ভার্টিক্যাল ইনটিগ্রেশন শব্দটি দিয়ে শুরু করা যাক। বিভিন্ন ব্যবসাতেই ভার্টিক্যাল ইনটিগ্রেশন টার্মটি ব্যবহার করা হয়। সিনেমা ব্যবসাতেও এর উপস্থিতি রয়েছে। কিন্তু ভার্টিক্যাল ইনটিগ্রেশন বিষয়টি আসলে কী?
প্রথমে আক্ষরিক অনুবাদ করা যাক। ভার্টিক্যাল মানে খাড়া আর ইনটিগ্রেশন মানে মিশ্রন। মানে খাড়াভাবে কোনো মিশ্রন। আক্ষরিক অনুবাদে শব্দার্থ ছাড়া তেমন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তাহলে ভাবানুবাদ করা যাক।
সিনেমা ব্যবসার ক্ষেত্রে, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান যে প্রক্রিয়ায় সিনেমা পরিবেশন এবং প্রদর্শন করেন, সেই সিস্টেমটাই হলো ভার্টিক্যাল ইনটিগ্রেশন। অর্থাৎ, উৎপাদন থেকে সরবরাহ পর্যন্ত বিভিন্ন ভাগে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা নেয়াটাকেই ভার্টিক্যাল ইনটিগ্রেশন বলে। এই ধরুন জাজ মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশন হাউজ, তারা সিনেমা বানাল, ডিস্ট্রিবিউশন বা পরিবেশন করল এবং এক্সিবিশন বা প্রদর্শন করল। এর মধ্যে চাইলে প্রতিষ্ঠানটি সিনেমা মুক্তি না দিয়ে কৃত্তিম সংকট তৈরি করতে পারে বা, বেশি সিনেমা হলে তাদের প্রযোজিত সিনেমা প্রদর্শনের মাধ্যমে বেশি মুনাফা আদায় করতে পারে। এই সিস্টেমটাই হলো ভার্টিক্যাল ইনটিগ্রেশন।
এই সহজ বিষয়টি কিছু কারণে জটিল হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রে। তাই ১৯৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত ভার্টিক্যাল ইনটিগ্রেশন সিস্টেম আইন করে বাতিল করে। এই আইন ‘ইউনাইটেড স্টেটস ভার্সেস প্যারামাউন্ট আইএনসি’ নামে পরিচিত। আইনে বলা হয়, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান (স্টুডিও) সিনেমা হলের (থিয়েটার) মালিক হতে পারবে না। এর কারণ, সিনেমা হলের মালিকানা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকার ফলে সিনেমার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধা হয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর। এমনও দেখা গেছে যে, বেশ কিছু সিনেমা হলে নির্দিষ্ট একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সিনেমা ছাড়া অন্য প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সিনেমা প্রদর্শন করা হচ্ছে না। আর এভাবে তারা সিনেমার বাজার দখলে রাখছে।
১৯৪৮ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এবং সিনেমা হল যাদের আছে, তারা স্বাধীন চলচ্চিত্র প্রযোজকদের সিনেমা ব্যবসায় সুযোগ দিতে চাইত না। ডিজনি’র মতো স্টুডিও সেই সময় পাত্তা পায়নি ভার্টিক্যাল ইনটিগ্রেশন সিস্টেমের কাছে। কারণ ডিজনি’র তখন কোনো সিনেমা হল ছিল না। ২০১৯ সালে ট্রাম্প সরকার ‘ইউনাইটেড স্টেটস ভার্সেস প্যারামাউন্ট আইএনসি’ আইনটি বাতিল করে। এ গেলো যুক্তরাষ্ট্রে সিনেমা ব্যবসার একধরনের দ্রুত বিশ্লেষণ।
১৯১৮, যখন ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী আকার ধারণ করে, তখন হলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি গুটি কয়েক স্টুডিওর কাছে কেন্দ্রিভূত ছিল। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত বেনজামিন বি হেম্পটনের লেখা ‘হিস্টোরি অব আমেরিকান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি’ বইতে ছোট করে তিনি ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীতে সিনেমা শিল্পের অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দগদগে ক্ষতর মধ্যেই ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী আঘাত করে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গার সিনেমাহল বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন এমন পরিস্থিতি হয়েছিল যে ‘সিনেমা’ শব্দটা একটা বাজে শব্দে পরিণত হয়েছিল। সেই সময় বড় বড় স্টুডিওগুলো তাদের নতুন সিনেমাগুলো মুক্তি দেয়া বন্ধ করে দেয় এবং কিছু কিছু জায়গায় পুরনো ছবি প্রদর্শন করতে থাকে।
তখন নতুন কোনো সিনেমা মুক্তি পাচ্ছিল না, তাই একটা প্রভাব এসে পরে সিনেমা হলে। সিনেমা হল বন্ধ হতে থাকে একের পর এক। তবে প্রোডাকশন হাউজগুলো বন্ধ হয়নি। অনেকেই তখন বলতে শুরু করে, এটি হলো সিনেমা শিল্পের ধ্বংসের সূচনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আবার সিনেমা নির্মাণ শুরু হতে দেখা যায়। আর যুদ্ধের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট হয়ে উঠতে থাকে সিনেমার বিষয়বস্তু। হেম্পটন লিখেছেন, ‘সিনেমা দেখতে যাওয়া দর্শকের সংখ্যা অস্বাভাবিকরকম কম ছিল সেই সময়’।
এরপর হেম্পটন যা লিখছেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো, ‘অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান চির বিদায় নিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর কারণে। কিন্তু যারা টিকে ছিল, তারা ধীরে ধীর আরও বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে লাগল। শুধু তাই নয়, ইউরোপ থেকে বিনিয়োগ আসতে শুরু করে সেই সময়। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, দর্শকদের রুচির পরিবর্তন দেখা যায় বিস্ময়করভাবে। পরিচালকদের সুনাম বাড়তে শুরু করে। যা ছিল নতুন হলিউড ইন্ডাস্ট্রি তৈরির সূত্রপাত।’
সিনেমা ব্যবসার অনেক ক্ষেত্রেই ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর সঙ্গে মিলে যায় ২০২০ সালের কোভিড ১৯ মহামারীর পরিস্থিতি। তবে কিছু নতুন যে ঘটতে যাচ্ছে, তার আভাস দিয়েছেন প্রযোজক এলিজাবেথ ক্যান্টিলন। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘২০১১ সালে যখন ইরানি পরিচালক জাফর পানাহি-কে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল, তখন তিনি তার ঘরের মধ্যে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। যার নাম ছিল ‘দিস ইজ নট আ ফিল্ম’। কোভিড মহামারীতেও আমরা এমন অনেক কনটেন্ট দেখব। আর আমি নিশ্চিত এখানে থেকে প্রচণ্ড ভালো ভালো সব কনটেন্ট নির্মিত হবে। অনেক নবীন ও তরুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন শুধু মাত্র তাদের কাজের কারণে।’
পর্যালোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ১৯১৮ সালের মহামারীতে যেমনটা হয়েছিল ২০২০ সালের মহামারীতেও সিনেমা সংশ্লিষ্টরা প্রায় একই পদক্ষেপ নিয়েছেন। পরিবর্তনের মধ্যে যেটা হয়েছে তা হলো সিনেমার ধরন, প্রদর্শন ব্যবস্থা ও দর্শকের পছন্দের পরিবর্তন।
২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারীতেও দেখা যাচ্ছে সিনেমার বিষয়বস্তু পরিবর্তন হচ্ছে সেইসঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে দর্শকদের পছন্দ। সময় এগিয়ে যাওয়ায় সিনেমার হলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওয়েব প্ল্যাটফর্ম। এখন দেখার অপেক্ষা কোভিড কাটিয়ে কবে পৃথিবী ফিরতে পারে রুপালী জগতে। আর তার পরিবর্তন কতটুকুই বা হয়। শৈল্পিক, সাহসী না কল্পনানির্ভর- আাগামির সিনেমা কেমন হবে তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই।
শেষ করছি চলতি বছরের ১৬ মার্চ-এর একটি প্রতিবেদনের তথ্য দিয়ে। লস এঞ্জেলস টাইমসের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘করোনাভাইরাস: নতুন সিনেমা ঘরেই দেখার ব্যবস্থা করছে ইউনিভার্সাল’। তখন প্রযোজনা ও পরিবেশক প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সালের হাতে তিনটি সিনেমা। ছবিগুলো হলো ‘ইনভিজিবল ম্যান’, ‘এমা’ এবং ‘ট্রলস ওয়ার্ল্ড ট্যুর’। তিনটি ছবিই মার্চ ও এপ্রিল মাসে ভিডিও অন ডিমান্ড সিস্টেমে মুক্তি দেয় ইউনিভার্সাল।
এই পদক্ষেপের ফলাফল ভালো হলে ইউনিভার্সালের মতো বিশ্বখ্যাত স্টুডিও প্রেক্ষাগৃহের পাশাপাশি স্থায়ীভাবে মনোযোগী হতে পারে ভিডিও অন ডিমান্ড সিস্টেমে।
লেখক: বিনোদন সাংবাদিক