সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহ করা খবর যাচাই ছাড়া প্রকাশ করে নয় বছর আগে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম যে ভুল করেছিলেন সম্পাদক ও সাংবাদিকরা আজও সেই একই ভুল করছেন বলে গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তবে ভিন্ন মতও আছে।
টিভি টকশো এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত লেখাগুলোতে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই বলে মাহফুজ আনামের অভিযোগ যথার্থ বলে মনে করছেন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ রোবায়েত ফেরদৌস এবং সজীব সরকার। তারা এ ধরনের চর্চাকে সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে মনে করছেন।
আর টিভি টকশোকে সাংবাদিকতার কাতারে না ফেলে ব্যক্তি মত প্রকাশের প্লাটফর্ম উল্লেখ করলেও মাহফুজ আনামের সঙ্গে একমত গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ মোঃ আসিউজ্জামান।
তবে একইসঙ্গে সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক এবং টকশো উপস্থাপক আনিস আলমগীর বলছেন, তাকে নিয়ে যেসকল টেলিভিশন টকশো আর লেখালেখি হচ্ছে সেখানে তার বক্তব্যের খুব প্রয়োজন নেই। তার সঙ্গে যদি যোগাযোগ করা সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে তার বক্তব্য নিলে ভালো হয়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সাংবাদিকদের উচিত ছিলো তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া। কেননা সাংবাদিকতার প্রথম কথাই হচ্ছে যার বিরুদ্ধে লেখা কিংবা কথা বলা হবে তার বক্তব্য নিতে হবে।
‘কেননা তিনি অপরাধী কিনা সেটা বিচারের দায়িত্ব সাংবাদিকের নয়। এটা আদালতের বিচার্য বিষয়। তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং তার বক্তব্য শুনে মানুষ বুঝতে পারবে তিনি আদতেই অপরাধী কিনা। পরে আদালতের চোখে অপরাধী হলে তিনি শাস্তি পাবেন, কিন্তু মিডিয়া ট্রায়াল গ্রহণযোগ্য নয়,’ বলে মন্তব্য করেন রোবায়েত ফেরদৌস।
তিনি নিজেিএকটি টকশো উপস্থাপনার বাইরে বিভিন্ন টকশোতেও নিয়মিত অংশ নেন।
একইরকম কথা বললেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক সজীব সরকার। তিনি বলেন, মাহফুজ আনাম ৯ বছর আগে যে ভুল করেছিলেন আজ নয় বছর পরে সাংবাদিকরা ঠিক একই ভুল করছেন।
‘তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই ইচ্ছেমতো টকশোতে কথা বলছি, লিখে যাচ্ছি। এটা সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতার পরিপন্থী,’ বলে মন্তব্য করেন সজীব সরকার।
ভুল স্বীকার করে মাহফুজ আনাম নৈতিকতার পরিচয় দিয়েছেন উল্লেখ করে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক মোঃ আসিউজ্জামান বলেন, সাংবাদিকতায় ৯৯ শতাংশ সঠিক কোন সংবাদ আসলে সংবাদ নয়। যতোক্ষণ পর্যন্ত ১০০ শতাংশ নিশ্চিত না হওয়া যাবে ততোক্ষণ পর্যন্ত সেটি ছাপানো নৈতিকতা বিরোধী। মাহফুজ আনাম সেই ভুলটিই করেছিলেন।
‘তবে আমরা এমন একটা সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করছি যেখানে ভুল স্বীকার করার অভ্যাস নেই। আমাদের রাজনীতিবিদরা বছরের পর বছর ভুল করেন। হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু কখনোই স্বীকার করেননি। আমি মনে করি মাহফুজ আনাম ভুল স্বীকার করে সাংবাদিক হিসেবে নিজের নৈতিক জায়গাটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন,’ বলে মন্তব্য করেন আসিউজ্জামান।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ
বিভাগের শিক্ষক আনিস আলমগীর বলছেন, এটা পুরনো ইস্যু। আর তিনি এটা স্বীকারও
করে নিয়েছেন। তাই এক্ষেত্রে তার আত্মপক্ষ সমর্থনে যে লাগবেই তেমনটা নয়।
যদি নতুন করে কিছু ঘটতো তাহলে বলতে পারতেন কেনো তার বক্তব্য নেওয়া হচ্ছে না।
‘তবে আমি এটা বলবো যদি তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় এবং তার বক্তব্য তুলে
ধরার সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে ভালো হয়,’ বলে মন্তব্য করেন এই সাংবাদিক এবং টকশো উপস্থাপক।
মাহফুজ আনামের ভুল প্রসঙ্গে সজীব সরকার বলেন, তিনি একটা ভুল করেছেন, আবার সেটি স্বীকারও করে নিয়েছেন। তবে তার উচিত ছিলো পরের দিনের পত্রিকায় একটা ব্যাখ্যা দেওয়া। কিন্তু আমরা সেটি দেখিনি।
‘তার ভুল আমরা ক্ষমা করবো কি না করবো সেটা আমাদের ব্যাপার। তার এ কাজের পেছনে যৌক্তিকতা কী ছিলো এবং ভবিষ্যতে তার পত্রিকা এ ধরনের কাজ আর করবে কিনা সে ব্যাপারটা পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন।’
সরকার বিষয়টিকে নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে অভিযোগ করে রোবায়েত ফেরদৌস বলেন: মাহফুজ আনাম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন। সরকার তাকে চাপে রাখার পাশাপাশি পুরো মিডিয়াকে একটা মেসেজ দিতে চাচ্ছে: যারাই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলবে তাকেই সমস্যায় পড়তে হবে।
সহমত দেখিয়ে আসিউজ্জামান বলেন, এটা আমরা আগে থেকেই দেখে আসছি সব সরকারই মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। আমরা ডেইলি স্টার-প্রথম আলোর ক্ষেত্রেও এবার সেটা দেখলাম। তাদের ওখানে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে বিজ্ঞাপন দিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। যদি সেটা সরকারের কোনো এজেন্সি করে থাকে তাহলে তার দায় অবশ্যই সরকারকেই নিতে হবে।
ভুল স্বীকার প্রসঙ্গে সজীব সরকার বলেন: আমরাতো ভুল স্বীকার করার সংস্কৃতিতে নেই। আমাদের রাজনীতিবিদরা বছরের বছর ভুল করে চলেছেন। কিন্তু তারা ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন এমন নজির নেই। সেখানে ভুল স্বীকার করে মাহফুজ আনাম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
আসিউজ্জামান বলেন, বাইরের দেশে দোষ স্বীকার করলে শাস্তি কম হয়। আবার কেউ যদি দোষ স্বীকার না করে পরে আদালতে গিয়ে দোষী প্রমাণিত হয় তাহলে শাস্তি বেশি হয়। কিন্তু মাহফুজ আনাম ভুল স্বীকার করে বেশি প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সাংবাদিকতায় নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি তুলে ধরে রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, মাহফুজ আনাম যে ভুল করেছিলেন এখন সাংবাদিকরা সেই একই ভুল আবারও করছেন। সেসময় তিনি যেমন শেখ হাসিনার বক্তব্য না নিয়েই ডিজিএফআইয়ের বক্তব্য ছেপেছিলেন, এখন সাংবাদিকরা ঠিক একই কাজ করছেন।
এ ইস্যুতে প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো জেলায় মামলা হচ্ছে। এর সমালোচনা করে সজীব সরকার বলেন, পত্রিকার ব্যাকগ্রাউন্ড ধরে যে কেউ মামলা করা করতেই পারে। কিন্তু যেভাবে মামলা হচ্ছে তাতে করে আমার মনে হচ্ছে কোনো রাজনৈতিক দল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যেভাবে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে ঠিক সেভাবেই সারাদেশে মামলা করা হচ্ছে। যদি মামলায় করা প্রয়োজন হয় তাহলে উচিত ছিলো একটা জায়গায় মামলা করে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া।