চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মালালা : নারী শিক্ষার বিশ্বদূত

মালালা ইউসুফজাঈ পাকিস্তানের নারী শিক্ষা বিকাশে দুঃসাহসিক বীরের নাম। তালেবানি জঙ্গিদের রক্তচক্ষুর মধ্যেও  তিনি নারী শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিবিসি উর্দুতে ব্লগ লিখতেন। আর যার পরিণতিতে তালেবান জঙ্গিদের বন্দুক হামলার শিকার হন তিনি। তবে বিশ্বের মানুষদের অপরিসীম ভালোবাসায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসতে সক্ষম হন। এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন মেয়েদের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন।

পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমে তালেবানের শাসনের অধীন জীবন সম্পর্কে পাকিস্তানি স্কুল শিক্ষার্থী মালালা ইউসুফজাই ছদ্মনামে ডায়েরি লিখতেন। তার লেখালেখির ৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এর পরই তিনি জঙ্গিদের আক্রমণে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন এবং সর্বকনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।

মালালা ইউসুফজাঈ প্রথম মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তার হৃদয়গ্রাহী ডায়েরির মাধ্যমে, যা বিবিসি উর্দুতে প্রকাশিত হতো। এখানে শিক্ষা গ্রহণ করতে এবং মেয়েদের শিক্ষিত হওয়ার সুযোগের বিষয়ে তার আকাঙ্খার বিবরণ থাকতো। মালালা মাত্র ১১ বছর বয়সী ছিলেন যখন, তার ছদ্মনামে লেখা ডায়েরি পাঠকদের মুগ্ধ করে। তিনি গুল মাকাই নামে একটি ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। পশতুন লোক গাঁথার একজন নায়িকা গুল মাকাই।

সোয়ত উপত্যকায় তালেবানিরা ক্ষমতা দখলের পর জঙ্গিরা সেখানকার মেয়েদের অনেক স্কুল ধ্বংস করে দেয়। মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তাদের অতি রক্ষণশীল মনোভাব ছিলো এবং সেটাই ছিলো মালালার প্রধান চিন্তার বিষয়।

২০০৯ সালের জানুয়ারীতে তাদের স্কুলে শীতের ছুটি হলে তিনি লিখেছিলেন,’মেয়েরা তাদের ছুটির ব্যপারে আনন্দিত নয় কারণ তারা জানে যদি তালেবানেরা মেয়েদের শিক্ষা নিষিদ্ধের জন্য তাদের যে মনোভাব তা বাস্তবায়ন করতে পারে,তবে তারা আর কখনো স্কুলে আসতে পারবে না। আমার মনে হয় একদিন আবারো স্কুল খুলবে,কিন্তু যখন আমি স্কুল থেকে যাচ্ছিলাম তখন ওঐ ভবনের দিকে আমি তাকিয়েছিলাম যেনো আমি আর কখনো এখানে আসতে পারবো না।’

তিনি তার আশংকা প্রকাশ করেছিলেন,কারণ অনেক শিক্ষার্থীই জঙ্গিদের লক্ষ্য হওয়ার ভয়ে স্কুল থেকে ঝরে পরেছিলেন। তালেবানদের দৃষ্টিতে না পরার জন্য মেয়েরা ইউনিফরম না পরে অন্য পোশাকে স্কুলে আসা শুরু করেছিলো।

মালালা লেখালেখির জন্য সবসময় তার পরিবারের সমর্থন ও উৎসাহ পেয়েছেন। তার ব্লগ লেখার ধারণাটিও তার বাবা জিয়াউদ্দিন দিয়েছিলেন। তার বাবা একটি বেসরকারি স্কুল চালান। ভ্যানিটি ফেয়ার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি বিস্তৃতভাবে লেখা প্রোফাইলে সোয়াতের একজন শিক্ষক বলেছিলেন,মালালার বাবা তাকে মুক্তভাবে কথা বলতে এবং যত পারো শিক্ষা নিতে উৎসাহিত করেছিলেন।

মালালা যখন নারী শিক্ষার অধিকারের বিষয়ে আরো উচ্চকন্ঠ হয়ে পরেন তখন সোয়াতের একজন মেয়ে ব্লগার হিসেবে তার পরিচয় প্রকাশিত হয়ে যায়। ২০১২ সালের অক্টোবারে তালেবান বন্দুকধারীদের দ্বারা মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই তিনি পাকিস্তানে জনপ্রিয় এবং পরিচিত ছিলেন। কিন্তু ওই ঘটনা তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। এই বিভীষিকাময় আক্রমণ থেকে তিনি বেঁচে যান। এই হামলায় জঙ্গিরা উত্তর পশ্চিম পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় তাদের স্কুল বাসে হামলা করে এবং নির্বিচারে গুলি চালায়। এ হামলার ঘটনায় তার দুই স্কুল বন্ধুও আহত হয়।

পশ্চিমা বিশ্বের সাহায্য পেয়ে মালালা যুক্তরাজ্যে যান এবং বার্মিংহাম শহরের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে তিনি বিশেষ চিকিৎসা পান।  তার মাথার খুলিতে টাইটানিয়াম প্লেট এবং কর্ণভাগ প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে  শ্রবণের জন্য। পাকিস্তানি সামরিক হাসপাতালে সার্জারি এবং ‍যুক্তরাজ্যে পুনরায় অপারেশনের মাধ্যমে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। পরে যুক্তরাজ্যেই তিনি থেকে যান। পরবর্তী সময় তিনি বিশ্বজুড়ে প্রচারণা চালান এবং বিশ্ব মিডিয়ায় নজরে আসেন। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান এবং তার জীবন এতটাই বদলে যায়,যা তিনি কখনো কল্পনাও করতে পারেন নি।

২০০৯ সালে তাকে নিয়ে একটি প্রামাণ্য চিত্র নির্মিত হয়। ২০১১ সালে দ্য কিডস রাইটস ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারের জন্য তিনি মনোনীত হন। ২০১২ সালে পাকিস্তানের সরকার তাকে জাতীয় শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করে এবং পরবর্তী কালে এর নামকরণ করে জাতীয় মালালা শান্তি পুরস্কার যা ১৮ বছরের নিচের বয়স্যদের প্রদান করা হয়। ২০১৩ সালে তিনি টাইম ম্যাগাজিনের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষের মধ্যে একজন নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালেই নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ে তার সম্ভাবনা ছিলো। চিন্তার মুক্তির জন্য ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের শাখারোভ পুরস্কার জয় করেন এবং তার জীবনী ‘আই এম মালালা’ গত বছর প্রকাশিত হয় এবং তা ছোট কিশোরদের জন্য পুণর্মুদ্রন করা হয়েছে।

২০১৪ সালের ১০ ডিসেম্বর অসলোতে  নোবেল পুরস্কার গ্রহণের সময় তিনি বলেছিলেন,‘প্রথম পশতুন ভাষী এবং প্রথম পাকিস্তানি হিসেবে এই পুরস্কার জয় করতে পেরে আমি সম্মানিত এবং গর্বিত বোধ করছি।’ তিনি মজা করে এও বলেছিলেন,‘যে সম্ভবত আমিই প্রথম নোবেল জয়ী যে এখনো তার ছোট ভাইদের সঙ্গে মারামারি করে।’

বতর্মানে এজবাস্টস হাই স্কুলে তিনি অধ্যয়ন করছেনএবং তার বাবাকে বার্মিহামের পাকিস্তানি দূতাবাসে তিন বছরের জন্য একটি কাজ দেয়া হয়েছে।

মাত্র চার বছর আগে ব্লগে লেখা থেকে অনেক দূরেই অবস্থান এখন মালালার। তিনি বলেন, আজ আমি বিবিসিতে আমার উর্দুতে লেখা এখনো পড়ি । আমার মা গুল মাকাই নামটি পছন্দ করেন। আমিও নামটি পছন্দ করি। কারণ আমার আসল নামটির অর্থ ‘দুঃখ পিড়ীত’।