কবিতা পড়তে পড়তে, লেখার সকুণ্ঠ চেষ্টা করতে করতে একজন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ও রাজনীতি-সংলগ্ন তরুণ হয়ে উঠলেন কবি। তিনি মাহবুবুল হক শাকিল। এভাবে কবি হয়ে ওঠা পৃথিবীতে বিরল ঘটনা নয়। কিন্তু বাংলাদেশে তা আগে দেখা যায়নি। শাকিল তাঁর পুরো সত্তাব্যাপী আমাদের জন্য বিস্ময় ধরে রেখেছিলেন। তাঁর স্বল্পকালীন রাজনৈতিক জীবন, তার চেয়েও হ্রস্ব সময়ের জন্য কবিতাযাপন, এবং চল্লিশ পেরুতে না পেরুতে আমাদের মতো গুণমুগ্ধদের শোকস্তব্ধ করে দিয়ে তাঁর আকস্মিক চলে যাওয়া— এসবের পুরোটাই আমাদের জন্য বিপুল এক বিস্ময়।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, মাহবুবুল হক শাকিলের মতো এমন বহুমুখী প্রতিভার তরুণ আমি সাম্প্রতিককালে দেখিনি। ধারালো ছিলো তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি, ছিলেন আপাদমস্তক অমায়িক, সংবেদনশীল, মিশুক ও বন্ধুবৎসল—সর্বোপরি তাঁর ছিলো এক বিশাল মন। এরকম মন থাকা বাঞ্ছনীয় একজন সফল রাজনীতিবিদের, এবং একজন কবির। আসলে শাকিল ছিলেন অমিত সম্ভাবনার আধার। আমরা দেখেছি তাঁর প্রতিভার আলোকচ্ছটা। হায়, অনেক অকল্পনীয় সম্ভাবনাময় তরুণের মতো তিনিও প্রতিভার চাপ পুরোটা নিতে পারেননি। এর সর্বগ্রাসী স্রোত তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জগতে মাহবুবুল হক শাকিলের আকস্মিক চলে-যাওয়া এক বড় দুর্ঘটনা।
যৌবনের মাঝামাঝি পৌঁছে ওর কাছে প্রত্যক্ষ রাজনীতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে থাকে। তাঁকে টানে সাহিত্য ও সঙ্গীতের অনির্বচনীয় জগৎ। মায়াবী এর আকর্ষণ। হয়তো এই ভুবনের প্রতি তাঁর ঝোঁক সুপ্ত ছিলো শৈশব-কৈশোর থেকেই। সেটা কেবল তিনিই জানতেন। অনেক লেখকের বেলায় দেখা যায় পূর্ণ সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটেছে অনেক পরে। মনে করতে পারি, এটি ঘটেছে শাকিলের ক্ষেত্রেও। প্রত্যাশিত গন্তব্য থেকে ওর জীবন আকস্মিকভাবে এক নতুন বাঁক নিয়েছিলো। বাস্তববাদী মানুষের চোখে ওটা হয়তো ছিলো এক ধরনের পথভ্রষ্টতা। রোমান্টিকরা ওতে খুঁজবেন ব্যাখ্যার অতীত এক আনন্দ। এর মর্মার্থ জানেন শুধু জন্মশিল্পীরা।
কবিরা অনেক কিছু আগে থেকে বুঝতে পারেন। নিজের সম্পর্কে শাকিলেরও কিছু একটা উপলব্ধি হয়েছিলো। পরপর দুটো কবিতার বই বের করে, এবং একই সঙ্গে গল্পের ভুবনে ঢুকে তিনি সৃজনের অপার্থিব এক মৌতাতে ডুবে গেলেন। যে যা-ই বলুন, অচেনা আনন্দলোকে ওর হারিয়ে যাওয়া ছিলো ওর কবিসত্তারই ভিন্নতর এক প্রকাশ। আমরা বুঝতে পারিনি ওতে জড়ানো ছিলো সৃজনশীলতার উল্টো রূপটি— যা সহজ ভাষায় আত্মবিনাশ। বহু শিল্পী-লেখককে বিনাশী এক কুহক তাড়িয়ে ফেরে আজীবন। অনেকে এর জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে পারেন। মাহবুবুল হক শাকিল পারেননি। তবে এ কোনো পরাজয় নয়। সাহিত্যের অকালপ্রয়াত জন্মকবিদের তালিকায় তাঁর স্থান নির্ধারিত হয়ে গেছে। হেরেছি আমরা। আমাদের সান্তনা, ’অদ্ভুত আঁধারে’ নিরুদ্দিষ্ট থেকেও শাকিল তাঁর নিজস্ব দ্যুতি ছড়িয়ে যেতে থাকবেন। আমরা পরিমাপ করতে থাকবো তাঁকে ঘিরে আমাদের বিস্ময়ের গভীরতা।