মানুষ নানারকম বিষয়আশয় আকড়ে ধরে বেঁচে থাকে। এই নানারকম বিষয়ের মধ্যে বিশেষত সংস্কৃতির যে অঙ্গন, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর গান- মানে যারা সংগীতচর্চা করেন তারা এবং যারা সংগীতের শ্রোতা, তাদের বলয় কিন্তু আরো বিশাল। কারণ পৃথিবীর সর্বাধিক মানুষই কিন্তু সংগীতপ্রেমী। সংগীত শুনেন না, বা পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। গানের মতো এত জনপ্রিয় অঙ্গন, কিংবা শিল্প সাহিত্য, খেলাধুলা, কবিতা- এসব যখন দমে যায়, তখন আর কী থাকে! মূলত একটা জাতিই থমকে যায়, এসব না হলে। তো করোনাকালে গুটা পৃথিবীটাই যেন থমকে গিয়েছিল, দমে গিয়েছিল। আমরা সেটা খুব ভালো করে প্রত্যক্ষ করেছি।
নতুন একটা পৃথিবী আমরা এখন দেখছি, সব নতুন। নতুন প্রযুক্তি, নতুন সব কিছু। এই ৭/৮ মাসে একটা আমূল পরিবর্তন দেখেছি। আমি নিজে সংগীতশিল্পী, আমি দেখেছি- যখন সংগীত শিক্ষার্থীদেরকে শেখাতাম, তাদের জন্য আমার যে স্কুলটা সুরসপ্তক- করোনার আগে পর্যন্ত একটা দারুণ যাতায়াত ছিল সবার, রমরমা ব্যাপার ছিল। সবাই আসছে, যাচ্ছে। কী হলো, যখন করোনার কারণে বন্ধ হয়ে গেল, তখন একটা বিষাদময়তা ঘিরে ধরে। শুধু তাই না সেই সময় একটা অজানা ভয় আমাদের গ্রাস করে ফেলে। সবাইকে। প্রায় দুই মাসের মত বাড়ির দরোজা-জানালা বন্ধ রাখতাম। পুরোপুরি থমকে যাওয়া যাকে বলে!
তো এমন অভিজ্ঞতার পর একটু একটু করে সচেতন হলো মানুষ, চলমান হল। যদিও মানুষ সামাজিক দূরত্ব’র কারণে একজন থেকে আরেকজনে দূরে সরে গেল। কোন গেদারিং নেই, কালচারাল বিনিময় নেই। সেইসময়ে কিন্তু প্রযুক্তি বিশেষত অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম এক বিরাট আশীর্বাদ হয়ে এলো আমাদের কাছে। অনলাইনে যোগাযোগ, অনলাইনে বিভিন্ন সংগীত ইভেন্ট, অনলাইনে সঙ্গীতচর্চা, অনলাইনে সংগীত ক্লাস- এসবে অভ্যস্ত হলাম। এটি এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বিরাট একটা প্রভাব ফেলেছে মানুষের মধ্যে এবং যোগাযোগের এই মাধ্যমটি সক্রিয় না থাকলে, আমিতো মনে করি করোনার এই দুঃসময়ে মানুষ মনোবেদনায় অনেকখানি বিষাদগ্রস্ত হয়ে যেতেন। তারপরেও শুরুর দিকে কিন্তু আমরা মেন্টালি অসুস্থ হয়েও যেতে দেখেছি অনেককে। তরুণদের ফ্রাস্টেশনের খবর সংবাদমাধ্যমে দেখেছি। পরিবারের সাথে থাকা, মা-বাবাকে কাছে পাওয়া- এরকম ইতিবাচক কিছু ছিলো বটে, কিন্তু যদি খোলা মাঠে না যাওয়া যায়, বাইরে বের হতে না পারে, গান গাইতে না পারা যায়- সব থমকে যাওয়ার বিষয়টাতো যে কারো জন্য প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণার। সেই জায়গায় মানসিক স্বাস্থ্যকে ঠিক রাখতে কিছুটা হলেও অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যে কী ভীষণ হেল্প করেছে! আরেকটা বিষয় হলো, মানসিক সুস্থতার জন্য সবচেয়ে বড় ঔষুধ হল সংগীত, সিনেমা। এই আবদ্ধ সময়েও সংগীত আমাদের দারুণভাবে হেল্প করেছে।
প্রথম দিকে একটু বেশি ভয় পেয়েছিলাম, তবে আমাকে কিন্তু বসে থাকতে হয়নি। সুরসপ্তক এর ফেসবুক চালু করেছি, সেখানে পেইজে আমরা ক্লাস করেছি, সংগীতচর্চার বিষয়গুলো ঠিকই চলছে। আমার সমস্ত কাজ চলছে অনলাইনে, এমনকি ভার্চুয়ালি আমরা বিশেষ করে আমি ভারতসহ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যুক্ত থেকেছি, এখনও থাকছি। অতিসম্প্রতি নজরুলের উপর অনুষ্ঠান হয়েছে চুরুলিয়ায়। আসানসোলে নজরুল ইসলামের নামে ইউনিভার্সিটি হয়েছে সেখানে, ‘ওয়ার্ল্ড নজরুল কংগ্রেস’ নামের সেই অনুষ্ঠানে সারা বিশ্ব থেকে নজরুল বিষয়ক গবেষকরা যুক্ত ছিলেন। আমি সেই অনুষ্ঠানে গান করেছি। এসব ক্ষেত্রে চ্যানেল আই অনেক সহযোগিতা করেছে, ইমপ্রেস অডিও ভিশন তো করছেই।
এছাড়া একক কণ্ঠে হাজার গানের যে উদ্যোগ সেটাতো চলছেই। নজরুল সংগীত সমগ্র নামে অ্যালবাম করেছি দশটার মত। এছাড়া নতুন একটি পদক্ষেপ নিয়েছি ‘নজরুল উৎসব’ নামে। যা প্রতি বুধবার রাতে সাড়ে এগারোটায় চ্যানেল আইয়ে প্রচার হচ্ছে। এ অনুষ্ঠানে প্রতি এপিসোডে সব বয়সী নজরুল মনস্কদের কিছু করার আছে। এখানে নজরুলের সমস্ত কিছু নিয়ে কাজ হয়।
লেখক: ফেরদৌস আরা, নজরুল সংগীতশিল্পী