলে রাস্তা বন্ধ। কোনো রিক্সা গাড়ি যেতে দেয়া হচ্ছেনা। হঠাৎ করেই একটা ছোট্ট মারুতি গাড়ি কোন এক গলি দিয়ে বের হয়ে এলো। আমাদের একবন্ধু গাড়ির দিকে তেড়ে ধরতে এগিয়ে যেতেই দেখলো গাড়িতে একজন সন্তানসম্ভবা মহিলা রয়েছেন, এত ছাত্র দেখে তার চেহারা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আমার চোখে ভাসছে, ঠিক তখুনি আমার দুজন বন্ধু এগিয়ে গেলো, অভয় দিলো, বললো, ‘আপু কিছু হয়নি তো, এই স্কুলের বন্ধুরা সব আড্ডা মারছি। বলে চারজন বন্ধু গাড়িটাকে বুক দিয়ে আগলে মানিক মিয়া এভিনিউতে উঠিয়ে দিলো। সেদিন যে সন্তানটা ভুমিষ্ট হয়েছিলো হয়তো তার নাম মা রেখেছিলেন ‘বিজয়’। কিংবা বিপ্লব।

ভীষণ কেঁদেছিলাম সেদিন।  গর্ব হয়েছিলো ধানমন্ডি বয়েজ এ পড়ি। আজ আমিও বুঝতে পারি তোমরা কতটা গর্বিত।

বাসায় যাওয়া দরকার এখন তোমাদের। স্কুল তোমাদের। পড়াশোনা শেষ করে তোমরা যে বাংলাদেশটা গড়বে তা সবাই দেখে ফেলেছে। তোমরা বিদেশ চলে যেও না কিন্তু।

মা রান্না করে বসে আছেন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)