কেবল মাহিরের জন্যেই আমি কাঁদছি। মাহির চৌকষ পুলিশ অফিসার বাবুল আক্তার এবং গুপ্তঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহত মাহমুদা খানম মিতুর স্কুল পড়ুয়া সন্তান। ওর অশ্রু ঝরা নির্বাক দুচোখ দেখে নিজের চোখের পানি সংবরণ করতে পারিনি। ভীষণ মায়া জমা হয়েছে ওর জন্যে। কেবলই ওর কথাই ভাবছি রাতদিন- এই ভেবে কোমলমতি শিশুটির হৃদয়ে কিনা এক নিষ্ঠুর প্রতিচ্ছবি তৈরি হয়েছে। ৫ জুন নিজ চোখের সামনে ও দেখেছে প্রিয় মায়ের নির্মম মৃত্যু। খুনিরা কীভাবে খুন করেছে, পালিয়েছে সব ও দেখেছে। স্কুল ড্রেস পড়া অবস্থায় মায়ের রক্তাক্ত দেহের পাশে ও দাঁড়িয়েছিল। সেদিন মায়ের হাত ধরে ও স্কুলে যাচ্ছিল। প্রিয় মা চলে গেছে। কিন্তু ছোট্ট নিষ্পাপ মাহিরের বুক চাপা পড়ে গেছে পাহাড়সম কষ্টে। যে মা ওদের দুই ভাইবোন ছাড়া কিছুই বুঝতো না সেই মা আর পৃথিবীতে নেই। কোনোদিন আসবেও না আর। মায়ের কোলে ও আর ছোট বোন তাবাসসুম কোনোদিন ঘুমাতে পারবে না। কোনাদিন আর মায়ের সাথে বসে খেতে পারবে না। কথা বলতে পারবে না। সামান্য আব্দারটুকু জানাতে পারবে না।
আসলে মাহির এবং তাবাসসুমকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা কারো জানা নেই। কী শান্তনা আছে ওদের জন্যে? ছোট্ট মাহিরের বুকটা কষ্টে বেদনায় নিশ্চয় ছিঁড়েফুড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সেদিনের নির্মম দুঃসহ বেদনাময় স্মৃতি ও কীভাবে ভুলবে? ৫ জুন স্কুলে যাওয়ার জন্যে মায়ের মমতাময় দুটি হাত ধরে বেরিয়েছিল সে। সকালের নাস্তাটা খেয়েছিল মায়ের হাতেই। মা স্কুল ড্রেস পরিয়ে চুল আঁচড়িয়ে দিয়েছিল। নেইমকার্ড গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিল। স্কুলব্যাগ, ওয়াটারপট গুছিয়ে দিয়েছিল। তারপর মায়ের আদর মাখা হাত ধরেই বেরিয়েছিল স্কুলের বাস ধরার জন্য। সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজেও স্পষ্ট দেখা গেছে মায়ের হাত ধরে ছোট্ট মাহির কী সুন্দর হেঁটে চলেছে। আর দশটা সাধারণ মায়ের মতোই মাহমুদা খানম মিতু হেঁটে চলেছেন। মা আর ছেলের হাত ধরাধরি করে হাঁটা দেখে মনে হচ্ছিলো পৃথিবীতে তাদের কোনো শত্রু নেই, থাকতে পারে না। গলির রাস্তা থেকে বের হয়ে মায়ের সাথে মূল রাস্তা দিয়ে ডানে হেঁটে চলেছে মাহির। সকালে রাস্তার এ পাশ ও পাশ দিয়ে মানুষজন চলাচল করছে। রিক্সাও যাচ্ছে টুকটাক। এরপর সামনের দিক থেকে আসা খুনীরা দ্রুতই মাহিরের মা মিতুর পথরোধ করে। খুব দ্রুতই তারা মিতুকে ছুরিকাঘাত এবং গুলি করে হত্যা করে। ছোট্ট মাহির বলেছে, খুনীরা প্রথমে তাকে একটু দূরে সরিয়ে দেয়। খুনীরা তার মাকে হত্যা করে মোটর সাইকেল যোগে পালিয়ে যায়। ভিডিও ফুটেজে এটিও স্পষ্ট।
মাহিরের কান্না থামছে না। থামবার কথা নয়। বুক জুড়ে ওর যে নির্মম স্মৃতি। নিজের চোখের সামনে দেখেছে ও মাকে মেরে ফেলতে। ছোট্ট হওয়ায় প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে পারেনি। বড় হলে না হয় নিজের জীবন দিয়ে মাকে বাঁচাতো। মাহির তাই কখনও ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আবার কখনও বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকছে। কখনও দুহাত দিয়ে নিজের মুখ লুকিয়ে রেখেছে। আসলে ওর কষ্ট ও কান্না থাামার নয়। যে নিষ্পাপ শিশু চোখের সামনে দেখেছে মায়ের রক্তাক্ত দেহ, খুনির উল্লাস সেই শিশুর কান্না আকাশ বাতাস ভারি না করে পারেনি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে সেদিন মাহিরের কান্না দেখে কেউই চোখের পানি সংবরণ করতে পারেনি। অনেককেই হুহু করে কাঁদতে দেখা গেছে। তবে মাহিরের চোখে যে জলের ধারা, সেখানে অভিমানও দেখা গেছে ভীষণরকম। অভিমানটা এখানেই যে বাবা পুলিশ অফিসার। কিন্তু মাকেতো বাঁচানো গেল না। কোনোদিনই সে প্রিয় মাকে এত নিষ্ঠুরভাবে হারাতে চায়নি। এ কারণেই ছোট্ট মন কেবলই কেঁদে চলেছে তার। ছোট্ট মন আরও কাঁদছে এই কারণে যে বাবা পুলিশ অফিসার হলেও মা খুনীদের হাত থেকে বাঁচাতে পারলো না। মাহিরের ছোট ফুটফুটে বোন তাবাসসুম বলেছে, ‘বাবা কাছে থাকলে মাকে কেউ মারতে পারতো না।’
আমরাও প্রতিদিন সকালে পরম আদরে ছেলে বা মেয়েকে নিয়ে স্কুলে রওনা হই। ছোট্ট শিশুদের সবচেয়ে প্রিয় বিষয় মা-বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া। অনেক সময় বাবা-মা সময় দিতে না পারলে শিশুদের মনে কতো না অভিমান জমা হয়। যে সব মা-বাবা চাকরি করেন, অফিসে ব্যস্ত থাকেন তাদেরও দেখেছি শত কাজ ফেলেও ছোট্ট সন্তানের দাবি মেটাতে স্কুলে ছুটে যেতে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সন্তানের এই চাওয়া-পাওয়ার সাথে মা-বাবার সম্পর্ক তুলনাহীন। আদর স্নেহ মায়া-মমতা আমাদের সমাজে বরাবরই ঈর্ষণীয়। সত্যিইতো আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে আদর স্নেহই বড় সম্বল। যার যতটুকু সম্পদই থাক, আদর স্নেহটা এখানে বড় বেশি প্রবল এবং শক্তিশালী।
এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের ধরণ দেখে বুঝা যায়, হত্যাকারীরা অনেকগুলো এজেন্ডা সামনে রেখেই এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। এর আগে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কেউই ঘটায়নি। আমরা কখনও শুনিনি বা দেখিনি বাচ্চার হাত মায়ের হাত থেকে সরিয়ে মাকে বাচ্চার সামনেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এবার সেটাই দেখা গেল। হত্যাকাণ্ডের ধরন দেখে বুঝা যাচ্ছে সুনির্দিষ্ট এজেন্ডাকে সামনে রেখেই হত্যাকারীরা এই নির্মম ঘটনা ঘটিয়েছে। মনে হচ্ছে হত্যাকারীরা সমাজে এমন একটি ভীতি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে যে, তাদের কাছে কারো স্ত্রী বা শিশু কেউই নিরাপদ নয়। কেননা যে কোনো মানুষের কাছেই স্ত্রী এবং সন্তান সবচেয়ে প্রিয়। এই ভীতিটাকে তারা ভীষণরকম ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে।
মাহমুদা খানম মিতুর হত্যাকারীদের ধরার জন্যে পুলিশ তৎপরতা চালাচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা জোর অনুসন্ধানে নেমেছে। হয়ত যেকোনো সময় খুনীরা ধরা পড়বে, নতুবা খুনের ক্লু বের হবে। কিন্তু ছোট্ট মাহিরের মনে যে ক্ষত তৈরি হলো-সেই ক্ষতচিহ্ন কী আমরা মুছতে পারবো? সত্যিইতো আমরা এ কোনা সমাজে বসবাস করছি? যে সমাজে এখন আর কেউই নিরাপদ নয়। মায়ের স্নেহ ভালবাসা আদর সবই কেড়ে নিচ্ছে খুুনীরা। মাহমুদা খানম মিতু হত্যার সাথে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অনুমিত হচ্ছে। খুনের ধরনও সেটা বলছে। জঙ্গিরা যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। একের পর এক তারা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। হত্যাকাণ্ডের ধরনও তারা পাল্টে ফেলছে। বুঝা যায়, বড় ধরনের সংশ্লিষ্টতা তাদের রয়েছে। তাদের দমাবার জন্যে প্রয়োজন আরও সুদৃঢ় উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা। আর যেনো কোনো মাহিরকে এভাবে চোখের সামনে মাকে হারাতে না হয়, সেই পথ অবশ্যই চিরতরে বন্ধ করতেই হবে।
(এ
বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)