মাহে রমজান আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এক বিশেষ উপহার। রমজান মুমিন জীবনে তাকওয়া, একাগ্র চিত্তে অধিক ইবাদত, ত্যাগ, সংযম, ধৈর্য্য, দান-সাদকা, সাহায্য-সহমর্মিতা, পরিশিলীত জীবনাচরণ, আদর্শ চরিত্র গঠন, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি মৌলিক গুণের শিক্ষা দেয়। রমজানে মানব জীবনের প্রয়োজনীয় প্রায় সব ফেরেশতাসুলভ স্বভাবের সমন্বয় ঘটে। রোজাদার রমজানের ইবাদত বন্দেগির মধ্য সকল অন্যায়-অত্যাচার, অশ্লীলতা-অনাচার, বেহায়াপনা-ব্যাভিচার, মিথ্যাচার-পাপাচার ও যাবতীয় অকল্যাণকর কর্মকান্ড থেকে বিরত হয়ে সংযম সাধনার পথ ধরে আল্লাহ পাকের কাছে আত্মসমর্পনের শিক্ষা পায়। সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ক্ষুধা-পিপাসা সহ্য করে ইফতার, দীর্ঘ সময় নিয়ে তারাবীহ, তাহাজ্জুদ ইত্যাদির ভেতর দিয়ে রোজাদার মাহে রমজানে প্রশিক্ষিত হতে থাকে। মুমিন বান্দা যদি মাহে রমজানে চর্চিত সেসব শিক্ষা বাকি ১১ মাস জারি রাখতে পারে, তবে তার ইহকালীন ও পরকালীন জীবন হবে সফল।
মাহে রমজানের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো তাকওয়া বা খোদাভীতির শিক্ষা। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। তাকওয়া অর্জন সম্ভবত তোমরা করতে পারো। (সূরা বাকারা: ১৮৩) কোরআনে পাকের এ আয়াত স্পষ্ট করে দিয়েছে, রোজাদার যদি তার আদায়কৃত রোজার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনে সফল না হয়, তবে রোজার এ কষ্ট-ক্লেশ ব্যর্থ। রাসূল সা. বলেছেন, এমন অনেক রোজাদার আছে, যার রোজা কেবল ক্ষুধার্ত থাকার নামান্তর। আর এমন অনেক রাত জেগে ইবাদতকারী আছে, যাদের ইবাদত কেবল রাত জাগার নামান্তর।’ (মুসনাদে আহমদ: ৯৬৮৩)
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সকল প্রকার নাফরমানী থেকে দূরে থাকার নাম তাকওয়া। আল্লাহর কাছে বান্দার মান-মর্যাদার পরিমাপক হচ্ছে তাকওয়া। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে ব্যক্তি যে মুত্তাকী তথা তাকওয়াবান। (সূরা হুজুরাত: ১৩)
রোজাদার একমাত্র আল্লাহভীতি বা তাকওয়ার ভিত্তিতেই রোজা পালন করে। লোক দেখানোর জন্য বা কারও কাছে থেকে বাহবা হাসিলের জন্য নয়। রমজানে সে দিনের বেলা দরজা বন্ধ করে পানাহার করে না। কারণ সে জানে সকলের অলক্ষ্যে সে যা–ই করুক না কেন, আর কেউ না দেখলেও মহান আল্লাহ পাক দেখছেন। তার অন্তরের এ অনুভূতিই তো তাকওয়া।
মাহে রমজানের এ শিক্ষাকে আমাদের সারা বছর জারি রাখতে হবে। যে আল্লাহ পাকের ভয়ে আমরা রমজানের দিনের বেলা পানাহারসহ অন্যান্য অনেক কাজ থেকে বেঁচে থাকি, আমাদের মনে রাখতে হবে, সেই আল্লাহ পাকের পরিবেষ্টনের বাহিরে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। যেখানেই অন্যায় করি না কেন, আল্লাহ অবশ্যই দেখছেন। পৃথিবীর সকলকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও তাঁকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, লেনদেন সকল ক্ষেত্রে এ অনুভূতি জাগ্রত না হলে রমজানের রোজা আমাদের কোনো কাজে আসবে না।
মাহে রমজানে মুমিন বান্দা অধিক ইবাদত বন্দেগি করে থাকেন। ফরজ রোজার পাশাপাশি তারাবীহ, তাহাজ্জুদ, দুআ-দরূদ, তাসবীহ-তাহলীল, দান-সাদকা, তেলাওয়াত, তাওবা-ইস্তেগফার ইত্যাদি ইবাদতের আধিক্য দেখা যায় এ মাসে। এজন্য এ মাসকে ইবাদতের মৌসুমও বলা হয়। রমজান পরবর্তী বাকি মাসগুলোতে এ রকম অধিক ইবাদতের চর্চা অব্যাহত রাখা জরুরি। সাওয়ালের ৬টি রোজা, প্রতি মাসে আইয়ামে বিজের রোজাসহ নফল রোজার প্রাকটিস জারি রাখা ঈমানে দাবি। পাশাপাশি নফল নামাজ, তেলাওয়াতে কোরআন, তাওবা-ইস্তেগফারসহ যাবতীয় কল্যাণকর আমল রমজান পরবর্তী ১১ মাসে চালু রাখতে পারলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ সুন্দর হবে কোনো সন্দেহ নেই। ব্যক্তি জীবনের এ সকল আমলের নূর পরিবার ও সমাজকে আলোকিত করবে।
রমজান আমাদেরকে সংযমের শিক্ষা দেয়। আমরা সামর্থ্য থাকা সত্বেও না খেয়ে থাকি, মিথ্যাকে বর্জন করি। কেউ আমাদের সাথে ঝগড়া করতে আসলে আমরা বলি ভাই আমি রোজাদার। নিজের নফসকে শাসন করার গুণ আমরা রমজানে শিক্ষা লাভ করি। সিয়ামের অর্থই তো বিরত থাকা, সংযমী হওয়া। মানুষ দেহ ও আত্মা এ দুই বস্তু দ্বারা সৃষ্ট। দেহ মাটির তৈরি, যার স্বভাব নিম্নগামী আর আত্মা বা রূহ আল্লাহর আদেশ, যা ঊর্ধগামী। মাটির বৈশিষ্ট্য যখন মানুষের মধ্যে প্রবল হয়, তখন সে মনুষ্যত্বটুকুও হারিয়ে ফেলে এমনকি চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে সংযম-সাধনার মাধ্যমে তার মধ্যে আত্মার বৈশিষ্ট্য যখন প্রবল হয়, তখন সে উৎকর্ষতার বিচারে ফেরেশতকুলকেও ছাড়িয়ে যায়। রমজানের রোজা মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবন সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার শিক্ষা দেয়। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি-মারামারি, আত্ম অংকার ভুলে গিয়ে মার্জিত জীবন জাপনে অভ্যস্ত করে। এ সংযম শুধু রমজানেই নয়; বরং সারা জীবনের পাথেয় হতে হবে।
মাহে রমজান আমাদেরকে দুঃখী জনের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয়, সৃষ্টি জগতের প্রতি সহমর্মি, সহযোগী হতে শিখায়। ক্ষুধা-পিপাসার কষ্ট কেমন তার অনুভূতি রোজা রাখার মাধ্যমে অনুভূত হয়। গরীব-মিসকীনদের প্রায় সারা বছর যে কষ্টে জীবন যাপন করতে হয়, সে জগৎ সম্পর্কে সকল মুমিন জ্ঞান লাভ করেন। তাই রমজানে তাদের পাশে দাঁড়ানোর সে অভ্যাস বাকি ১১ মাস চালু রাখলে সমাজে অসাম্য বা বৈষম্য থাকবে না। সেজন্য রমজানের পারস্পরিক স্নেহ-ভালোবাসা, মায়া-মমতা. আন্তরিকতা, দানশীলতা, উদারতা, ক্ষমা, পরোপকারিতার শিক্ষা সব সময়ের জন্য চালু রাখা আবশ্যক।
মাহে রমজান আমাদেরকে পরিমার্জিত জীবনাচরণ ও নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা দেয়। সঠিক সময়ে নিয়ম মেনে সাহরী গ্রহণ আবার সময় মতো ইফতার করা, যথা সময়ে তারাবীহ নামাজ আদায়সহ অন্যান্য অনেক আমল পালনে সময়ানুবর্তি হওয়ার মহান শিক্ষা আমরা রমজানকে কেন্দ্র করে পেয়ে থাকি। সাহরী এবং ইফতারেও আমরা এক সেকেন্ড বা এক মিনিটও এদিক সেদিক করি না। এমন সূক্ষ নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে আমরা রমজানের যে সময়টুকু পার করি, তার কিছুটাও যদি আমরা আমাদের বাকি জীবনে চর্চা করি, তবে আমরা সফল হবো কোনো সন্দেহ নেই।
মাহে রমজান এখন প্রায় বিদায়ের পথে। বাকি দিনগুলিতে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রমজানের সকল শিক্ষা অর্জন করার এবং বাকী ১১ মাস আমাদের জীবনে সে শিক্ষাগুলি প্রতিপালনের তাওফীক দিন। আমীন।
লেখক: মাওলানা মোহাম্মদ বদরুজ্জামান রিয়াদ