চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মাগফিরাত ও সিয়াম সাধনা

সবেমাত্র অতিবাহিত হয়েছে রহমতের প্রথম দশক। মাগফিরাতের পর্ব আজ থেকে শুরু। ঠিক তার পরের দশক নাজাতের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটবে সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজানের। এই মাসে যথাযথভাবে সিয়াম সাধনার গুরুত্বপূর্ণ একটি পুরস্কার হলো আল্লাহ পাক কর্তৃক স্বীয় বান্দাকে ক্ষমা করে দেওয়া। সহজার্থে একেই মাগফিরাত বলে।

মাগফিরাত অর্থ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার পাপমোচন তথা ক্ষমা করে দেওয়া। কখনো কখনো বান্দা ইবাদত ও রোনাজারির মাধ্যমে প্রভুর সন্তুষ্টি তালাশ করে, স্রষ্টা তখনই স্বেচ্ছায় ক্ষমার নীতি গ্রহণ করেন। তিনি তার বান্দাকে যখন যে কারণে ইচ্ছা ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু বিশেষ কতিপয় দিবস-রাত্র-মৌসুম রয়েছে, যাতে তিনি অসীম ক্ষমার হাত বিলিয়ে দেন উৎসুক বান্দার প্রতি, বান্দা যেন অশ্রু ঝরিয়ে তারই দ্বারে আবার ফিরে আসে এবং খুশি মনে নতুন শুরুর সুযোগ লাভ করে। এমনই একটি দিন জুমার দিন, আবার একটি রাত্র ক্বদর রজনী এবং অনন্য একটি মৌসুমের নাম মাহে রমজান। আল্লাহর প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমজান মাসের প্রথম দশক রহমতের, দ্বিতীয় দশক মাগফেরাতের এবং তৃতীয় দশক নাজাতের’। (সহীহ ইবনে খুজায়মা)।

মাগফেরাতের সম্পর্ক রমজান মাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মাহে রমজানে কৃত সার্থক ইবাদতের অপরিহার্য ফসল বললেও কোনরূপ অত্যুক্তি হবে না। কেননা এই মাসে সিয়াম সাধনার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মাগফিরাত হাসিল করা। মাগফিরাত লাভ না করেই সমস্ত রমজান কাটানো হলে তা হবে কেবল বারো মাসের স্বাভাবিক একটি মাসের মতই। রমজান এসেছে ক্ষমার সুযোগ দিতে, আর প্রত্যেক বান্দারই কর্তব্য হচ্ছে আল্লাহ পাকের দরবারে পাপের অনুশোচনার মাধ্যমে সেই সুযোগ লুফে নেয়া।

এজন্যই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ঐ ব্যক্তি কতই না হতভাগা! যে কিনা রমজান পেল অথচ নিজের ক্ষমা করিয়ে নিতে পারল না’। (মুজামে তাবরানী)। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে: নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার কাছে জিবরীল এসে বলল, যে ব্যক্তি রমজান মাস পেয়েও ক্ষমা পেল না, আল্লাহ তাকে রহমত থেকে দূরে রাখুন। আপনি বলুন, ‘আমিন’। অতঃপর আমি বললাম, ‘আমিন’। (সহীহ ইবনে হিব্বান)।

মাহে রমজানের শ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো সিয়াম সাধনা। অর্থাৎ সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, ভোগ-বিলাসসহ ঐ সময়ের কতিপয় নিষিদ্ধ কার্যাদি থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এইটুকু করতে পারলেই পাওয়া যাবে সুমহান মর্যাদার পাশাপাশি বহুল প্রতীক্ষিত ঐশী ক্ষমা। সিয়াম পালনকারী বা রোজাদারের পুরস্কার ঘোষণায় আল্লাহ তায়ালা এজন্যই বলেছেন: ‘দানশীল নর ও নারী, রোজাদার নর ও নারী, সমভ্রমের রক্ষাকারী নর ও নারী, এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী নর ও নারী- এদের জন্য আল্লাহ তায়ালা রেখেছেন ক্ষমা ও মহা প্রতিদান। (সুরা আহযাব, আয়াত: ৩৫)।

উল্লিখিত আয়াতের আলোকে প্রত্যেক রোজাদারের প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ পাক দুটো উপহারের কথা বলেছেন। প্রথমটি মাগফিরাত তথা ক্ষমা এবং দ্বিতীয়টি মহা পুরস্কার। সারাদিন উপোস থেকে সিয়াম সাধনার ইবাদত আল্লাহর কাছে বড়ই পছন্দের, তাই পছন্দমতই তিনি পুরস্কার দেবেন। এ তো আর বাকি দশটি সওয়াবের মতই নয়। অনন্য, অনুপম, অনিন্দ্য হবে- তা নিঃসন্দেহে। তাই সিয়াম সাধনার অকল্পনীয় পুরস্কার তিনি নিজ ইচ্ছায় দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘রোজা আমার জন্য, আর আমিই এর প্রতিদান দেবো’। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)।

প্রতিদানস্বরূপ জান্নাতের একটি দরজাই আগে থেকে বরাদ্দ দিয়ে রেখেছেন মহান আল্লাহ তায়ালা। যা উম্মুক্ত করে দেয়া হবে কেবল রোজাদারের জন্য। তার নাম হবে রাইয়ান। মাগফিরাত নিশ্চিত করে জান্নাত অনিবার্য করে নেওয়ার সুযোগ রমজান মাস আমাদেরকে দিয়েছে। সিয়াম সাধনাই পাপ মোচনের এই সুযোগ এনে দেয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার জীবনে কৃত সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে’। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)।

অনেক বান্দা আছেন যারা সারাবছর ইবাদত থেকে কিছুটা দূরত্বে অবস্থান করেন, রমজান মাস এলেই রোজার মাধ্যমে তারাও নিয়মিত ইবাদত পালনে ঝুঁকে থাকেন। এ মাসের রোজা তাকে নিয়ে যেতে পারে অনন্য উচ্চতায়। হতে পারে পুরো মাসজুড়ে স্রষ্টার স্মরণে মগ্ন থাকার ফলে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি এবং হৃদয়ে আল্লাহ পাকের স্মরণ জারি হয়ে গেছে। হাদিস শরীফে এসেছে, ‘রমজান মাসে আল্লাহকে স্মরণকারী ক্ষমাপ্রাপ্ত। এ মাসে যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে চায়, সে ব্যর্থ হয় না’। (মুজামে তাবরানী ও সুনানে বায়হাকী)।

সিয়াম সাধনাকারীকে আল্লাহ পাক এত অধিক পরিমাণে ক্ষমা করেন যে, রমজান পরবর্তী সময়ে তার কোন গুনাহ থাকে না, এমনকি সে নিষ্পাপ শিশুর রূপ ধারণ করে। আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা:) হতে বর্ণিত, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য রমজান মাসের সিয়াম সাধনা করাকে ফরজ করেছেন। আর তারাবিহকে আমিই সুন্নত করেছি। যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে এবং তারাবিহ পড়বে, গুনাহ থেকে সে ঐ দিনের মত মুক্ত থাকবে, যেদিন নবজাতক মায়ের পেট থেকে (নিষ্পাপ হয়ে) জন্ম নেয়’। (সুনানে নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ)।

প্রকৃত রোজাদারের পুরস্কার মাগফিরাত ব্যতীত অন্যকিছু নয়। তবে কেউ যদি রোজা পেয়েও এর হক যথাযথ আদায় না করে, তার মত হতভাগা এই পৃথিবীতে আর নেই। তাই সিয়াম সাধনার মাধ্যমে কৃত পাপের ক্ষমা চাইতে হবে। তবেই নাজাতের পথ আরো সহজ হবে। বিভিন্ন রেওয়ায়েত থেকে জানা যায়, রমজান মাস এলেই রাসুলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকহারে ইস্তেগফার শুরু করতেন। অথচ তিনি ছিলেন মাসুম, অর্থাৎ নিষ্পাপ। ইস্তেগফারের প্রয়োজন তার ছিল না। তিনি উম্মতের জন্য দিবা-রাত্রি ক্ষমাপ্রার্থনা করতেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘আমি দৈনিক এক’শ বারের চেয়েও বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করি’। (মুজামে তাবরানী)।

নবীগণ ব্যতীত পৃথিবীতে শরীয়তের অনুসারী এমন কোন ব্যক্তি নেই, যে কিনা গুনাহ থেকে মুক্ত। সবাই কোন না কোন দিক থেকে পাপে জড়িত। জড়ায়নি এমন দাবি করার সাহস কারো নেই। আর আমরা তো প্রতিনিয়তই গুনাহের সাগরে নিমজ্জিত। সমূদ্রতুল্য এই গুনাহের ক্ষমা করিয়ে নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ প্রদান করেছে মাহে রমজান ও সিয়াম সাধনা। এইজন্য আমাদের প্রত্যেকের উচিত প্রতিদিন অধিকহারে ইস্তেগফার করা। আল্লাহ পাকের কাছে আরজি, তিনি যেন সিয়াম সাধনার ওসীলায় আমাদের সমুদয় গুনাহ মাফ করে দেন। আমীন।