মাদকাসক্তি স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ও অপরাধগত ইস্যুতে সারাবিশ্বে ইতিমধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মাদকাসক্তির ফলে মারাত্মকভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার হচ্ছে আক্রান্ত রাষ্ট্রগুলো। আমেরিকান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন মাদকাসক্তিকে মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে উল্লেখ করেছে।
২০১২ সালের একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদনে জানা যায়,মাদকাসক্তির ফলে বিশ্বে ১,৮৩,০০০ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বর্তমানে মৃত্যুর মিছিল আরো ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদকাসক্তদের মধ্যে ছাত্র, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, রিকশাচালক এবং অন্যান্য পেশার মানুষেরাও রয়েছে। এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, নিরাপত্তা ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্টরাও মাদকে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। সমাজের প্রতিষ্ঠিত নেতারাও মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষক এবং চিকিৎসক যারা মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালনের কথা তারাও কোন না কোনভাবে মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, শতকরা ৮০ ভাগ মাদকাসক্তের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ আমাদের মূল চালিকাশক্তির একটি বড় অংশ মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ছে যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রগতি ও সমৃদ্ধির অন্তরায়।
মাদকের সাথে অপরাধ এবং অপরাধীদের একটি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। মাদক ক্রয়ের জন্য মাদকাসক্তরা যে কোন ধরনের ঘৃণিত কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ে। ক্ষুদ্র অপরাধ থেকে শুরু করে হোয়াইট কলার ক্রাইম পর্যন্ত করে ফেলে মাদকসেবীরা। এছাড়া আরও কিছু মারাত্মক অপরাধ আছে যেগুলো সরাসরি মাদকের সাথে সংশ্লিষ্ট। ১৯৯৮ সালের এক জরিপে জানা যায়, শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই বিভ্ন্নি জায়গায় ৩০টি সংঘবদ্ধ চক্র মাদকের ব্যবসার সাথে জড়িত।
এই ৩০টি গ্রুপের সাথে প্রায় ৩০০০০ (ত্রিশ হাজার) লোক মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। যারা মাদক উৎপাদন, পাচার, বাজারজাতকরণ ও অন্যান্য কাজের সাথে জড়িত। সুতরাং ১০ বছর পরে কতটি গ্রুপ থাকতে পারে এবং এর সাথে কত লক্ষ লোক জড়িত থাকতে পারে বিষয়টা খুবই চিন্তার বিষয়। শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই এ অবস্থা তাহলে সারা বাংলাদেশের অবস্থা অবশ্যই শোচনীয়। পাশাপাশি একটি সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে যারা মাদকসেবীদের দিয়ে ভয়ংকর সব অপরাধ করিয়ে নিচ্ছে হরহামেশাই। ছিনতাই, চুরি, লুণ্ঠন, রাহাজানি, ধর্ষণ, আঘাত করা, মারত্নকভাবে আঘাত করা, হত্যা, অপহরণ করে হত্যা, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদি জঘন্য অপরাধ কর্ম সংঘটিত হচ্ছে মাদকসেবীদের দ্বারা।
মাদকাসক্ত যে নিজেই মাদকের ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার হয় বিষয়টি এমন নয়, মাদকসেবীর সাথে সাথে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী তথা সামগ্রিক সমাজব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। জৈবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শারীরবৃত্তীয় ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইস্যুতে মাদকের অপব্যবহার সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
কেউই মাদকের ভয়ানক করাল গ্রাসের বাইরে নয় যখন পরিবারের কোন সদস্য মাদকাসক্ত হয়। মরণব্যধি মাদক যখন বাড়ির পাশে কিংবা বাড়িতে সেবন করা হয় তখন ঐ পরিবারের সবাই মাদকের নেতিবাচক প্রভাবে কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। পাশাপাশি এও স্বীকার করতে হবে, মাদকসেবীরা মাদকের আসক্ততা থেকে সহজেই বেরিয়ে আসতে পারে না। কার্যত এ সব ক্ষেত্রে বাবা-মাকে বেশি ভুগতে হয়। সন্তানকে মাদকের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত রাখতে যে কোন ধরনের অভিযোগ, অনুযোগ ও কষ্টকে সহ্য করে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়।
এমনও দেখা গেছে, পরিবারের একজন মাদকসেবীর কারণে পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। পারিবারিক কলহ ও সাংসারিক অশান্তি সৃষ্টিতে পরিবারের একজন মাদকসেবীই যথেষ্ট। কারণ, সন্তানের মাদক গ্রহণের কারণে বাবা-মা একে অপরকে দোষারোপ করে থাকেন। এর ফলে অনেক পরিবারেই বিবাহ বিচ্ছেদের মতো জঘন্য ঘটনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মাদকাসক্তি ও মাদকসেবী যে পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি করেছে বিষয়টি এমন নয়, মাদকের ভয়াবহতা মানসিক স্বাস্থ্য ও শারীরিক স্বাস্থ্য, প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিকরণ, আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবনমন, রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি এবং অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে কাজ করে থাকে।
মাদকাসক্তের কারণ বিশ্লেষণ করলে সমাজ সম্পৃক্ত বেশ কিছু কারণের উদয় ঘটে। অর্থাৎ সমাজই কিশোরদের-যুবকদের মাদকের দিকে ধাবিত করছে। একটা সময় ছিলো যখন ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজ থেকে ফিরে বিকেল বেলায় উন্মুক্ত মাঠে খেলাধুলা করতো। কিন্তু শিল্পায়ন, শহরায়ন ও গ্রাম-শহর মাইগ্রেশনের ফলে ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠের অপ্রতুলতা দেখা যায়। বিশ্বায়নের এই আধিপত্যে ভেঙ্গে পড়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত ভাতৃত্ববোধ এবং বৃহৎ পরিবার ভেঙ্গে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি তৈরি হওয়ায় পারিবারিক মৌলিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা। আধুনিক যান্ত্রিক সমাজে খেলাধুলা কিংবা অন্যান্য রিফ্রেশমেন্টের জন্য খেলার মাঠ না থাকায় শারীরিক ও মানসিক বিকাশ থেকে বঞ্চিত হয়ে হীনমন্যতা ও একাকীত্বে ভোগে শিশুরা। ফলশ্রুতিতে খারাপ সঙ্গী এবং মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়েছে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা। এই মাদকের টাকা যোগান দিতে গিয়ে কিশোর/কিশোরীরা অপরাধের দিকে জড়িয়ে পড়ছে।
মাদকের চাহিদা এবং মাদকের সরবরাহ একে অন্যের পরিপূরক। প্রতিনিয়ত যে হারে চাহিদা বাড়ছে সে হারেই যোগানও দেওয়া হচ্ছে। মাদকের প্রতুল সরবরাহের কারণে সব জায়গায় মাদক স্বাভাবিকভাবেই পাওয়া যাচ্ছে এবং মাদক দ্রব্যের বৈচিত্র্য আসছে দিন দিন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধুমাত্র ক্যাননাবিস, আফিম এবং অ্যালকোহল পাওয়া যেত।
পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের দিকে হিরোইন এবং ফেনসিডিল; ২০০০ সালের দিকে ইনজেকশন যুক্ত মাদক, ২০০৫ সালের দিকে ইয়াবা,আঠালো স্নিং, স্লিপিং পিল ইত্যাদি নানাবিধ মাদকদ্রব্যের সমাহার লক্ষ্য করা যায় বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সাধারণত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই মাদকদ্রব্যের পাচারজাত ও মাদকের ব্যবহারে হুমকির সম্মুখীন।
আন্তর্জাতিক মাদক উৎপাদনকৃত এলাকা গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (পাকিস্তান, আফগানিস্থান ও ইরাক) বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। পাশাপাশি গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (মায়ানমার, লাউস, এবং থাইল্যান্ড) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থান করায় বাংলাদেশ সবসময়ই মাদকের ঝুঁকির মধ্যে অবস্থান করে থাকে।
বর্তমান বাংলাদেশে সাধারণত ইয়াবা, হিরোইন, গাঞ্জা, ইনজেকশন কৃত মাদক, ফেনসিডিল, অ্যালকোহল, ট্যাবলেট, গ্লু (সলিউশন) এবং অন্যান্য নেশা জাতীয় দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। বিশেষত যে সব কারণে একজন মাদকসেবী মাদক গ্রহণ করে থাকেন তার মধ্যে অন্যতম হলো, পিয়ার গ্রুপের প্রেসার। অর্থাৎ ছেলেমেয়ের সহযোগী তথা বন্ধু যদি নেশাগ্রস্ত হয় তাহলে ঐ কিশোর/কিশোরীর মাদকে আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
অতিরিক্ত হতাশাও মাদকে আসক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। তবে এই হতাশা বিভিন্নভাবে আসতে পারে। তবে আমাদের দেশে চাকুরিতে ব্যর্থতার কারণে ছেলে/মেয়েদের মাদকে আসক্ত হতে দেখা যায়। অন্যান্য কারণের মধ্যে অন্যতম হল: পারিবারিক জীবনে অসুখী, প্রেমঘটিত সম্পর্কে অসফলতা, মাদকের ভয়াবহ পরিণতির অজ্ঞতা, চাপমুক্ত থাকার কৌশল, একাডেমিক ক্ষেত্রে/চাপের প্রভাব, মাদকের সহজলভ্যতা ও অন্যান্য সামাজিক কারণে একজন ছেলে/মেয়ে মাদকে আসক্ত হয়ে থাকে।
প্রত্যেক ব্যাধির নিরাময় রয়েছে, মাদক যেহেতু একটি ব্যাধি তাই মাদকের নিরাময় সম্ভব। এর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। নৈতিক এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে মাদকের বিরুদ্ধে সঠিক ও আইনসম্মত পথে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
মাদক নিয়ে একটি যথাযথ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কিভাবে, কোথা থেকে, কাদের মাধ্যমে, কাদের কাছে মাদক সরবরাহ হয়ে থাকে? এই সব প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহের মাধ্যমে একাডেমিক ফলাফল পাওয়া যাবে।
একাডেমিক গবেষণা ফলাফলের বাস্তবায়নের দায়ভার রাষ্ট্রযন্ত্রের। সামাজিক বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করতে হবে। পারিবারিক বন্ধন, নিজেদের মধ্যে শেয়ারিং কেয়ারিং এবং র্ধর্মীয় অনুশাসনের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে।
পলিসি মেকার বিশেষ করে রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মাদকের বিরুদ্ধে প্রকৃতঅর্থে যুদ্ধ ঘোষণা করে সমাজ থেকে মাদককে চিরতরে বিলীন করতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)