টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলা। আগামী ৩১শে মার্চ এ উপজেলায় অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। ৬টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এ উপজেলার আয়তনের প্রায় অর্ধেকটা যমুনার চরাঞ্চল দিয়ে ব্যষ্টিত।
আগামী ৩১ মার্চ এই ৬টি ইউনিয়নে ১ লাখ ২৩ হাজার ১৭ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টির দলীয় ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে ২৬ জন চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যস্ততা। নিজ নিজ প্রতীক নিয়ে রাত-দিন ছুটে চলছেন ভোটারদের কাছে। প্রাণ খুলে মেলে দিচ্ছেন উন্নয়ন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি। সাধারণ ভোটারগণও হিসাব-নিকাশে পার করছেন ব্যস্ত সময়। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলেও সাধারণ ভোটারগণ মাথায় রাখছেন প্রার্থীর অতীত-বর্তমান কর্মকান্ড। তারা মনে করছেন স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হলেও ব্যক্তি ইমেজের কারণে জিততে পারে যে কেউ।
নির্বাচনে বিএনপি একক প্রার্থী দিলেও প্রতিটি ইউনিয়নে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে রয়েছে একাধিক প্রার্থী। এছাড়াও দু’টি ইউপিতে প্রার্থী চুড়ান্ত করেছে জামায়াত। মাত্র একটি ইউনিয়নে প্রার্থী দিতে সক্ষম হয়েছে সংসদের প্রধান বিরোধী দল এরশাদের জাতীয় পার্টি। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সকল বিদ্রোহী প্রার্থীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও তা ভোটের মাঠে তেমন প্রভাব পড়ছে না বলেই মনে করছেন সাধারণ ভোটারগণ। আর এ নিয়ে অনেকটা বিপাকে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনীত প্রার্থীরা। অন্যদিকে দু’টি ইউনিয়নে বিএনপি’র ভোটে জামায়াত ভাগ বসালেও তাদের বড় ভয় সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে।
অর্জুনা ইউনিয়নঃ আগের মতই এ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী মোল্লা (নৌকা)। এ ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুজ্জামান খান তুহিন (আনারস)। ইউনিয়নটিতে বিএনপি’র একক প্রার্থী হয়েছেন মো. নাসির উদ্দিন (ধানের শীষ)। গত নির্বাচনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতার পর অল্প ভোট ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আইয়ুব আলী মোল্লার কাছে হেরে যান বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মো.নাসির উদ্দিন। তবে এবার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় এ ইউনিয়ন নিয়ে টেনশনে রয়েছে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড। তারপরও বিএনপি প্রার্থী মো. নাসির উদ্দিন ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত বর্তমান চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী মোল্লার মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে। ইউনিয়নটিতে ১৯ হাজার ৮২৫ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
গাবসারা ইউনিয়নঃ চারাঞ্চলের এ ইউনিয়নে বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন মনিরুজ্জামান মনির (নৌকা)। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে এবার তাকে দলীয় মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। ইউনিয়নটিতে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন শাহ আলম শাপলা (আনারস)। বিএনপি’র একক প্রার্থী হয়েছেন গাবসারা ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারন সম্পাদক খন্দকার আখতারুজ্জামান (ধানের শীষ)। তবে এ ইউনিয়নে সবচেয়ে বড় চমক হচ্ছে জামায়াত প্রার্থী সাংবাদিক এসএম মনিরুজ্জামান (মোটরসাইকেল)। এ ইউনিয়নে ব্যক্তি ইমেজে জয়ী হতে পারেন যে কোন প্রার্থীই। এ ইউনিয়নে ২০ হাজার ৭ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
ফলদা ইউনিয়নঃ এ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দলীয় টিকিট পেয়েছেন জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শামছুল হক তালুকদারের ভাই সাইদুল ইসলাম ইসলাম তালুকদার দুদু (নৌকা)। বিগত ইউপি নির্বাচনে দলীয় টিকিট না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবার দলীয় মনোনয়ন নিয়ে তিনি মাঠে নেমেছেন। আর বিএনপি’র মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা বিএনপি’র সাধারন সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলু (ধানের শীষ)। তবে সাইদুল ইসলাম তালুকদার দুদুর মূল সমস্যা আওয়ামী লীগের দুই বিদ্রোহী প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা মফিদুল ইসলাম লিটন ( ঘোড়া) ও আকবর হোসেন (আনারস)। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আকবর হোসেনের ক্লিন ইমেজ ও নিজস্ব ভোট ব্যাংক থাকায় অনেকটা এগিয়ে রয়েছেন তিনি। এ ইউনিয়নে সাইদুল ইসলাম ইসলাম তালুকদার দুদু, সেলিমুজ্জামান সেলু ও আকবর হোসেনের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই হবে। ইউনিয়নটিতে ভোটার সংখ্যা ১৬ হাজার ৯৩৪ জন।
গোবিন্দাসী ইউনিয়নঃ ভূঞাপুর উপজেলার প্রাণ কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত গোবিন্দাসী ইউনিয়ন। গত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকরাম উদ্দিন তারা মৃধা। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম আমিন। আর বিএনপি’র একক প্রার্থী হন উপজেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু। কিন্তু সবাইকে টেক্কা দিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আমিনুল ইসলাম আমিন। এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান ৪ জন প্রার্থী। বর্তমান চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম আমিন, ইকরাম উদ্দিন তারা মৃধা, দুলাল হোসেন চকদার ও মীর শাহীন হোসেন আরজু। সবাইকে পিছনে ফেলে দলীয় টিকিট হাতিয়ে নেন মীর শাহীন হোসেন আরজু (নৌকা)।
গত নির্বাচনের মত এবারও ক্ষোভে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম আমিন (আনারস)। এদিকে এবারও বিএনপি’র দলীয় মনোনয়নে প্রার্থী হয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু (ধানের শীষ)। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আবুল কালাম আজাদ (মোটরসাইকেল)। এ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মীর শাহীন হোসেন আরজু, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম আমিন ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান বাবলুর মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই হবে।
অলোয়া ইউনিয়নঃ এ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দলীয় টিকিটে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম (নৌকা)। তবে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বেশি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন ইউনিয়নটিতে। এদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. রহিজ উদ্দিন আকন্দ (মোটরসাইকেল), ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মো. লিটন মিঞা (আনারস), গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মর্তুজ আলী (চশমা) ও সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের পুত্র ওয়াহেদুজ্জামান পলাশ (ঘোড়া)। এদিকে ইউনিয়নটিতে বিএনপি’র একক প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন উপজেলা বিএনপি’র সাবেক যুব বিষয়ক সম্পাদক আরিফুল ইসলাম রফিক (ধানের ধীষ)। এছাড়াও উপজেলার একমাত্র জাতীয় পার্টি প্রার্থী হিসেবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন লিয়াকত আলী ( লাঙ্গল)। সব মিলিয়ে এ ইউনিয়নের অবস্থা হ-য-ব-র-ল।
নিকরাইল ইউনিয়নঃ এ ইউনিয়নে বিএনপি’র একক প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারন সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মন্ডল (ধানের শীষ)। অপরদিকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিন সরকার (নৌকা) দলীয় মনোনয়ন পেলেও বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান মোতালেব সরকার (আনারস)। গত নির্বাচনে বিএনপি’র দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি সাবেক চেয়ারম্যান রমজান আলীকে। আর আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয় সাবেক চেয়ারম্যান মোতালেব সরকারকে। বিএনপি’র দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন মো.জাহাঙ্গীর হোসেন মন্ডল। দুই প্রবীন রাজনীতিবিদ মোতালেব সরকার ও রমজান আলীকে পিছনে ফেলে বিপুল ভোটের ব্যবধানে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তরুণ রাজনীতিবিদ জাহাঙ্গীর হোসেন মন্ডল। তবে এবারের চিত্রটা পুরোটাই বিপরীত। বিদ্রোহী প্রার্থী মোতালেব সরকারকে নিয়ে যেমন বিপাকে পড়েছেন আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনীত প্রার্থী মতিন সরকার, তেমনি বিএনপি প্রার্থীর মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী শামীম আল মামুন ( মোটরসাইকেল)। কেননা এ ইউনিয়নে জামায়াতের রয়েছে বেশ কিছু রিজার্ভ ভোট। শেষ পর্যন্ত বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মন্ডল, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মতিন সরকার ও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুনের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই হবে বলে মনে করছেন সাধারন ভোটাররা।
চেয়ারম্যান প্রার্থী ছাড়াও এ উপজেলায় সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ৫৯ জন ও সাধারণ সদস্য পদে ১৮০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। ৬টি ইউনিয়নে ১ লাখ ২৩ হাজার ১৭ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬২ হাজার ২৪১ এবং মহিলা ভোটার ৬০ হাজার ৭৭৬। নির্বাচনে ৬টি ইউনিয়নে ৫৭ জন প্রিজাইডিং অফিসার, ৩৪৩ জন সহকারি প্রিজাইডিং অফিসার ও ৬৮৬ জন পোলিং অফিসার দায়িত্ব পালন করবেন। ভূঞাপুরে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন উপজেলা নির্বাচন অফিসার মো. রফিকুল ইসলাম।