চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

‘মাতাল’ এমপির গুলিতে আহত শিশু বনাম পশ্চিমাদের ঘটনা নিয়ে উচ্ছ্বাস

অষ্ট্রেলিয়ায় পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে বন্দুকযুদ্ধ আর আমেরিকায় গুলি করে ৯ স্কুল ছাত্রকে হত্যার ঘটনা নিয়ে আমার বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া পড়ছিলাম। দুটো ঘটনায়ই বাংলাদেশের বন্ধুরা যে খুবই খুশি হয়েছেন, সেটি তারা উচ্ছ্বাসের সঙ্গেই প্রকাশ করছেন। বাংলাদেশে জঙ্গী হামলা হতে পারে- এমন তথ্যের ভিত্তিতে তারা বাংলাদেশে বসবাসরত তাদের নাগরিকদের সতর্ক করে দিয়েছিলো। সেটিই আমার বন্ধুদের পীড়িত করেছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের এই আত্মসম্মানবোধ অত্যন্ত উৎসাহব্যাঞ্জক।

বাংলাদেশী বন্ধুদের আত্মসম্মানে আঘাতের বিহ্বলতায় পশ্চিমা দেশগুলোর এই পদক্ষেপের যে দিকটি বন্ধুরা অনুধাবন করতে পারেননি- সেটি হচ্ছে, নিজ দেশের নাগরিকদের ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলোর দায়িত্ববোধ। কেবল দেশেই নয়, বিদেশেও যে তারা তাদের নাগরিকদের নিয়ে উৎকণ্ঠিত থাকেন, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে তৎপর থাকেন, সেই বিষয়টি আমার বন্ধুদের দৃষ্টিতে পড়েছে বলে মনে হয় না।

আচ্ছা, বাংলাদেশ কি তার নাগরিকদের নিয়ে কখনোই এমন উৎকণ্ঠিত হয়েছে? বাংলাদেশের কোনো সরকার কি দেশে কিংবা বিদেশে নিজ দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে এভাবে চিন্তিত হয়েছে? এই যে মক্কায় পদদলিত হয়ে কয়েক হাজার হজযাত্রী প্রাণ হারালেন, সেখানে বাংলাদেশী হজযাত্রীদের নিয়ে সরকারের উৎকণ্ঠাটি কি তেমন দৃশ্যমান ছিলো? বিষয়টা তো আসলে রাষ্ট্রের চরিত্রের, রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকারের চরিত্রের। পশ্চিমারা তাদের আচরণ দিয়ে তাদের চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়েছে। যেমন বাংলাদেশ, দেশের সরকার নাগরিকদের প্রতি নিজের আচরণ দিয়ে নিজের চরিত্রের প্রকাশ ঘটায়।

অষ্ট্রেলিয়া বা আমেরিকায় যা ঘটেছে, তা যে এই প্রথম ঘটলো, তাও তো নয়। আমেরিকায় খুন খারাবি হরহামেশাই ঘটে। তবু তারা নিজেদের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে, তাদের সতর্ক করে দেওয়া দায়িত্ব মনে করে। অষ্ট্রেলিয়া-আমেরিকার ঘটনা নিয়ে যারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন, তাদের একটা প্রশ্ন করি। আপনারা কি ঘটনাপরবর্তী সরকারের প্রতিক্রিয়া, তৎপরতাগুলো মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেছেন? আমেরিকার স্কুলে গুলি বর্ষণের ঘটনার পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ‘এটা বিরোধী দলের কাজ’ বলে ঘোষণা দিয়ে বসেননি। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীও ‘অমুককে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সব বেরিয়ে যাবে’ বলে ঘোষণা দেননি। তারা পুলিশকে কাজ করতে দিয়েছেন।

পুলিশ স্বাধীনভাবে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে, তাদের ধরতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। রাষ্ট্র কিংবা সরকার কোনো ধরণের তদন্ত ছাড়াই হাওয়ার উপর ‘কারা অপরাধ করেছে’ তার ঘোষণা দিয়ে পুলিশকে অপরাধীদের ধরা থেকে বিরত থাকার বার্তা দেয়নি।  আগেও বলেছি, অষ্ট্রেলিয়া-আমেরিকায়ও অপরাধ হয়, সহিংসতা হয়। কখনো কখনো বাংলাদেশের চেয়ে জঘন্য ঘটনাও ঘটে। কিন্তু রাষ্ট্র বা সরকার রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে অপরাধীদের জন্য নিরাপত্তা বর্ম তৈরি করে দেয় না। তারা জনগণের মনে নিরাপত্তাবোধ তৈরির চেষ্টা করে।

অষ্ট্রেলিয়া- আমেরিকার ঘটনাটির চেয়েও জঘন্য ঘটনাটি কিন্তু বাংলাদেশেই ঘটেছে। একজন এমপি, আইন প্রণেতা মাতাল হয়ে একজন শিশুকে গুলি করেছে। এর চেয়ে জঘন্য কাজ আর কি হতে পারে? একজন খুনী যখন খুন করে, সেটি অপরাধ। কিন্তু একজন আইন প্রণেতা যখন সম্পূর্ণ বিনা কারণে, বিনা উসকানিতে নিরীহ একটি শিশুকে গুলি করে, সেটি অপরাধের চেয়েও বেশি। তারচেয়েও বড় অপরাধ, যখন রাষ্ট্র, সরকার- এই ঘটনায় নিরব থেকে গুলি বর্ষণকারী এমপিকে রক্ষার সব ধরনের ব্যবস্থা করে দেয়। অষ্ট্রেলিয়া-আমেরিকায় গুলি বর্ষণের ঘটনা যেমন ঘটেছে, এই সব দেশে ফেসবুকে নিজের পোষ্ট নিয়ে বিতর্কের কারণে এমপিগিরি পর্যন্ত ছেড়ে দিতে হয়। অথচ বাংলাদেশে একজন এমপি একটি শিশুকে গুলি করার পর সরকারের মধ্যে কোনো ধরণের প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। পুলিশের এক কর্তাতো বলেই দিয়েছেন- গুলিটা যে করেছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অর্থাৎ, গুলি করেও এমপি অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন না। বরং রাষ্ট্র তাকে নির্দোষ হিসেবে ঘোষণার আয়োজন করছে বলেই প্রতীয়মান হয়। এই ধরনের ঘটনা যে দেশে ঘটে, তাদের আর যাই হোক অন্য দেশের গুলির ঘটনা নিয়ে উচ্ছ্বাস করা সাজে না।

বাংলাদেশ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের কূটনীতি তার অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। গোয়েন্দারাও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এইগুলো নিয়ে জোরালো আলোচনা হওয়া উচিত ছিলো, কিন্তু সেটি হয়নি। পশ্চিমারা বাংলাদেশে বসবাসরত তাদের নাগরিকদের সতর্ক করে দিয়েছে বলেই যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে কালি লেগেছে- সেকথা আমি বিশ্বাস করি না। বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে কালি যদি কিছু লেগে থাকে, সেটি হয়েছে- মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিচ্ছুদের উপর পুলিশী নির্যাতনের বর্বরতায়। মাতাল এমপির হাতে নিরীহ শিশুর গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায়। এইগুলো নিয়ে বরং কথা বলা জরুরি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)