আজ সকালে তুমি যে প্রৌঢ়কে কুপিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে জীবনটা নিয়ে নিলে, তুমি জানো না সে গতকাল শেষ রাতেও স্বপ্ন দেখেছিলো, আজ খুব ভোরে উঠে সবার অলক্ষ্যে বহু দূর সবুজ ঘাসে পা ডুবিয়ে দূরের আকাশটা দেখতে যাবে প্রিয় দু’টি হাতে হাত রেখে আরও একবার। ভেবেছিলো প্রিয় সন্তানকে বারান্দায় বসে চারিদিকের শেষ বিকেলের সোনা আলো আভা মেখে বলে যাবে ‘ভোরের শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে পা মাড়াতে কি ভালো লাগে তার’!
শুধু জেনো যে যুবকটিকে তুমি কাল খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেললে, সে খুব করে স্বপ্ন দেখেছিলো আরও একদিন ওই সবুজ পাহাড়ে যাবে, বিশাল চূড়াটায় দাঁড়িয়ে বুকে হাত দিয়ে বলবে, ভালোবাসি এই সব সৃষ্টি, ভালোবাসি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও তার স্রষ্টা, তুমি সেটা দিলে না ঘাতক!!!
হায় হৃদয়হীন মানুষ, কেনো করছ, কার জন্যে করছ এই সব, চোখ মেলে তাকিয়ে দেখো, তোমার জন্যে কত কিছু অপেক্ষা করে আছে, অনন্ত নক্ষত্র বীথিতে কত অযুত নিযুত কোটি কোটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছড়িয়ে আছে, তুমি তার একটা অংশ মাত্র, কে তোমায় বোঝাবে, অন্য একটা জীবন, অন্য একটা অচেনা মানুষ এবং তার পৃথিবী ধবংস করা তোমার কাজ হতে পারে না।
আজ আমি আছি, বেঁচে আছে আমার পৃথিবীর স্রষ্টা। আমি ঘুমাতে যাবো কালকের একটা ভোর দেখার আশা নিয়ে, আমার সন্তানের মায়াময় মুখটা ছোঁবো বলে কাল। আমি এই স্বপ্নটা বাঁচিয়ে রাখতে চাই বলেই, কাল আমি এই সব ‘মৃত্যু মিছিল’ ভুলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কোনো সুর মূর্ছনায় দিন ভরাবো, কাটিয়ে উঠবো শোক। ঠিক যেমন করে ঢাকায় কোনো এক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসা সংবাদ পাঠিকা একের পর এক মৃত্যু সংবাদ দিয়েও মুচকি হেসে পরের খবরটা পড়ে দেন ঠিক ঠাক। ঠিক যেমন করে উত্তরায় থাকা এক ভদ্রলোক সারাদিন অফিসে অনেক অনেক মাথা ঘামানো কাজ সেরে ঘরে ফিরে প্রিয়তমার মিষ্টি মুখের হাসি দেখে নিজের অজান্তেই বলে উঠেন, হায় ঈশ্বর এতো সুন্দর, এতো সুন্দর জীবন আমার, ভালোবাসি তোমায় জীবন!!!
আচ্ছা, যে তুমি তোমার অদৃশ্য গুরুর আদেশে ঘটাও ‘হত্যাযজ্ঞ’, খুব জানতে ইচ্ছে করে – তোমাকে শেষ কবে তোমার মা তোমার প্রিয় খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলেছিলেন, বাবা রে নিজের দিকে একটু দেহস না কেন, শুকায়ে কেমন হইছিস!
তুমি কি জানো তোমার ছোট বোন অন্য ঘর থেকে ভীষণ ভীরু চোখে তোমাকে দেখে লুকিয়েছে বুকের মাঝের জমে থাকা কান্না সেই শেষবার। দলা পাকানো কান্না লুকিয়ে প্রিয় বন্ধুকে বলেছে তোমার বদলে যাওয়ার গল্প, সে বলেছে আজ যে উদ্ভ্রান্ত চোখে তোমার বোন তাকাতে ভয় পায়, সেই তোমাকেই নাকি চুল টেনে টেনে কি উত্যক্ত করতো। তুমি কপট রাগে বোনকে দেখে নেয়ার কথা বললেও, দিন শেষে বোন খেয়ে ঘুমিয়েছ কিনা মাকে জিজ্ঞেসও করতে।
এমন বদলে যাওয়া চারপাশ, তবে কি বাবারা আর মায়ের হাত ধরে কোথাও বেড়াতে যাবে না আর? তবে কি আর কোনো বোন ভাইকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদ করবে না ‘ভাবী না এলে যাবো না পরের ঘরে’? তবে কি বন্ধুর চোখে বন্ধু তাকিয়ে বলবে না সব সব না বলা কথা? এতো অবিশ্বাস, এতো নিষ্ঠুরতার অধ্যায়, এতো নীরবে চলে যাওয়া প্রতিদিন, এর তো কোনো উত্তর নেই, শুধুই গুমরে গুমরে চেপে যাওয়া ছাড়া!
আজকের বাংলাদেশে, কী নির্মমভাবে একটা করুণ সুর বেজে চলেছে ‘খোদার ঘরে নালিশ করতে দিল না আমারে, পাপ পুণ্যের বিচার এখন মানুষই করে’!
কেনো বলছি, কাকে বলছি জানি না, আমি সত্যি জানি না, শুধু এইটুকু জানি, কাউকে না কাউকে বলে যেতে হবে, বলতেই হবে আমৃত্যু। এই বিশ্বাস রাখতে হবে, মানুষ জাগবে, জাগবেই ‘মনুষ্যত্ব’।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)