চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মাধ্যমিকে বিজ্ঞান শিক্ষায় অশনি সংকেত

বাংলাদেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষার কি এখন ক্রান্তিকাল চলছে? দেশের বিভিন্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুলগুলোতে একটু দৃষ্টি দিলেই আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষার মোটামুটি একটা চিত্র ফুটে উঠবে। তবে,তা সম্ভাবনাময়তো বলা যাবেইনা বরং খুবই হতাশার। ভয়াবহ উদ্বেগের। প্রশ্নহল, বর্তমানে প্রচলিত আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষার বিজ্ঞান শিক্ষার ভবিষ্যৎ কী ?

সাধারণত, মাধ্যমিক পর্যায় থেকে (নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর) ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞান মানবিক ও ব্যবসাশিক্ষা নামীয় বিশেষায়িত এই তিন বিভাগে অধ্যয়নের সুযোগ পায়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ স্কুলে ছেলেমেয়েরা তাদের নিজস্ব ইচ্ছাতেই বিভাগ চয়েস করে। তাদের চয়েস অনুযায়ী তারা নির্দিষ্ট বিভাগে ভর্তি হয়। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল, বিভাগ নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের গার্ডিয়ান কিংবা শিক্ষকদের ভূমিকা খুব নগণ্যই।

তবে, শহরের স্কুলের চিত্র এক্ষেত্রে অনেকটাই ভিন্ন। ওখানে, কে কোন বিভাগে পড়বে, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ধারণ করে দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিংবা বিষয় শিক্ষক। বিভাগ নির্বাচনে শহুরে গার্ডিয়ানদের ভূমিকাও যথেষ্ট জোরালো থাকে। শহরের স্কুলগুলোতে কেবল শিক্ষার্থীর একক ইচ্ছায় কোন শিক্ষার্থী বিভাগ নির্বাচন করতে পারেনা।

এদিকে, গ্রামের স্কুলে সাধারণত যারা তুলনামূলক ভালছাত্র, জেএসসি পরীক্ষায় যাদের রেজাল্ট তুলনামূলক ভাল, তারাই বিজ্ঞান বিভাগ বেছে নেয়। আর এই ইচ্ছা প্রায়ই এদের স্ব-প্রণোদিত। বেশিরভাগ গার্ডিয়ানদের বিষয় নির্বাচনে তাদের ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিগত চয়েসের উপর কোন ওজর আপত্তি কিংবা সমর্থন কোনটাই থাকেনা। শিক্ষকরাও আগবাড়িয়ে কোন পরামর্শ দিতে যায়না। এমনিতেও বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় খুবই অল্প। অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিজ্ঞানের প্রতি অনাগ্রহী হওয়ার কারণ মূলত বিজ্ঞান ভীতি। বিজ্ঞান শিক্ষকদের এদিকে মনোযোগ না দেয়া। শিক্ষার্থীর ‘আর্থিক অসঙ্গতি’ ইত্যাদি।

যারা ছাত্র হিসেবে খুব ভাল তারা ছাড়া অন্যেরা হয় মানবিক বিভাগ না হয় ব্যবসা শিক্ষা নিয়ে থাকে। তবে, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মানবিক বিভাগই বেছে নেয়। এই চিত্র বেশিরভাগ গ্রামের স্কুলের।

সংখ্যাটা একেবারে সঠিক না হলেও অধিকাংশ গ্রামের স্কুলে গড়ে প্রায় ২০ শতাংশের মত শিক্ষার্থী বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করে। তবে, এসএসসি পাস করার পর এদের মধ্য থেকেও তিন থেকে চার পার্সেন্ট বিভাগ পরিবর্তন করে অন্য বিভাগে চলে যায়। আর ক্ষেত্রে বেশিরভাগই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসিতে গিয়ে মানবিক বিভাগে ভর্তি হয়।

এখন প্রশ্ন হল, মাধ্যমিক পর্যায়ে আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষার এই হাল কেন ? বিজ্ঞানের প্রবল একাধিপত্য যুগে প্রতিটি স্কুলে যখন বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আগ্রহ থাকার কথা, বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা থাকার কথা সবচেয়ে বেশি, তখন বাস্তব অবস্থা ঠিক তার উল্টো। বিজ্ঞান শিক্ষার এই বেহাল অবস্থা কেন হচ্ছে, সরকার কি এ নিয়ে কোন সার্ভে করেছে কখনো ? জানা যায়নি !

বিজ্ঞান শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে একটি দেশ যে মোটেই সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারেনা, সে ব্যাপারে কিন্তু কারো কোন প্রশ্ন নেই। তবে, মাধ্যমিক পর্যায়ে আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষার বর্তমান দুরবস্থা, এর সিলেবাস ও পাঠদান কাঠামো এবং তার পরিচর্যা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন আছে অনেকের।

বর্তমানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা পদার্থ রসায়ন এবং জীব বিজ্ঞান পড়ছে। ঠিক এই বিষয়গুলো এইচএসসিতেও পড়তে হয়। সমস্যা হল, পদার্থ রসায়ন এবং জীব বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জন্য শিক্ষক মাত্র একজন ! অথচ, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যলয়ে এই বিষয়গুলোই পড়ানোর জন্য বিষয়ভিত্তিক তিনজন করে মোট ছয়জন শিক্ষক (প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রের জন্য) রয়েছে।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কথিত বিজ্ঞান শিক্ষককে আবার নবম দশমশ্রেণীর তিনটিকরে ছয়টি বিষয়সহ অন্যান্য ক্লাসের সাধারণ বিজ্ঞানও পড়াতে হয়। একজনমাত্র শিক্ষকের মাথায় যদি টোটাল বিজ্ঞানের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আপনাদের অনুমান করতে নিশ্চয়ই কষ্ট হবেনা, বিজ্ঞান শিক্ষায় আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষার হাল-হকিকত আসলে কী ?

স্কুল গুলোর অধিকাংশেই ব্যবহারিক বিজ্ঞানের জন্য আধুনিক ল্যাব নেই। যা আছে তা হল, নিয়ম রক্ষার একটি মিনি ‘যাদুঘর’। বিজ্ঞানের যৎসামান্য কিছু যন্ত্রপাতি আর কিছু প্লাস্টিক কঙ্কাল নিয়ে ল্যাব নামের এই কঙ্কালসার সরকারের বড় বড় কর্মকর্তাদের সাফাই গাওয়ার সাক্ষীগোপাল হিসেবে দেশব্যাপী দাঁড়িয়ে আছে।

কথিত ল্যাবগুলো বড় কর্তাদের চাকরি যেমন বাঁচিয়ে রেখেছে, তেমনি এই সাক্ষীগোপালকে দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সরকারি কোষাগারের টাকায় ল্যাবের যন্ত্রপাতি কিনার জন্য বড় বড় প্রজেক্ট দাঁড় করায়। এই মহামতিদের বদান্যতায় দেশের বিজ্ঞান শিক্ষার বারোটা বাজলেও এদের ব্যক্তিগত একাউন্টগুলো একেকটা টাকার পাহাড় হয়ে গেছে।

মহাপরিকল্পকদের পরিকল্পনাই যদি বিজ্ঞান মনষ্ক না হয়, তাহলে স্কুলগুলোতে বিজ্ঞানের নামে কেবল বই’র সংখ্যা বাড়িয়ে দিলেই বিজ্ঞানের সুফল পাওয়া যাবে, এই আশা আমরা করি কোন জ্ঞানে !

একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে বিশেষকরে কার্যকর কোন পরিকল্পনাই করা হয়নি।

বর্তমানে প্রচলিত স্কুলে পাঠ্যবইগুলোর পাশাপাশি মাধ্যমিক স্কুলের জন্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্টাফিং প্যাটার্নে চোখ বুলালে খুব সহজেই বুঝা যায়, সরকার মাধ্যমিক শিক্ষার নামে আসলে কী তামাশা করে যাচ্ছে।

বিজ্ঞানই সকল অগ্রগতির মূল। বিজ্ঞান শিক্ষার যথার্থ উন্নতি ছাড়া একটি জাতি কখনোই তার চূড়ান্ত লক্ষে পৌছতে পারেনা। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সরকার এই কঠিন সত্যটুকু এখনো বুঝে উঠতে পারেনি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)