উত্তরায় নিজ বাসায় গ্যাস বিস্ফোরণে স্বামী ও দুই সন্তানকে হারানো গৃহকর্ত্রী সুমাইয়া আক্তার শোনালেন মানবিকবোধহীন কিছু মানুষের কথা। আর বহুল প্রচারিত- ‘অসতর্কতাবশত গ্যাসের চুলার সুইচ অন রাখায় এই মর্মান্তিক ঘটনা’ ধারণাটির প্রতি বড় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিলেন।
৯০ শতাংশ দগ্ধ শরীর নিয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা সুমাইয়ার (৩৫) বক্তব্যের অডিও ক্লিপটি ফেসবুকে শেয়ার করেছেন তার চাচাতো ভাই ব্যাংক কর্মকর্তা খিরকিল নেওয়াজ। সোমবার রাতে বহু কষ্টে, থেমে থেমে, খসখসে কন্ঠে দেয়া সুমাইয়ার বক্তব্যের পাশাপাশি দুর্ঘটনাস্থলের একটি ভিডিও ক্লিপ এবং স্ট্যাটাস দিয়ে তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতে এবং ন্যায্য বিচারের স্বার্থে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানান।
শুক্রবার (২৬-০২-১৬) সকালে সংঘটিত মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটিতে বিপর্যস্ত পরিবারটি হারিয়েছে কর্তা প্রকৌশলী শাহীন শাহনেওয়াজ (৫০) ও দুই সন্ত্বান সারলিন বিন নেওয়াজ (১৫) এবং জায়ান বিন নেওয়াজকে (১)। অপর সন্তান জারিফ (৯) প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বর্তমানে আশঙ্কামুক্ত রয়েছেন। মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিট থেকে সিটি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় সুমাইয়াকে।
নতুন ভাড়া নেয়া উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ৮ নম্বর বাড়ির সপ্তম তলার ফ্ল্যাটটি থেকে শরীরে আগুন নিয়ে নেমে আসার সময় প্রত্যক্ষদর্শী কেউ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। এমনটি জানিয়ে বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করেন সুমাইয়া। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসার চিরন্তন রূপটিও ফুটে উঠে তার বক্তব্যে। “সারলিনের গায়ে, পায়ে থকথকে হয়ে গেছে। সারলিন বলে, আম্মু আমি তো বাঁচবো না। আমাকে মাফ করে দিও। আমি বলি বাবা তুই বাঁচিস। আমি মইরা যাই। মানুষ এরকম হয়? কেউ একটু সাহায্য করে না।”
চুলার গ্যাসের লাইন থেকে নয় অন্য কোন লাইন থেকে গ্যাস লিক হয়েছিলো বলে তার বক্তব্যে প্রতীয়মান হয়। “গ্যাস ডাইনিংয়ে আর সারলিনের রুমে ছিলো। রান্নাঘরে ছিলো না। এমনকি রান্নাঘরের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি।”
৮ মিনিট ২ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপটিতে সুমাইয়া আরও বলেন, ডাইনিং রুমটা গ্যাসে ভরা ছিলো। চুলায় কোন লিক নাই। গ্যাসের সমস্যা ডাইনিংয়ে। সারলিনের রুম রান্নাঘরের পাশেই ছিলো। সারলিনের রুমটা বদ্ধ ছিলো। জানালাগুলা মনে হয় আটকানো ছিলো।
ফেসবুকে খিরকিল নেওয়াজের স্ট্যাটাসেও পাওয়া যায় তেমনই আভাস। পোস্ট করা ভিডিওটিতে দেখা যায় রান্নাঘরেই রয়েছে বিশাল বড় একটি জানালা আর তার উপরে ভেন্টিলেটর। তিনি লিখেন, রান্না ঘরের জানালার ঠিক উপরে প্রায় দেড় ফুট বর্গাকৃতির ফাঁকা জায়গা! চুলার গ্যাস কি এতো বড় ফাঁকা জায়গা দিয়ে সারারাত ধরে চলে যাওয়ার কথা না? যা কিনা গ্যাসের সাধারন ধর্ম! অথচ মিডিয়া, পুলিশ, তিতাস বিষয়টা এড়িয়ে গেলেন কি?
তিনি আরও লিখেন, গোপন অবৈধ গ্যাস লাইনেই কি লিকেজ ছিলো? গ্যাসের চুলার সুইচ অন রাখার কারণে যে দুর্ঘটনাটি ঘটেনি তা ভিডিও ক্লিপ দেখেই নিশ্চিত হওয়া যায়। এর দায় কে নেবে? রাজউক, তিতাস না বাড়ির মালিক/ফ্ল্যাটের মালিক?
আগুন লাগার সময়টার ভয়ঙ্কর সেই মুহুর্তটার বর্ণনায় সুমাইয়া বলেন, চুলা অল্প জ্বালাইয়া চায়ের পানি দিছি। অর আব্বু (শাহীন শাহনেওয়াজ) বলে আমি পৌনে সাতটায় বেরিয়ে যাবো। নামাজ পরে চায়ের পানি দিছে। তখন কোন সমস্যা নাই। আব্বু (শাহীন শাহনেওয়াজ) বলেকি ঘরে গ্যাসের গন্ধ আসে। ফ্যানটা ছাইড়া দে। আর জানালাগুলা খুইলা দেয়। যেই ফ্যানটা ছাড়ছে আমি চুলার কাছে গেছি। সাথে কইরা আব্বু (শাহীন শাহনেওয়াজ) জায়ানরে কোলে নিছে। আর দাউ দাউ কইরা সেকেন্ডের মধ্যে এতো আগুন।
অগ্নিকান্ডের ঘটনার পরে শরীরে আগুন নিয়ে সাত তলা থেকে নিচে নেমে আসার সময় কেউ তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে নি জানিয়ে সুমাইয়া বলেন, আমি আর সারলিনের আব্বু নাইমা আসছি। পিচ্চিটা কোলে। দৌড়ায় নামছি আর চিৎকার করতেছি। আগুন জ্বলতেছে। ওইসময় ঘরে পুরা আগুন। তিন নাম্বার ফ্লোর, চার নাম্বার ফ্লোর দড়জা খুলছে। খুইলা আমাদের দেইখা দরজা আটকায় দিছে। স্পষ্ট মনে আছে। দরজা খুইলা দেখে আগুন লাগা মানুষ নামতেছে আর দরজা আটকায় দেয়, কতটা অমানবিক চিন্তা করেন।
সন্তান বা স্বামীর মৃত্যুর খবর সুমাইয়াকে জানানো না হলেও তিনি হয়তো তেমনটিই ধারণা করে নিয়েছেন। মানুষের নির্লিপ্ততায় বিস্মিত ও সন্তানকে বাঁচাতে না পারার অসহায় উচ্চারণ তার কন্ঠে, “তিনতলার মানুষটাতো একটু তোষক দিয়ে জড়ায় ধরতে পারতো। নাইলে একটা তোষকই যাইতো। আমার বাচ্চাগুলাতো বাঁচতো।”
নিচে নামতে নামতে সুমাইয়ার গায়ের কাপড় সম্পূর্ণ জ্বলে যায়। নিচে নেমে পরে থাকা ছালার চট গায়ে জড়ান তিনি। সেই সময়টিতেও একটি চাদরও কেউ এগিয়ে দেননি। সুমাইয়া বলেন, ‘কত মানুষ, সবাই তাকায় রইছে। কেউ আগায় না। বলি কি একটা চাদর দেন আমাদের গায়ে। আমি মহিলা মানুষ। আমার গায়ে একটা চাদড় দেন। কেউ দেয় না। বিল্ডিংয়ের মহিলারা কেউ দেয় না।’
সারলিন এবং জারিফও একা একা সাত তলা থেকে দৌড়ে নিচে নামেন। তাদেরও সাহায্য করার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। বাড়িওয়ালা সামনের অন্য একটি বিল্ডিংয়ে থাকেন বলে জানান তিনি।