“ধর্ষণ শরীরের কষ্ট ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। ব্যথার ওষুধের সাথে সাথে এ কষ্ট চলে যায়। মানুষের সম্মান তার যোনিতে থাকে না। তাই ধর্ষণে কারো সম্মান যায় না।” শুধু এই কথাগুলো আপনার সন্তানের মনে গেথে দিন। ওর গায়ের জোর দশ গুন বেড়ে যাবে। ধর্ষিতার আত্মহত্যার প্রবণতা কমে যাবে। আর হ্যাঁ, সন্তানকে বলার আগে আপনি নিজে কথাগুলোকে বিশ্বাস করুন মনে প্রাণে। জীবন একটাই। অপরের অন্যায়ে সে জীবন নষ্ট হবার নয়, থেমে যাবার নয়।
গত শনিবার বাতিঘরের যে ক্লাসে “আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী…” গান শেখাবার কথা ছিল, সে ক্লাসে আমাকে ঢুকতে হল এ কথা বলতে – “তোরা হয়ত এখনো জানিস না, পৃথিবীতে কিছু খারাপ মানুষও আছে, আর তাদের থেকে ছোটদেরকেও সাবধান থাকতে হয়”।
আট-ন’ বছরের শিশুদেরকে আমার শেখাতে হচ্ছে “সকল মানুষকে বিশ্বাস করতে নেই”। মানুষ হয়ে জন্মাবার এটাই হয়ত সবচেয়ে বড় শাস্তি ঈশ্বর আমাকে দিলেন।
ক্লাসটা ছিল ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ নিয়ে! হ্যাঁ, নয় থেকে চৌদ্দ বছরের শিশুদের সাথেই! দয়া করে যারা লেখাটি পড়ছেন তারা স্তম্ভিত হবেন না।
বাতিঘরের যে ক্লাসটি আমি নেই তার নাম বিশ্বপরিচয়। যে শ্রেণীতে নিচ্ছিলাম তার নাম আনন্দ (সবুজ)। ছাত্র-ছাত্রী এক সাথে তো বটেই ক্লাসে দু ভাই-বোনও আছে। গত দুই বছরে আমি ওদের কাছে অনেকখানি ওদের মায়ের মত। ঠিক যেভাবে পুরো ক্লাসটি নিয়েছি সেভাবেই হুবহু এখানে তুলে দিচ্ছি-
– কেমন আছিস আজ তোরা?
– অনেক ভালো আছি। তুমি?
– আমি তো খুব বেশি ভালো নেইরে সোনা।
– ক্যান?
– সে কথা পরে বলি আগে ক্লাস শেষ করি?
– আচ্ছা।
– তোরা তখনও জন্মাসনি তাই তোরা দেখিসনি, তোদের মা-বাবার বিয়েটা কি ধুমধাম করে নানা-নানু, দাদা-দাদু আর তাদের অনেক বন্ধু মিলে দিয়েছিল।
– আমরা তো ছবি দেখেছি। অনেক মজা হয়েছিল।
– দেখেছিস, বাহ। তারপর তোদের মা-বাবা একদিন দু’জন দুজনকে ভালবেসে স্রষ্টার কাছ থেকে তোদের চেয়ে নিল।
– জানি তো।
– এটাও জানিস? বাহ। আচ্ছা, এখন তো মামনি আর বাবা সবসময় একসাথে ঘুরতে যায়, হাত ধরে, গল্প করে, একসাথে ঘুমায়, তোদের আদর করে। কি সুন্দর সম্পর্ক তাই না?
– অনেক সুন্দর, আমাদের অনেক আদর করে দুজন মিলে।
– কিন্তু পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যারা তাদের মা-বাবা বন্ধুদের সাথে নিয়ে একটা মেয়েকে বিয়ে না করেই, মেয়েটার অমতেই তাকে নিয়ে ঘুরতে চায়, গল্প করতে চায়, ঘুমাতে চায়। (অস্বীকার করব না ঠিক এই কথাগুল বলার সময় আমার গলাটা একটু কাঁপছিল)।
– কেন??
– ঐ যে বলেছি পৃথিবীতে কিছু খারাপ মানুষও আছে। তারা কারো মতের বা খুশির তোয়াক্কা করে না। আচ্ছা এখন আরও বড় কঠিন কথা শোন। সেই খারাপ মানুষগুলো সবসময় শুধু বড় বয়সের মেয়েদের সাথেই যে এমন করে তা নয়।
– তাহলে?
– কখনো কখনো তারা তোদের মতো ছোট ছোট মেয়েদের সাথেও অমন করতে চায়।
– কি বল?!!! gasp emoticon- যা বলি খুব করে মনে গেঁথে নে। কেউ কেউ তোদের খুব আদর করার ছলে কাছে ডাকতে পারে। আপনজন ছাড়া তাদের কাছে না যাওয়াই ভালো। আর অপরিচিত জায়গায় তো অপরিচিত মানুষের সাথে কখনোই নয়।
ফারদিন (ছাত্র) – তাহলে কি রোদেলাকে (ওর বোন) আমি কারো কোলে বসতে দেব না?
– নিশ্চয়ই দিবি। সব মানুষ কি খারাপ হয়? খুব অল্প মানুষ খারাপ হয়। তাদের স্পর্শ টের পাবি তোরা। তেমন বুঝলে সাথে সাথে মা কে বলবি। খুব কাছের আত্মীয় হলে মা যদি বিশ্বাস নাও করে বা বলে তোমার ভুল হচ্ছে তবুও মাকে বলবি যে তুই ভালো ফিল করছিস না তার স্পর্শে। মা-বাবারা তো তোদের সব কথা বোঝে। তোদের সবথেকে বড় বন্ধু তারা, তাদের কাছে সব বলে ফেলবি। এখন আরও একটা কঠিন কথা বলি?
– আরও কঠিন কথা?
– হ্যাঁ রে সোনা, আরও কঠিন। সেই খারাপ মানুষগুলো শুধু যে ছোট বড় মেয়েদের সাথে এমন করে তাও কিন্তু না। তাদের কেউ কেউ তোদের বয়সী ছেলেদের সাথেও অমন করতে চায়। বাজেভাবে জড়িয়ে ধরতে চাবে, তোদের পার্সোনাল পার্টস এ হাত দিয়ে তারা বাজে রকম আনন্দ পায়!
– সত্যি? কি বল?
– সত্যি। কিন্তু সবচেয়ে বড় সত্য হোল এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। পৃথিবী ভর্তি শুধু ভালো মানুষ। কিন্তু তবুও আমাদের সাবধান হতে হবে।
আর তার থেকেও বড় সত্যি, কোনদিন অন্য কারো অপরাধের কারণে নিজেকে দায়ী মনে করবি না। কেউ যদি তোদের সাথে এমন করে, তোদের শরীরে কষ্ট দেয় তবে……. উঠে দাঁড়াবি, এটা শরীরের কষ্ট ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। ব্যথার ওষুধের সাথে সাথে এ কষ্ট চলে যায়। এ বিষয়ে যত অপমান যত শাস্তি যত ঘৃণা শুধু তার জন্য যে এই কাজ তোর সাথে করেছে। তুই গায়ের ব্যথাটা ওষুধ দিয়ে সেরে ফেলবি আর মনের সব শক্তি এক করে সকল সত্য কথা প্রথমে মার কাছে তারপর আইনের কাছে বলবি। পারবি না?
– পারবো খালামনি। তুমি বলেছ, আমরা ঠিক পারবো।
ক্লাস শেষে তাকিয়ে দেখি আয়াত (ছাত্র) তার বোন তাসবিহকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। নিষাদ নিজের সিট ছেড়ে ততক্ষণে আমার কোলে। বৈশাখী, রিমঝিম দুই বান্ধবীও তাদের দুজনের হাত শক্ত করে ধরে। আর আমাদের অন্বয়! সে হাসি মুখে আমাকে বলল
– তুমি না বললে আমাদের লজ্জা না পেতে। লজ্জা পাবার কথা কোনটা ছিল?
সে সকল কথা সহজ ভাবে নিয়েছে। কোন কোথায় সে লজ্জা পায় নাই!! কি আনন্দ আমার।
কথাগুলো সহজভাবেই বলতে হবে, সহজভাবেই নিতে হবে। সময়টা কঠিন। একে পার করতে হবে একে অপরের হাত ধরে। পৃথিবীটা সুন্দর। কিছু পথভ্রষ্ট মানুষ পৃথিবীটাকেও তাদের সাথে ভুল পথে নিতে চাচ্ছে। সে পৃথিবীর সিঁড়িতে আপনি আপনার শিশুর হাত শক্ত করে ধরে থাকুন। ওকে সাবধানে ওপরে উঠতে দিন।
ক্লাস শেষ করে আমি বের হতেই ওদের আটকে থাকা গানের ক্লাস শুরু হয়েছে। সমস্বরে ওরা গাচ্ছে-“আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী…” কথা তো মিথ্যে নয়- আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরীই বটে। এখানে একদিন স্বপ্নের চারাগুলো বড় হবে, ফুল ফোটাবে। সেই পর্যন্ত একটু সাবধান হয়ে………. একে অপরের হাত ধরে…. ব্যাস।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)