রাজু আলীম ও সাজেদা হক: বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে দেশ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। যুদ্ধ বিধ্বস্তপ্রায় অবকাঠমোর উপর দাঁড়িয়ে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও কর্মস্পৃহা নিয়ে যাত্রা শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। অত্যন্ত অল্প সময়রের মধ্যে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকে স্বীকৃতি আদায় করেন। তাঁর ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে অল্পদিনের মধ্যে বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারত সৈন্য প্রত্যাহার করে, পাকিস্তানে গৃহবন্দী বাঙ্গালীরা ঘরে ফিরে আসে ও মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রের কাছে অস্ত্র হস্তান্তর করে। এক বছরের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়, প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের শাসন, গঠিত হয় আধুনিক সরঞ্জামাদিতে সুসজ্জিত সুশৃংখল সশস্ত্র বাহিনী এবং কৃষি ও শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমে সূচিত হয় উন্নয়নের ধারা। সাম্য, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার বিরামহীন সংগ্রামে অবিস্মরণীয় ভূমিকার জন্য বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বশান্তি পরিষদ জুলিওকুরি পদকে ভূষিত করে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে বর্বরোচিত হামলার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙ্গালী সেনা সদস্যরা নিজ নিজ অবস্থানে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এ সময়ে বাংলাদেশে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল যশোর সেনানিবাসে, ২ ইস্ট বেঙ্গল জয়দেবপুরে, ৩ ইস্ট বেঙ্গল সৈয়দপুরে, ৪ ইস্ট বেঙ্গল কুমিল্লায় ও ৮ ইস্ট বেঙ্গল চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করে এবং সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
যুদ্ধের প্রথমদিকে বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙ্গালী ব্যাটালিয়ন, ইপিআর, পুলিশ, আনসার এবং মুজাহিদদের মধ্যে কোন সমন্বয় না থাকলেও ধীরে ধীরে এ সমস্ত বাহিনী নিজেদের মধ্যে এই যোগাযোগ স্থাপন করে সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করার পদক্ষেপ নেয়। নিজেদের মধ্যে এই যোগাযোগ রক্ষায় সেনা সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শত্রুকে মোকাবিলা করার গুরুত্ব রক্ষায় সেনা সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শত্রুকে মোকাবেলা করার গুরুত্ব অনুধাবন করে বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তাগণ ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল তৎকালীন হবিগঞ্জ মহকুমার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ডাক বাংলোয় একটি সম্মিলিত বৈঠকের আয়োজন করে। সভায় বাংলাদেমের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী এবং প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ বাহিনীগুলোর কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। এ সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব দেয়া হয় সম্মেলনে উপস্থিত সবচেয়ে জ্যৈষ্ঠ অফিসার কর্ণেল (অবঃ) এম এ জি ওসমানীকে। সভায় সমগ্র বাংলাদেশকে ৪টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করা ছাড়াও সীমান্ত অতিক্রমকারী জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক বাংলাদেশ সরকার গঠনের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়।
কর্ণেল (অবঃ) এমএজি ওসমানী একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন বলে তাঁকে সীমান্ত অতিক্রমকারী অন্যান্য এমএলএ এবং এমপিদের সাথে আলোচনা করে একটি প্রবাসী সরকার গঠনের অনুরোধ জানানো হয়। সভায় সেদিন থেকেই বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাহিনীগুলোকে`মুক্তিবাহিনী’ নামে অভিহিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সরকারিভাবে সংগঠিত হওয়ার পূর্বেই সেনা অফিসারগণ সমন্বিতভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি সংগঠন ও সরকার গঠনের যে তাগিদ অনুভব করেন তা মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটি অত্যন্ত তাৎপযপূর্ণ ঘটনা। তাঁদের এই সাহসী চিন্তা ও পদক্ষেপ মুক্তিযুদ্ধকে সাংগঠনিক ও নিয়ন্ত্রিতভাবে পারিচালনা করার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করে।
এদিকে ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। এ ঘোষনারই আনুষ্ঠানিক বাস্তবায়ন ঘটে ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার চুয়াডাঙ্গা সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারে আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। সুসংহত ও সমন্বিত যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে গঠন করা হয় এস ফোর্স, জেড ফোর্স ও কে ফোর্স নামে সেনাবাহিনীর ৩টি নিয়মিত ব্রিগেড। ঐ সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আরও ৩টি ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠা করা হয়। যুদ্ধে গোলন্দাজ সহায়তা প্রদানের জন্য গঠিত হয় মুজিব ব্যাটারি, রওশন আরা ব্যাটারি ও স্বতন্ত্র রকেট ব্যাটারি। যুদ্ধ চলাকালীন ডাইরেক্টরেট অব মেডিকেল সার্ভিস যাত্রা শুরু করে মুজিবনগর সরকারের অধীনে। এরই ধারাবাহিকতায় পরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করেছিল। এ ১১টি সেক্টর ও এর অধীনস্ত সাব-সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ ত্যাগকারী বাঙ্গালী সদস্যরা।
নবগঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল কর্ণেল (অবঃ) এমএজি ওসমানীকে সরকারিভাবে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করেছিল। এ ১১টি সেক্টর ও এর অধীনে সাব-সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ ত্যাগকারী বাঙ্গালী সদস্যরা। নবগঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ ফোর্সেসের প্রধান সেনাপতি (কমান্ডার ইন চীফ) হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই কর্ণেল (অবঃ) এমএজি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর সকল অংশকে তাঁর নিয়ন্ত্রণে এনে ১১টি সেক্টরের ভিত্তিতে সংগঠিত এবং সামরিক অভিযান পরিচালনা শুরু করেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই দেশমাতাকে মুক্ত করতে বাঙ্গালী সেনা সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের গোপন পরিকল্পনা আঁচ করতে পেরে ২৫ মার্চ রাত থেকেই বাঙ্গালী সেনা সদস্যগণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনানিবাস ত্যাগ করে মুক্তিকামী আপামর জনতাকে সাথে নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রাথমিক প্রতিরোধ থেকে শুরু করে প্রবাসী সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সেনা সদস্যরাই মূলত মিুক্তিকামী জনতাকে সংগঠিত ও প্রশিক্ষিত করে স্বাধীনতা অর্জন অবধি সম্মিলিতভাবে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা পরিচালনা করে।
অপারেশন জ্যাকপট বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৌ সেক্টর পরিচালিত সফলতম গেরিলা অপারেশন। যদিও এটি ছিলো একটি আত্মঘাতি অপারশেন। কারণ এই অপারেশন ১৯৭১ সালে ১৫ আগস্ট রাত ১২ টার পর অর্থাৎ ১৬ আগস্টের প্রথম প্রহরে একযোগে চট্টগ্রাম সমুদ্র, মংলা সমুদ্র বন্দর ও দেশের অভ্যন্তরে, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরে পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিলো তার মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ সকল নৌ চলাচল বন্দর এবং উপকূলীয় এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিলেঅ ১০ নং সেক্টর বা নৌ সেক্টর। তারা সরাসরি মুজিবনগর হেডকোয়ার্টারের অধীনে কাজ করতেন।
১৯৬৭ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও নাবিক মিলে মোট ৫৭ জনের একটি দল সাবমেরিনের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ফ্রান্সে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙ্গালী নাবিক। বাঙ্গালী নাবিকরা বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার মাধ্যমে এ গণহত্যোর খবর জানতে পান। এ খবর শোনার পর ১৩ জনের মধ্যে ৯জন গোপনে বৈঠক করেন। সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তারা অংশ নেবেন। সেই মোতাবেক ২৯ মার্চ ফ্রান্সে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় পাকিস্তানি সাবমেরিন থেকে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে স্পেনের মাদ্রিদে ভারতীয় দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন।
ভারতীয় দূতাবাসের সহযোগীতায় ৮ জন বাঙ্গালী নাবিককে এপ্রিলের ১০ তারিখে ভারতে নিয়ে আসা হয়। এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যান্ত এই ৮ জন বাঙ্গালী নাবিককে ভারতীয় নৌবাহিনীর দিল্লির ও কলকাতার পার্শবর্তী যমুনা নদীতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তারপর আরও কয়েকদফায় কমান্ডো বাছাই ও সংগ্রহ করে তিনটি ব্যাচে মোট ৪৯৯ জনের একটি নৌ কমান্ডো বাহিনী গঠিত হয়। এদের সাথে পাকিস্তান নৌবাহিনী থেকে ফিরে আসা আরও ৮ জন বাঙ্গালী নাবিকও যোগ দিয়েছিলেন।
ট্রেনিং শুরু হবার আগেই বাছাইকৃত যোদ্ধাদের বলে দেয়া হয় যে এটি একটি সুইসাইডাল অপারেশন হবে। তাই অপারেশনের সময় যেকোন মূল্যে অপারেশন সফল করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে তাদের প্রাণ দিতে হতে পারে। তাই প্রশিক্ষণের শুরুতেই প্রত্যেক প্রশিক্ষনার্থীর ছবিসহ একটি সম্মতিসূচক ফর্মে স্বাক্ষর নেয়া হয়। ফর্মে লেখা ছিলো যে, আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু হলে কেউ দায়ী থাকবে না।
আগস্টের ঐ অপারেশনগুলোতেই প্রায় ২৬টি জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং আরও অনেক নৌযান ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আগস্ট মাসের এসব অপারেশন ছাড়াও আগস্ট-নভেম্বর মাসব্যাপী আরও অনেকগুলো নৌ-কমান্ডো অপারেশন পরিচালনা করা হয়। এসব অপারেশনে পাকিস্তানী বাহিনীর আনুমানিক ৫০৮০০ টন জাহাজ ধ্বংস ও নিমজ্জিত হয়, ৬৬০৪০ টন জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বেশ কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি নৌযান বাংলাদেশী নৌ-কমান্ডোদের হস্তগত হয়।
মধ্য আগস্ট থেকে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন অব্দি বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত নৌ কমান্ডোরা কোনরকম নিরাপত্তা ছাড়াই বর্ষার ভয়াল এবং উত্তাল কর্ণফুলি, যমুনা, পশুর, শিবসা, শীতলক্ষা, পদ্মা এবং বঙ্গোপসাগরের বুকে শত্রুর খাছে পৌঁছে শত্রুজাহাজ ধ্বংস করেছেন। বাংলাদেশের বন্দরে নৌ কমান্ডোদের হামলার শিকার হয়ে ধ্বংস হতে থাকলে কোনো বিদেশী জাহাজই বাঙলাদেশের কোন বন্দরে ভিড়তে চায় নি। বহিঃ নোঙ্গরে যখন নৌ কামান্ডো হামলা শুরু হয় তখন দখলদার বাহিনী সরবরাহের ক্ষেত্রে চরম সংকটে পড়ে। মূলত তখন থেকে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অনেক গুরত্ব সহকারে বিবেচিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের গতি পরিবর্তনে এবং পাকিস্তানি যোদ্ধাদের মনোবল ভেঙ্গে দেত বাংলাদেশের নৌকমান্ডোরা বিশেষ ভূমিকা রাখে।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে সমগ্র জাতি যখন পরম আকাঙ্খিত স্বাধীনতা অর্জনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন দেশেকে শত্রুমুক্ত করতে বিমান বাহিনীর বীর যোদ্ধারা মুক্তিপাগল আপামর জনতার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে। নিজস্ব কোন যুদ্ধবিমান না থাকায় অনেকেই নিজেদের জীবন বাজী রেখে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ত্যাগ করে সরাসরি মুক্তিবাহিনীর সাথে স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহন করে। দেশের স্বাধীনতার জন্য অসীম সাহসিকতা ও অসাধারণ দক্ষতায় মুক্তিযুদ্ধকালীন ডেপুটি চীফ অব স্টাফ, সেক্টর কমান্ডার, সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে স্থলযুদ্ধ পরিচালনায় অংশগ্রহণ ছাড়াও নিজেদের জীবনকে বিসর্জন দিতে কুন্ঠাবোধ করেন নি এই বাহিনীর সদস্যগণ।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বিমান বাহিনীর ১১৩৬ জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন। মোট ৫০ জন সদস্য শহীদ হন। ২৩ জন বীরত্বসূচক অবদানের জন্য বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত হন। রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোতে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতিতে সম্পুর্ণভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য একটি মাত্র স্বতন্ত্র বিমান বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনূভূত হয়। আর এ লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ১টি অটার বিমান, ১টি ড্যাকোটা বিমান ও ১টি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার এবং পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পক্ষ ত্যাগকারী বাঙ্গালী বৈমানিক, কারিগরি পেশার বিমানসেনা ও বেসামরিক বৈমানিকসহ মোট ৫৭ জন সদস্যের সমন্বয়ে ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে ‘কিলো ফ্লাইট’ নামে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যাত্রা শুরু করা হয়। বাংলাদেশ ফোর্সেস এর ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আব্দুল করিম খন্দকারের খন্দর নামের ইংরেজি আদ্যক্ষর দিয়ে কিলো ফ্লাইটের নামকরণ করা হয় এবং স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদকে কিলো ফ্লাইটের অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত করা হয়।
ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত এই তিনটি বিমানই ছিল অসামরিক বিমান। এই অসামরিক বিমানগুলোকে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণে ও মেরামতের মাধ্যমে যুদ্ধের উপযোগী করে তোলা হয়। ভারতের পাহাড়ি এলাকা নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে অবস্থিত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় পরিত্যক্ত রানওয়েটিকেও সংস্কার করা হয়। প্রত্যেকটি বিমান উড্ডয়নের জন্য বৈমানিক মনোনীত করা হয়। কঠোর প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে অক্টোবরের মধ্যেই কিলো ফ্লাইট যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। কিলোফ্লাইট মুক্তিযুদ্ধে প্রথম বাংলার আকাশসীমায় প্রবেশ করে ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি এবং নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল জ্বালানী ডিপোর উপর অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে সফল বিমানে আক্রমণ পরিচালনা করে।
১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর অব্দি অটার বিমান ও অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারের মাধ্যমে মোট ৫০টি বিমান অভিযান সাফল্যের সাথে পরিচালনা করা হয়। নবগঠিত বিমান বাহিনী দেশের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের ইস্টার্ণ রিফাইনারি, নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেল ডিপো, সিলেট, শ্রীমঙ্গল, কুমিল্লা, দাউদকান্দি, নরসিংদী, ভৈরববাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় সফল অপারেশনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ওড়ার সাথে সাথে কোনরকম প্রযুক্তি ছাড়া শুধুমাত্র দিকনির্দেশনা নির্ধারক কম্পাস এবং উচ্চতামাপক যন্ত্র অলটিমিটার এর সাহায্য নিয়ে বিমান আক্রমণ পরিচালনা করে এই বাহিনী বিশ্বের বিমান যুদ্ধের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। কিলো ফ্লাইটের প্রত্যেকটি অপারেশনই ছিল এক একটি সুইসাইডাল মিশন। তাদের এই সাহসী পদক্ষেপ মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ করে নতুন মাত্র।
কিলো ফ্লাইট তথা বাংলাদেশ বিমান বাহিনী আকাশপথে সফল আক্রমণ পরিচালনার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এর ফলে অর্জিত হয় আমাদের কাঙ্খিত বিজয় এবং বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।