এ এক আশ্চর্য প্রবণতা চালু হয়েছে দেশে। বনিবনা না হলে, কারও ধর্মাচার পছন্দ না হলে, কারও চিন্তা পছন্দ না হলে, স্রেফ খুন করা হচ্ছে। কখনও ছুরি-চাপাতির কোপে, কখনও বন্দুকের গুলিতে, কখনও বা বোমার আঘাতে কেড়ে নেয়া হচ্ছে ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন মত, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জীবন।
আমাদের দেশে বেশ কয়েক বছর ধরেই ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন মতের মানুষেরা উগ্র ধর্মবাদীদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। একের পর এক সন্ত্রাসী আক্রমণের শিকার হচ্ছেন ভিন্ন ধর্ম আর মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী ব্যক্তিরা। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এই হামলাগুলো চালানো হচ্ছে। সর্বশেষ গত শনিবার হামলা চালানো হয়েছে লেখক-অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর। পূর্বঘোষিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সময় প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ প্রহরার মধ্যেই এই হামলায় প্রমাণ করে ঘাতকেরা কতোটা সংকল্পবদ্ধ রয়েছে মুক্তমনা মানুষদের নির্মূলকরণের পরিকল্পনায়।
যেভাবে প্রকাশ্যে জাফর ইকবালের মতো কথাসাহিত্যিককে ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে তাতে স্তম্ভিত হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ! ভাগ্যক্রমে তিনি হয়তো বেঁচে গেছেন। কিন্তু উপর্যুপরি ছুরির আঘাতে তাঁর শরীর থেকে যে পরিমাণ রক্ত ঝরেছে, তার দায় কে নেবে? এ হামলায় নাকি পুলিশের গাফিলতি ছিল না। সরকারও উচ্চকণ্ঠে বলছে, এ হামলা দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার ‘ষড়যন্ত্র’। প্রশ্ন হলো, তাহলে এ হামলার দায় কে নেবে?
শুধু মৌলবাদী আর ‘ষড়যন্ত্রকারী’দের উপর দায় চাপিয়ে আমরা কি বিলাপ করতে থাকব? মৌলবাদীদের ঠেকাতে, তাদের নির্মূল করতে যা প্রয়োজন-দৃঢ় সংকল্প আর সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি তা কোথায়? কেবল র্যাব-পুলিশ দিয়ে কিছু জঙ্গিকে মাঝে মাঝে খতম করলেই কি সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? ‘জঙ্গি তৈরির কারখানা’ বন্ধের ব্যাপারে সরকার কতটুকু কী করেছে? উৎস বন্ধ না করে জঙ্গি-খতম অভিযান পরিচালনা করলে জাফর ইকবালরা আক্রান্ত হবেই।
আপাতত ক্ষমতার মৌতাতে বিভোর মন্ত্রী-এমপিরাও চাপাতির কোপ কিংবা বোমা-গ্রেনেডের নিশানা থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন বলে মনে হয় না! কারণ মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী ক্ষমতাসীনদের ছেড়ে কথা কইবে-এটা দিবাস্বপ্ন মাত্র!
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার-লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের পর একে একে অনন্ত বিজয় দাশ, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নীলয়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু ও প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনসহ বেশ কয়েকজন ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও ভিন্ন মতাবলম্বী খুন হন। তারও আগে চাপাতির কোপে রক্তাক্ত করা হয় দেশের গুণী লেখক-অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদকে। অধ্যাপক জাফর ইকবাল বরাবরই জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। তাঁকে ধারাবাহিক ভাবে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে ২০১৬ সালের অক্টোবরে তাঁর পাহারায় পুলিশ মোতায়েন করে সরকার। এবার ওই পুলিশ পাহারার মধ্যেই আক্রমণের ঘটনা ঘটল!
আক্রমণকারী এক তরুণকে ছাত্রশিক্ষকরা আটক করেছে। ওই তরুণ র্যাবের কাছে বলেছে, ‘‘জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু। তাই তাকে হত্যার উদ্দেশে হামলা করেছি।” বোঝাই যাচ্ছে এই হামলার ঘটনা নিকট অতীতে সংঘটিত অন্যান্য হামলারই ধারাবহিকতা। প্রগতিমনা মানুষদের জন্য, দেশের জন্য যা ভয়াবহ বার্তা!
অপছন্দের মতামত দমন করার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো সেই মত পোষণকারী বা প্রচারকারীকে দমন করা। পৃথিবীর বহু দেশে ভিন্নমতাবলম্বীকে অদৃশ্য করে দিয়ে, নির্জন দ্বীপে নির্বাসিত করে কিংবা গুপ্তঘাতকের গুলিতে খতম করে ‘নিষ্কণ্টক’ করার চেষ্টা হয়েছে। এসব কাজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে করা হয় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা, ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায়। অতঃপর সেই বিদ্রোহী কিংবা বিক্ষুব্ধের আর হদিশ মিলত না, তিনি ইতিহাস থেকে হারিয়ে যেতেন। আমাদের দেশে সিনেমা-নাটকে এমন কাহিনি দেখা গেলেও বাস্তবে দেখা যেত না।
বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে প্রথম বিরোধী দলের নেতাদের খুনের প্রক্রিয়া জোরেশোরে শুরু হয়। আহসান উল্লাহ মাস্টার, শাহ এএসএম কিবরিয়া, মঞ্জুরুল ইমামসহ জনপ্রিয় নেতাদের হত্যা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে পুরো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা-ইত্যাদি ঘটনা ঘটে। অপছন্দের রাজনীতি-চিন্তা-বিশ্বাস ধর্ম ও সংস্কৃতিকে প্রকাশ্যে বা নেপথ্যে নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধ করার সেই ঐতিহ্য এখন মৌলবাদীরা আত্মস্থ করেছে। এখন সমাজে এক শ্রেণির মৌলবাদী নিশ্ছিদ্র নজরদারির ঠিকাদারি নিয়েছেন। তারা নির্ধারণ করে দিচ্ছে, কে কোন কথা বলতে পারবে, আর কে পারবে না। বাঁচা-মরার দায়িত্বও এই মৌলবাদী চক্রই নির্ধারণ করে দিচ্ছে। আর সরকারের পক্ষ থেকে মৌলবাদীরা পেয়েছে কেবল আস্কারা!
পরিবর্তন যদি সত্যি আনতে হয়, তবে ক্ষমতাসীনদের মানসিকতার মৌলিক পরিবর্তন সবচেয়ে জরুরি। মৌলবাদী মতের ধারকরাও মানুষ, এ দেশেরই সন্তান, ওরা ভুল করেছে, না বুঝে ভুল পথে গেছে, এমন মতের সমর্থক আমাদের দেশে কম নয়। প্রগতিশীলতার দিকে না হেঁটে কেবলই ধর্মবাদীদের সঙ্গে আপোষ করে, ওদের মাথায় তুলে নাচাটা একটা মানসিকতার ব্যাপার। ক্ষমতাসীনরা নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধা অনুযায়ী সেই কাজটিই করছে নির্বোধের মতো!
সরকার সৎ ও আন্তরিক হলে দেশে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদের শিকড় ধরে টান মারাটা অসম্ভব নয়। এই জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সদিচ্ছা। তারপর সুচিন্তিত ধারাবাহিক এবং কঠোর উদ্যোগ। কারা ষড়যন্ত্রকারী, মৌলবাদী, তাদের পৃষ্ঠপোষক, প্ররোচনাদাতা, কারা হামলাকারী, হামলার প্রণেতা, কারা আয়োজক, আর কারাই বা তার সংঘটক, তা সরকারের অজানা থাকার কথা নয়। যদি থাকে, তবে সেটাও সরকারেরই ব্যর্থতা।
বস্তুত, বহু ক্ষেত্রেই নানাবিধ অপরাধের কথা-কাহিনি বিষয়ে সরকার পূর্বাহ্ণেই অবহিত থাকে, কিন্তু সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে অথবা বাধ্যবাধকতায় যথার্থ ব্যবস্থা নেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখে। বর্তমান সরকার যদি এই রকম সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারত, তা হলে জোর দিয়ে বলা যায়, জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনা ঘটত না।
প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যই মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরব, কিন্তু কথার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ও শিথিল। গণ আন্দোলন দমনের ব্যাপারে সরকার অত্যন্ত ‘দৃঢ়’, কথায় কথায় গণ আন্দোলনকর্মীদের গ্রেফতার, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে সরকারের বিবেকের বিচলন নেই, অথচ, সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ও মৌলবাদী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে ন্যূনতম রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতেও তার ভয়ানক রকম দোনামনা। এই দোনামনাই দেশে মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী তৎপরতা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাড়িয়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
মনে পড়ে একটা নাটকের কথা। টি এস ইলিয়টের ‘Murder in the Cathedral’। প্রোটাগানিস্ট যাজক থমাস বেকেট রাজা দ্বিতীয় হেনরির স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। রাজা হেনরির সঙ্গে যাজকের এই সংঘাতকে ‘the quarrel between the soul and the state’ বলে অনেক তাত্ত্বিক অভিহিত করেছিলেন।
এই নাটক ইলিয়ট লিখেছিলেন ১৯৩৫–এর একেবারে গোড়ায়। বিশ্ব জুড়ে তখন শোনা যাচ্ছে হিটলারের ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি। জার্মানিতে শুরু হয়ে গেছে ইহুদি নিধনযজ্ঞ। এই কালজয়ী নাটকের চরিত্র যাজক থমাস বেকেট সরব হয়েছিলেন রাজা হেনরির স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। মুক্তচিন্তা আর সহিষ্ণুতার জন্য আওয়াজ তুলেছিলেন থমাস বেকেট। আজও তো আমাদের দেশে ধর্মীয় মৌলবাদ আর উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সরব হয়ে রোষানলে পড়ছেন সমাজের বহু মানুষ।
রাজা দ্বিতীয় হেনরির স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়ে খুন হয়েছিলেন প্রোটাগানিস্ট যাজক থমাস বেকেট। তিরাশি বছর আগে লেখা ইলিয়টের এই কালজয়ী নাটক আজও তাই সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। আমাদের দেশেও তৈরি হয়েছে এক ধরনের অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ।
মুক্তমনা লেখকেরা খুন হচ্ছেন। আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্ত হচ্ছেন ভিন্ন ধর্ম আচার পালনকারী অনেকেই। কিন্তু প্রতিবাদের স্বরটাও তেমন তীব্র হচ্ছে না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এখানে বিরোধী দল বলতে যা বোঝায় তারা ঘোলা জলে মাছ শিকারের চেষ্টায় মগ্ন। শাসকদলকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কেউ নেই। ক্ষমতাসীনরা মাঝে মাঝেই উন্নয়নের ঢাক বাজাচ্ছেন। আমরাও চাই উন্নয়নের অমৃতকুম্ভ থেকে জিডিপি বৃষ্টির ধারার মতো ঝরে পড়ুক আমাদের দেশে। কিন্তু তার জন্য যে সম্প্রীতির পরিবেশ, মুক্তচিন্তার পরিসর আর সহিষ্ণুতার মানসিকতা দরকার, সেটা গড়ে তোলার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। কিন্তু কোথায় সেই পরিবেশ?
হতাশা নিয়েই বলছি, অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর মৌলবাদী হামলা প্রমাণ করে আমরা আসলে সামনে এগোচ্ছি না। এগোতে পারছি না, এগোতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা দিনকে দিন সংকীর্ণ হচ্ছি, ছোট থেকে আরও ছোট হয়ে যাচ্ছি। আমাদের সমাজে কেউই প্রথাগত পাপাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে না। যদিও-বা কেউ একটু মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, সবাই মিলে তাঁকে মাটিতে শুইয়ে দিচ্ছি!
আমরা সবাই জানি অধ্যাপক জাফর ইকবাল আমাদের দেশের ‘মাঝারির বড় দলে’ একজন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি দেশকে অসম্ভব ভালোবাসেন। তিনি অকপটে সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলেন, বলতে পারেন। জাতির দুর্দিনে, দুর্যোগে তিনি কখনও মুখ বুজে থাকেন না। তিনি তাঁর পেশার প্রতি অসম্ভব সৎ। কেউ তাঁর পেশাগত জীবন নিয়ে এতটুকু সমালোচনা করতে পারেনি।
অধ্যাপক জাফর ইকবাল কেবল একজন শিক্ষক নন, তিনি এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। বর্তমান বাংলাদেশে তিনিই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি যিনি পুরো দেশের যুবসমাজকে স্বপ্ন দেখান, স্বপ্ন দেখাতে পারেন। এই অসম্ভব গুণী মানুষটি দীর্ঘ ১১ বছর আমেরিকার শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে রিসার্চ সায়েন্টিস্ট থাকার পরও সেখানে না থেকে দেশের মানুষের জন্য দেশের জন্য, স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁর সমস্ত মেধা-মনন দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
এমন একজন মানুষকে যারা হত্যা করতে চায় (হত্যার সুযোগও প্রায় তারা পেয়েই গিয়েছিল), এই ব্যর্থতা ক্ষমতাসীনরা কীভাবে ঢাকবেন? আমরাই বা অধ্যাপক জাফর ইকবালের কাছে কেমন করে মুখ দেখাব? আমাদের সব কিছুই কি নষ্টদের দখলে যাবে? ক্ষমতাসীনদের অযোগ্যতা, কূটকৌশল, আর আপোষকামী মনোভাবের কারণে এই সব জংলি অসভ্যদের উল্লাসনৃত্য দেখে যেতে হবে? তাদের ছুরি-চাপাতির পরোয়ানা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)