চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সবার জন্য উন্মুক্ত হোক

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার সংবাদ সবসময়ই বেকার তরুণদের কাছে এক নতুন আশার আলো। লাখ লাখ কর্মহীন, বেকার তরুণের এই দেশে মালয়েশিয়া এখনও স্বপ্নের এক দেশ। অনেককিছুর পরেও বেকার তরুণদের কাছে এই বিশ্বাস প্রোথিত যে মালয়েশিয়া গেলে খেটেখুটে কিছুটা হলেও ভাগ্য বদলানো যাবে। বেকারত্ব মোচন করে নিজ পরিবারে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করা যাবে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এই প্রবণতা বাড়ার আরো অন্যতম কার্যকর কারণ হলো- দু’ দেশের মধ্যে নিয়মিত উচ্চপর্যায়ের মিটিং-এর মাধ্যমে সমঝোতা স্মারক হওয়া, অভিবাসন ব্যয় তুলনামূলক কমিয়ে আনা, কর্মীদের কাজের নিশ্চয়তা এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া ইত্যাদি। এর বাইরে অন্যান্য ছোটখাটো অনুষঙ্গও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ঘিরে তরুণদের মাঝে এক ধরনের মোহজাল তৈরি করে রেখেছে।

মালয়েশিয়াতে যেমন আমাদের বিশাল এক শ্রম অভিবাসীরা কাজ করছেন, তেমনি এই দেশে কাজ করতে গিয়ে তরুণদের প্রতারিত হওয়া, জেল জরিমানার শিকার হওয়া, নিগৃহীত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অসংখ্য। কখনও কখনও এই বাজার ঘিরে চরম অব্যবস্থাপনাও চোখে পড়েছে। অদৃশ্য সব দেশী-বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বছরের পর বন্ধও থেকেছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে দীর্ঘ কূটনৈতিক তৎপরতা, দর কষাকষির পর ফের মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ঠিকই বাংলাদেশের নতুন সূর্য উদিত হয়েছে। নানা বাধা-বিপত্তির পরও বাংলাদেশী শ্রমিক নেওয়া অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু চরম সত্য কথা হলো এই শ্রম বাজার থেকে কালোমেঘ এখনও সরেনি। আর তাই স্বার্থান্বেষি মহলের অদৃশ্য লোভ এবং অপতৎপরতার কারণে অপ্রত্যাশিতভাবেই যেনো নানান ধরনের খড়ক নেমে আসার দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। ফলে নতুন করে শুরু হয় আতংক আর অশনি সংকেত।

বিএমইটির হিসেব মতে, এ বছরের জুন মাস পর্যন্ত মালয়েশিয়াতে ৯১ হাজার ৩ শত ৭৮ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। সব মিলিয়ে মালয়েশিয়াতে এখন বৈধ শ্রমঅভিবাসীর সংখ্যা ৯ লাখ ৭১ হাজার ৯৬২ জন। তবে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন স্থানে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা কোনোভাবেই ১৫ লাখের কম হবে না। এখনও প্রতিদিনই শ্রমিক যাওয়া অব্যাহত রয়েছে। মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশী শ্রমিক গমন শুরু মূলত আশির দশকে। ১৯৮৬ সালে প্রথম পযায়ে পাঁচশত শ্রমিক নেওয়া হয় প্লানটেশন কাজের জন্যে। এই ধারাবাহিকতায় দু দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে লোক নিয়োগ চুক্তি হয় ১৯৯২ সালে। সে বছর ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড এবং পাকিস্তানের সাথে ঐ একই প্রক্রিয়ায় শ্রমিক আমদানী শুরু করে মালয়েশিয়া। এই চুক্তির পর ৯৯ সাল নাগাদ প্রায় চার লাখ শ্রমিক কাজ করতে মালয়েশিয়াতে গমন করে। তবে নব্বই-এর দশকের মধ্যভাগে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ঘিরে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়। একপর্যায়ে মালয়েশিয়া শ্রমিক আমদানী থেকে বিরত থাকে। ২০০৬ সালে কলিং ভিসার মাধ্যমে মালয়েশিয়াতে আবার শ্রমিক গমন শুরু হয়। কিন্তু একই সাথে এই শ্রমবাজার ঘিরে একধরনের নৈরাজ্যও শুরু হয়। অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়, অবৈধ অনুপ্রবেশ, কম বেতনে শ্রমিক নিয়োগ, দালাল সিন্ডিকেট চক্রের খবরদারি, এক শ্রেণির শ্রমিকের সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া, কূটনৈতিক তৎপরতার ব্যর্থতা, হাইকমিশনের খামখেয়লীপনা, আনডকুমেন্টেড শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া-এরকম আরো অসংখ্য কারণে ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় বাংলাদেশ। নানা টানাপোড়নের মধ্যে দিয়ে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে পুনপ্রবেশের পথ তৈরি হয় ২০১২ সালে দু দেশের মধ্যে হওয়া চুক্তির মাধ্যমে।

২৬ নভেম্বর ২০১২ তারিখে মালয়েশিয়ার পুত্রাজায়ায় জনশক্তি রপ্তানির বিষয়ে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সাক্ষর সম্পন্ন হয়। মালয়েশিয়ার সরকারের পক্ষে সে দেশের মানবসম্পদ মন্ত্রী এবং বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী উক্ত সমঝোতা স্মারকে সাক্ষর করে। ফলে দীর্ঘ চার বছর বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়াতে কর্মী প্রেরণের পুন: সুযোগ তৈরি হয়। মালয়েশিয়াতে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বৈধ শ্রমিক ইন্দোনেশিয়ার। এরপর রয়েছে নেপাল। বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের বাংলাদেশের শ্রমিকদের ব্যাপক চাহিদাকে পুঁজি করে বর্তমানে জিটুজি প্লাস প্রক্রিয়ায় কর্মী প্রেরণের হরিলুটের উৎসব চলছে। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের উচ্চমহলের পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলে মালয়েশিয়াস্থ হাইকমিশনের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে দেশের গরিব অসহায় মানুষের কাছ থেকে কৌশলে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।

২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের একটি প্রভাবশালী সংঘবদ্ধ চক্র ৩৮ থেকে ৪০ হাজার টাকায় মালয়েশিয়ায় কমী প্রেরণের নামে দুই সরকারের মধ্যে বেসরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক প্রেরণের জন্যে চুক্তি করায়। এই চক্রটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ভুল বুঝিয়ে বারো শত রিক্রুটিং লাইসেন্সের মধ্যে থেকে মাত্র ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে জনপ্রতি গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা আদায় করা হয় এবং মেডিকেল ফি বাবদ নেওয়া হয়েছে আরো অতিরিক্ত টাকা। বর্তমানে এই ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সীর হাতেই সবকিছু। দেশের ১২ শত রিক্রুটিং লাইসেন্সের মধ্যে হতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যে ১০ রিক্রুটিং এজেন্সী মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ করছে সেগুলো হচ্ছে-বায়রার সাবেক সভাপতি গোলাম মোস্তফার প্রান্তিক ট্রাভেলস, নুর আলীর ইউনিক ইস্টার্ন, বর্তমান মহাসচিব, রুহল আমিনের ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, ব্যবসায়ী বদরুল আমীনের ক্যারিয়ার ওভারসিজ, রুহল আমিনের আমিন এন্ড ট্যুরস, আরিফুল ইসলামের এইএসএমটিস হিউম্যান রিসোর্স, শেখ আব্দুল্লাহর সানজারি ইন্টারন্যাশনাল, মো. বশিরের রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল, আরিফ আলমের প্যাজেস অ্যাসোসিয়েটস ও জয়নাল আবেদীনের আল ইসলাম ওভারসীজ।

এদিকে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে জিটুজি প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া যাওয়া কর্মীরা রিক্রুটিং এজেন্সীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেতন এবং অন্যান্য সুবিধাদি পাচ্ছে না। শুধু এই নয়, বাংলাদেশ থেকে যে ধরনের কাজের কথা বলে কর্মী পাঠানো হচ্ছে দেখা যাচ্ছে মালয়েশিয়াতে যাওয়ার পর এমন সব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ দেওয়া হয় যা শ্রমিকরা ভালভাবে করতে পারছে না। বিশেষ করে অনেক শ্রমিককে কমবেতনে দিনরাত পাথর কাটার মতো কঠিন কাজের সাথে সম্পৃক্ত করায় তারা ভীষণরকম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। অনেকেই এই কাজ ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসার আকুতিও জানাচ্ছে।

মালয়েশিয়া বরাবরই আমাদের জন্যে বড় এক জব মার্কেট। সোর্স কান্ট্রি হিসেবেও আমরা সে দেশ কর্তৃক অনুমোদিত। কিন্তু সবিমিলিয়ে আমরা সুযোগ কতোটা কাজে লাগাতে পারছি সেটিও দেখার সময় এসেছে। বর্তমানে যে পদ্ধতিতে মালয়েশিয়াতে শ্রমিকরা যাচ্ছে সেখানে অভিবাসন ব্যয় নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে এখনও আমাদের কর্মীদের জন্য সহনীয় খরচে যেতে না পারাটা খুবই দুঃখজনক। আমরা দেখেছি সেই বহুআগে থেকেই এই শ্রমবাজার পুরনো এক রোগে আক্রান্ত। বরাবরই অভিযোগ অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয় এই বাজারকে কলুষিত ও ধ্বংস করেছে। এখনও অনেকেই সহায় সম্বল বিক্রি করে দিয়ে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন, কিন্তু বিনিময়ে তারা তাদের খরচের টাকা তুলতে গিয়েই কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না। আমি মনে করি এই শ্রমবাজারে একটি স্বস্তি, আস্থা এবং বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করা দরকার। সেটা তৈরি করা না গেলে সামনে মহাবিপদেও পড়তে হতে পারে। এই শ্রমবাজারের সবচেয়ে বড় কলংক তিলক অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে এখন যে সব কথাবার্তা, বিতর্ক চলমান আছে তা অবসানে প্রধানতম কর্মসূচি হওয়া উচিত এই বাজারটি সবার জন্যে উন্মুক্ত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা একই সাথে অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনতে সর্বোচ্চ সদিচ্ছা, মমত্ববোধ এবং দেশপ্রেম দেখানো। মালয়েশিয়া কর্মী প্রেরণে অবশ্যই পূর্বের ভুল ত্রুটি মোকবিলা করে এই শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করতে হবে। সেক্ষেত্রে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে সহনশীল ব্যয়ের মাধ্যমে কর্মী প্রেরণ করাটাই এখন বড় কর্তব্য। আশা করি দু দেশের নীতি নির্ধারকগণ এ বিষয়ে আরো সহনশীল, সহমর্মী হয়ে সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)