গত বছরের কথা। চ্যানেল আইয়ের ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার খাচ্ছি। হঠাৎ পাশের টেবিল থেকে ঘর কাঁপানো হাসির শব্দের পাশ ফিরে তাকালাম। কালো টিশার্ট, কালো ক্যাপ, লম্বা চুলের চিরচেনা আইয়ুব বাচ্চু। আমাদের লিজেন্ড।
খাওয়ার ফাঁকে কয়েকবার তাকালাম। দেখলাম খুব হাসাহাসি করছেন। দ্রুত খাওয়া শেষ করলাম। আজ ফুরফুরে মুডে আছেন। একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে। মোবাইলের রেকর্ড রেডি করলাম। খাওয়া শেষ করে হাত মুছছিলেন। এগিয়ে গেলাম। সালাম দিলাম। ভেজা ভেজা শীতল হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। হ্যান্ডশেক করার সময় শক্ত করে হাত ধরে একটা ঝাঁকি দিয়ে বললেন, কেমন আছিস। কথা বলবি? চল হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।
তার অসম্ভব ভারী হাতটা আমার কাঁধে রাখলেন। চ্যানেল আইয়ের লম্বা করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, বল কী জানতে চাস? বললাম ভাই, সবাই তো গিটার শো নিয়ে নিউজ করছে। আমাকে এমনকিছু বলেন যা এর আগে কাউকে বলেননি। আবার হাসলেন। ঘর কাঁপানো হাসি। বললেন, আমি মা নিয়ে একটা গান করেছি জানিস? বলতে পারবি কোন গানটা? আমি বললাম, ভাই আপনার সব গানই আমি বলতে পারবো। আবার হাসলেন। ততক্ষণে চ্যানেল আই ভবনের দোতলায় বোর্ডরুমের সামনে চলে এসেছি আমরা।
বোর্ডরুমের সামনে রাখা ছোট সোফায় গা এলিয়ে দিলেন। আমি সামনের সোফায় বসলাম। তিনি বললেন, এত দূর থেকে রেকর্ড আসবে না। আমার পাশে বস। পাশে গিয়ে বসলাম। এর মধ্যে কে যেন এলেন। তার সাথে মিনিট দু’য়েক কথা বললেন। কয়েকদিন পরে চট্টগ্রামে গিটার শো। সেটা নিয়ে কথা বললেন। কথা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী বলছিলাম রে? বললাম, মা নিয়ে গানটা, ঐ দূর আকাশের তারা রে, তুই বলে দে না কোনটা আমার মা…।
আমার হাত থেকে রেকর্ড করতে থাকা মোবাইলটা নিয়ে তার মুখের সামনে ধরলেন। তারপর একটু আনমনা হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ থেকে থেকে গম্ভীর মুখে বলতে শুরু করলেন, ‘আমার আম্মা মারা যান ২০০৪ সালের ২ ডিসেম্বর। এর তিন-চারদিন দিন পর আমার শো ছিল। গাড়িতে করে যাচ্ছি। মায়ের জন্য খুব খারাপ লাগছে। মায়ের কথা মনে পড়ছে। কারণ, আমি মা–পাগল একটা ছেলে। তখনও যেমন মায়ের জন্য পাগল ছিলাম, এখনও তেমন পাগল আছি। সেই মা যখন চলে গেছেন আমাকে ছেড়ে, এর চেয়ে বড় কষ্ট আমার আর কিছু নেই। গাড়িতে থাকা অবস্থায়ই গানের কথাগুলো আমার ভেতর জন্ম নিলো। ঢাকায় ফিরে এসে এবি কিচেনের গিটারিস্ট ও সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে বললাম, “চল গানটা রেকর্ড করি।” ও বলল, “লিরিক কই? গানের কথা কই?” আমি বললাম, লিরিক বুকে আছে। গানের কথা আত্মার ভেতর। সেটাকে বের করতে হবে। এরপর সরাসরি কথা ও সুর দিয়ে রেকর্ড করলাম “ঐ দূর আকাশের তারা রে”। কোথাও লিখিনি। আজ পর্যন্ত গানটা কোথাও লেখা নেই।’
আমি বললাম, ২০০৫ সালের দিকে গুলশান ওয়ান্ডার ল্যান্ডের এক কনসার্টে আপনি গানটা গাইছিলেন। পাশে আমার বন্ধু অঝোরে কাঁদছিলো। কারণ কয়েকমাস আগে ওর মা মারা গিয়েছিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আইয়ুব বাচ্চু বললেন, একবার কী হয়েছে শোন। আমি যেখানেই যাই গানটা গাইতে হয়। সবাই স্তব্ধ হয়ে শোনে। কারণ মাকে তো সবাই ভালোবাসে। একবার কাতারে গিয়েছিলাম। চ্যানেল আইয়ের আয়োজনে কনসার্টে অংশ নিতে। হলভর্তি দর্শক। আমি স্টেজের নিচে। আমার সামনে হাজারও প্রবাসী। আমার আগে গান গাইলেন বারি সিদ্দিকী। সবাই আশা করেছিলেন উঠেই রকিং কিছু গাইব। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে হলো আর কিচ্ছু দরকার নেই। মা গানটা করি। প্রায় ১৭ মিনিট নিয়ে গাইলাম ঐ দূর আকাশের তারা রে…। প্রবাসীরা মাকে ছাড়া দেশের বাইরে থাকে, তারা গানে একাত্ম হয়ে গেল। চারদিকে কান্না রোল। গিটারের তালে তালে সবাই গাইছে, সবার চোখে পানি। পরিবেশটা এমন ছিল যে, মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গ নেমে এসেছে। কী এক ম্যাজিক্যাল মোমেন্ট। একটা গান ১৭ মিনিট ধরে গাওয়া এবং দর্শকের সঙ্গে এমন ভাবে একাত্ম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে ইতিহাস হয়ে আছে।
হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন করে বসলাম। মা নিয়ে আপনার প্রিয় গান কোনটা? ভেবেছিলাম এই প্রশ্নের জন্য ধমক খাবো। সবার নিজের লেখা, গাওয়া গান প্রিয় হবে এটাই তো স্বাভাবিক। ঠোঁটের কোন হাসি টানলেন। বললেন, মা নিয়ে আমার প্রিয় গান প্রিন্স মাহমুদের লেখা জেমস ভাইয়ের গাওয়া মা গানটা। রাতের তারা আমায় কি তুই বলতে পারিস, কোথায় আছে কেমন আছে মা…।
আজ বৃহস্পতিবার হঠাৎ করে মা পাগল ছেলেটা মায়ের কাছে চলে গেল। মাকে ছাড়া থাকতে হয়তো তার খুব কষ্ট হচ্ছিল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)