হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৌদি আরবের মক্কা নগরীর কুরাইশ গোত্রের বনি হাশমি বংশে জন্মগ্রহণ করেন। কোনো কোনো বর্ণনায় তার জন্মের তারিখটি ছিল ৫৭০ খ্রষ্টাব্দের ২ বা ২২ এপ্রিল, ৯ রবিউল আউয়াল। তবে আমাদের দেশে ১২ রবিউল আউয়ালের অভিমত এসেছে বা প্রাধান্য পেয়েছে।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, রাসুল (সাঃ) যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন তিনি বিখ্যাত কেউ ছিলেন না। তার জন্ম তারিখ লিপিবদ্ধও করা হয়নি। তবে তিনি যখন নবুয়তপ্রাপ্ত হন এবং মানবজাতি বুঝে গেলেন যে, তিনিই শেষ নবী তখন বিচার বিশ্লেষণ করে তার জন্মতারিখ নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়।
লেখার শুরুতেই বলে রাখি এটা নিয়ে অনেকে বড় ধরনের বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন যেটা কোনভাবেই ঠিক নয়। কারণ মহান সৃষ্টিকর্তা আমাকে কখনোই প্রশ্ন করবেন না তোমার নবীর জন্ম তারিখ বল? বরং আমাকে প্রশ্ন করা হবে আমি কেন সেই কাজটি করিনি; যেটা তিনি ভালবাসতেন অথবা তার কাজটি যেটা আমার ওপর বিদায় হজের ভাষণে তিনি নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু আমি পালন করিনি?
নবী (সাঃ) কবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার নিজের বয়ানে এসেছে এরকমও নির্ভরযোগ্য কোনো দলিল পাওয়া যায় না।
রসূল (সাঃ) কবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আর কবেই বা চলে গেছেন ইহলোক ত্যাগ করে এসব বিষয় এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে তিনি যেমন ছিলেন, তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তিনি উম্মতদের জন্য যা রেখে গেছেন, তার আদেশ, তার নিষেধ আমরা কতোটুকু নিজেরা করি বা অন্যকে করতে উৎসাহিত করি সেটার কিছুটা বলার চেষ্টা করা। এর মধ্যেই উঠে আসবে তার জীবনের নানা দিক।
জন্মের পরপরই পিতা আব্দুল্লাহকে হারিয়ে এতিম হয়ে যান মোহাম্মদ (সাঃ)। মা আমেনার সঙ্গে তার কাটে ৬ বছর। মায়ের মৃত্যুর পর ৮ বছর বয়সে দাদা আবদুল মোত্তালেবও পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। এতিম মুহাম্মদ (সাঃ) এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন চাচা আবু তালিব।
তৎকালীন আরবের রীতি অনুযায়ী মরুভূমির মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠার মাধ্যমে সন্তানদের সুস্থ দেহ ও সুঠাম গড়নের জন্য জন্মের পরপরই দুধ পান করানোর জন্য বেদুইন মহিলাদের কাছে শিশুদের দিয়ে দেওয়া হতো। নির্দিষ্ট সময়ের পর আবার ফিরে আসতো পরিবারে। নবী (সাঃ) কেও দেওয়া হয়েছিল হালিমা বিনতে আবু জুয়াইবের হাতে। তার কাছে থাকার সময়ই মহান সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদে বেশ কয়েকবার অলৌকিক কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন হালিমা।
চাচা আবু তালিব ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসার কাজে বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতে হত তাকে। মুহাম্মদ (সাঃ) এর বয়স যখন ১২ তখন তিনি প্রথম চাচার সঙ্গে সিরিয়া যান। যাত্রাপথে রাজ্যের রাজধানী বসরা শহরে পৌঁছার পর কাফেলাসহ তাঁবু ফেলা হয় সেখানে।
কথিত আছে, জারজিস সামে নামে এক খ্রিস্টান পাদ্রী ছিলেন শহরটিতে। তিনি তার গীর্জা থেকে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারি করেন। সেসময় তিনি মুহাম্মদ (সাঃ)কে দেখে শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেন। নবীর বয়স যখন ১৫ তখন তিনি ফজ্জরের যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের নির্মমতা দেখে তিনি ব্যথিত হন, তবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কিছুই করার ছিল না তার।
আরবদের মধ্যে সে সময় হিংস্রতা, মারামারি, রক্তারক্তি আর প্রতিশোধস্পৃহা লেগেই থাকতো। সামাজিক অনাচার রোধে সেই সময় গঠন করা হয় হিলফুর ফুজুল নামক একটি সামাজিক সংগঠন। এতে যোগদান করেন নবী (সাঃ)। এই সংগঠন তার নেতৃত্বে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে।
তরুণ বয়সে মুহাম্মদ (সাঃ) অন্যের সেবা করতেন। তার নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না। তবে বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ আছে তিনি বকরি চরাতেন। বনি সাদ গোত্রের বকরি চরাতেন তিনি। এক সময় নবী (সাঃ) ব্যবসা শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বস্ততায় চারদিকে সুনাম ছড়িয়ে পরে তার। তাকে উপাধি দেওয়া হয় আল আমিন হিসেবে।
ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে সিরিয়া, বসরা, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বেশ কয়েকবার সফর করেন তিনি। নবী (সাঃ) এর সততা এবং দক্ষতার খবর জানতে পারেন সেই সময়ের শীর্ষ ব্যবসায়ী খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ। খাদিজার প্রস্তাবে তার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হন নবী। এক পর্যায়ে নবী (সাঃ) খাদিজার এক বান্ধবীর মাধ্যমে বিবাহের প্রস্তাব পেলে নবী তার চাচার সঙ্গে আলোচনা করে পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের সময় খাদিজার বয়স ছিল ৪০ আর মুহাম্মদ (সাঃ) এর ২৫।
মুহাম্মদ (সাঃ) এর ১৫ বছর পর ৪০ বছর বয়সে নবুওয়ত লাভ করেন। নবুওয়ত সম্পর্কে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় আজ-জুহরির বর্ণনায়। জুহরি বর্ণীত হাদিস অনুসারে নবী সত্য দর্শনের মাধ্যমে ওহি লাভ করেন। ৩০ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পর নবী প্রায়ই মক্কার অদূরে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটাতেন। তাকে নিয়মিত খাবার দিয়ে আসতেন স্ত্রী খাদিজা।
নবী (সাঃ) এর কাছে আল্লাহ প্রেরিত প্রথম ওহী হচ্ছে ‘পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’
এরপর ইসলাম প্রচারের কাজে সম্পৃক্ত হন নবী (সাঃ) তার জীবনকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে মক্কী জীবন। আর অন্যটি মদীনায় হিজরত। তিন বছর গোপনে দাওয়াত দেয়ার পর মুহাম্মদ (সাঃ) প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার শুরু করেন। তার ধর্ম প্রচার শুরুর পর বহু মানুষ যেমন ইসলাম ধর্মে আসতে শুরু করেন তেমনি শত্রুও বেড়ে যায়। শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র ও অত্যাচার।
মদীনা ছাড়াও ইথিওপিয়ায় হিজরত, এক ঘরে আটক থাকার মত অবস্থা, মিরাজে গমনসহ বর্ণাঢ্য জীবন তার। মুহাম্মদ (সাঃ) মদীনায় গিয়েছিলেন একজন মধ্যস্থতাকারী এবং শাসক হিসেবে। মদিনার সব গোত্রকে নিয়ে ঐতিহাসিক মদীনা সনদ সই করেন তিনি। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে মদীনা সনদ। হুদাইবিয়ার সন্ধিও পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় একটা চুক্তি।
রসূল (সাঃ) সারা বিশ্বে সবার কাছে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়কদের কাছে পত্র ও দূত প্রেরণ করতেন। সেসময় পৃথিবীর প্রধান রাজশক্তিগুলো ছিল ইউরোপের রোম সাম্রাজ্য, এশিয়ার পারস্য সাম্রাজ্য এবং আফ্রিকার হাবশা সাম্রাজ্য। এই কার্যক্রমের কারণে ছড়িয়ে যেতে থাকে ইসলামের কার্যক্রম।
বিদায় হজ্জ থেকে ফেরার পর হিজরী ১১ সালের সফর মাসে মুহাম্মদ (সাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হন। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি এগারো দিন নামাজের ইমামতি করেন। ওই বছরেরই রবিউল আউয়াল মাসের ১ তারিখ সন্ধ্যায় তিনি মৃত্যবরণ করেন।
তার আয়ুকাল ৬৩ বছর হলেও বিশাল জীবনী তার। কয়েক পাতায় তা শেষ করা মোটেই সম্ভব নয়। তবে তার আদর্শ, তার বাণী আজ সারা বিশ্বেই। রসূল (সাঃ) জন্ম আর মৃত্যুর তারিখ নিয়ে আমরা যতোটা তর্কে জড়িয়ে পড়ি, তার আদর্শের বিচ্যুতি হলে অনেকেই চুপ মেরে বসে থাকি। শত শত বছর আগে প্রকাশ্যে খালি হাতে ইসলামের যে বিজয় এনেছিলেন মুহাম্মদ (সাঃ) আজ কি আমরা তার এক ভাগও পারছি? অথচ বিদায় হজের ভাষণে তিনি তো আমাদের উপরই দায়িত্ব দিয়েছেন তার অসমাপ্ত কাজগুলো যেন তার উম্মতরা এগিয়ে নিয়ে যান। আমরা কি তা পারছি?
রাসূল (সাঃ), তার সাহাবী থেকে শুরু করে ইসলামের স্বর্ণ যুগে একজন মানুষকেও অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া হয়নি। পেছন থেকে দেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ আজ? আজ কি হচ্ছে তার কি বর্ণনা দেওয়ারও প্রয়োজন আছে? রাসূল (সাঃ) কে জীবনে কোনো ব্যক্তি প্রথমে সালাম দিতে পারেননি। তিনিই হাত উঁচু করে সালাম দিতেন। আর এখন কেন যেন সবকিছু পাল্টে গেছে। সালাম নেয়ার জন্য সবাই অপেক্ষায় থাকে।
নবী (সাঃ) এর আদেশ হুকুম আর নির্দেশগুলো পালন না করাই যেন অনেকের রেওয়াজ হয়ে গেছে। ইসলাম ধর্মের দেশগুলোতেই আজ যেন সব অনাচার। একজন শাসকের মধ্যেও সেই শত শত বছর আগের মুসলিম শাসকদের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বড় বড় দেশগুলোর সমালোচনা করার আগে নিজেদেরও তো পরিবর্তন হওয়া চাই। সেই পরিবর্তন হতে হলে সত্যিকার অর্থেই পরিপূর্ণ মানুষ হতে হবে। কোরআনকে আঁকড়ে ধরতে হবে, আর সঙ্গে রাখতে হবে রাসুল (সাঃ) এর জীবনী ও আদর্শ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। এ লেখাটির ভাষারীতিও লেখকের নিজস্ব)