বঙ্গবন্ধু-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণ আপাতত: এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিষয়টি দু’ দিকেই যেতে পারে। আজ উৎক্ষেপণ হলেও সাফল্যের পুরো জায়গাটি নিশ্চিত হতে আমাদের অন্তত এক মাস সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নিজ দ্রাঘিমায় পৌঁছানোর পর নানা-জটিল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এই সময়টা খরচ হবে।
তবে এতোটুকু পর্যন্ত যা হয়েছে তাতেও আমরা যে মহাকাশে আমাদের জায়গা দখল করতে যাচ্ছি সেটা স্যাটেলাইট বিশ্বকে মোটামুটি জানান দেওয়া গেছে। আড়ম্বরটা আমরা যথেষ্ট করেছি, এখন সাফল্য ঘরে তুলতে পারা পরের চ্যালেঞ্জ।
টেলিকম-তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে যুগাধিকাল কাজ করার সুবাদে সেই ২০০৮ সালে যখন স্যাটেলাইটের জন্যে অরবিটাল স্লট পেতে আবেদন করা হল তখন থেকেই আছি এই প্রক্রিয়ার মধ্যে। কাজ করতে করতে জেনেছি, একেক দেশ বলতে গেলে চুপিসারেই মহাকাশে তাদের জায়গা নিশ্চিত করেছে। আর এ পর্যায়ে এসে আমাদের আয়োজন দেখে গর্বের মধ্যেও মনেমনে কেমন যেন একটা খটকাও লেগেছে, ‘তবে কি আমরা কি একটু বেশীই হৈ-চৈ করে ফেলছি?’
এই যেমন, গত বছর মে মাসে ভারত মহাকাশে ছেড়ে দিল দক্ষিণ এশিয়া স্যাটেলাইট। এই স্যাটেলাইটটির ধারণা প্রথম আসে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে। আর উৎক্ষেপণ করতে লাগে তিন বছরেরও কম সময়। আর আমরা এক দশক ধরে কাজ করছি নিজস্ব স্যাটেলাইট নিয়ে!
কারো কারো হয়তো মনে হতে পারে, সাফল্য গানের মধ্যে কেনো এমন প্রসঙ্গ আনছি!
এখানে বলা প্রয়োজন, দক্ষিণ এশিয়া স্যাটেলাইটের মালিকানা আমাদের হাতেও আছে; তারপরও কবে, কয়টার সময় বা কোথা থেকে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ হবে সেটি কিন্তু উৎক্ষেপণ হওয়ার আগে আমরা কেউ-ই জানতেও পারিনি।
ভারত এখন ডজন ডজন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করছে। কিন্তু আগেভাগে কেউ কি তার কিছুই জানতে পারছে? উত্তর হল ‘না’।
চলুন যাই শ্রীলংকায়। এই দেশটি প্রায় আমাদের সমসাময়িক সময়ে স্যাটেলাইটের প্রকল্প নিয়েও ২০১২ সালেই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে ফেলেছে। তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেন উৎক্ষেপণের আগে তাদের মিডিয়াতে এ নিয়ে একটি খরবও আসেনি। এর মানে এই নয় যে, তাদের সাফল্যের খবর কেউ জানতে চায় না। আসল বিষয়টি হল– সারা দুনিয়াতেই অতিগোপনীয়তার সঙ্গে শুভ কাজটি সেরে ফেলা হয়। সফল হলে তারপর উৎসব। আমাদের ঘোরতর শত্রুতা যে পাকিস্তানের সঙ্গে তারাও কিন্তু আগেভাগে কাউকে কিছুই জানতে দেয়নি।
অথচ আমরা যখন ৫৭তম দেশ হিসেবে মহাকাশে সম্মানের আসন নিতে যাচ্ছি তখন ঢাক-ঢোল-বাদ্য সব বাজিয়ে মাঠে নেমে পড়েছি। বাংলাদেশের একজন গর্বিত নাগরিক হিসেবে এই অর্জনে আমিও আনন্দিত-অন্দোলিত এবং উৎফুল্লও আছি খানিকটা। কিন্তু সাফল্য চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করার পরই আনন্দ মিছিলে যেতে চাই আমি।
আনন্দের পরের ধাপে কঠিন বাস্তবতার যে সাফল্য, আমি তার সামনে দাঁড়াতে চাই। চাই স্যাটেলাইটের পুরো সুফল ঘরে তুলতে। এখানে শুধু কথার কথায় হবে না। বঙ্গবন্ধু-১ থেকে ব্যাবসায়িক সাফল্য চাই, সম্মান অর্জনের সাফল্য চাই (যেটা এর মধ্যেই অনেকটা হয়েছে), চাই ডিজিটাইজেশনের পথে স্যাটেলাইট নির্ভর যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়ন।
বলা হচ্ছে, দুর্গম এলাকায় সংযোগ, বিশেষ করে ইন্টারনেট স্থাপনের জন্যে কাজ করবে এই স্যাটেলাইট। দুর্যোগের সময় হবে সবচেয়ে বড় সহায়। আমার বিবেচনায় এই দুটিই আসলে হতে পারে বঙ্গবন্ধু-১ থেকে আমাদের বড় চাওয়া।
তবে প্রথম চাওয়াটির ক্ষেত্রে সরকারের বড় ভূমিকা লাগবে। সাধারণভাবে আমরা জানি, স্যাটেলাইটের ব্যান্ডউইথের দাম অত্যন্ত চড়া হয়। উদাহরণ হিসেবে বলছি, এখন সাধারণ ব্যান্ডউইথ যে দামে গ্রাহক কেনে সেটির চেয়ে অন্তত একশগুণ দাম বেশী হবে স্যাটেলাইটের ব্যান্ডউইথের দাম। ফলে স্যাটেলাইটের ব্যান্ডউইথ দিয়ে সেবা দিতে হলে সরকারের কী পরিমাণ ছাড় দিতে হবে, তার চিন্তাও করে রাখতে হবে।
স্যাটেলাইটের আয়ের জায়গায় সরকারের দিকে থেকে সবচেয়ে বেশী করে প্রচার করা হচ্ছে টেলিভিশনগুলোর সম্প্রচার সুবিধার কথা। এখানেও একটি উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হবে পরিস্থিতি।
বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমায়। পরীক্ষামূলক কার্যক্রম হিসেবে আমাদের দেশেরই একটি চ্যানেল কিছুদিন আগে ১২১ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমার একটি স্যাটেলাইট থেকে সংযোগ নিয়ে তাদের সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা পেয়েছে, তাতে তাদেরকে ধরে-বেঁধে আনা ছাড়া এখানে আনা মুশকিলের হবে। একটু বৃষ্টি হলেই নাকি ওই স্যাটেলাইটের সংযোগ আর কাজ করে না।
আবহাওয়ার পূর্বাভাষের জন্যে আমাদের এই স্যাটেলাইট কোনো কাজেরই হবে না, সেটাও সবার জানা থাকা দরকার। অনেকে অবশ্য এখানেও সাফল্য দেখছেন। এটি কেবলই কমিউনিকেশনস স্যাটেলাইট এবং যোগাযোগই এর একমাত্র কাজ।
তাহলে আর বাকি থাকল কী? বিদেশী কোম্পানির কাছে স্যাটেলাইটের ক্ষমতা বিক্রি করা। আসলে খরচের টাকা তুলে আনার জন্যে এটিই সবচেয়ে বড় উপায়। কিন্তু তার জন্যে দরকার যথাযোগ্য পরিকল্পনা। সেখানে আমাদের প্রস্তুতি কতোটা আছে তাও দেখা দরকার। অন্য স্যাটেলাইটগুলো যখন মহাকাশে ওড়ার আগেই তাদের ক্যাপাসিটি অগ্রিম বিক্রি করে দেয় বা দিতে পারে সেখানে আমরা এখন পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ায় তেমন একটা অগ্রসর হতে পারিনি।
আর সবকিছুর আগে দরকার স্থানীয় পর্যায়ে স্যাটেলাইটের ক্ষমতা ব্যবহারের জন্যে অবকাঠামো তৈরি করা। সেটা নিয়েও ঘোরতর সংশয় আছে। কারণ সম্ভাবনা কেঁচো গণ্ডূষ করে দেওয়ার জন্যে আমরা যে এক উৎকৃষ্ট জাতিতে পরিণত হয়েছি, সেটা তো আর অজানা নয় কারো।
দিন কতক আগে, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, সরকারের এই কোম্পানিকে স্যাটেলাইটের জন্যে তৈরি করা দুটি গ্রাউন্ড স্টেশনের মধ্যে আন-ইন্টারেস্টেড অপটিক্যাল ফাইবারের সংযোগ তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেশ কয়েক মাস হয়ে গেলেও তারা কিছুই করতে পারেনি।
এই ভদ্রলোকের নেতৃত্বের সময়টাতেই গত বছর দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলের সংযোগ পেতেও আমাদেরকে অনেক বিলম্ব হয়েছিল। নানা কারণে কাজ বিলম্বে করা এবং দায়সারা গোছের কাজের কারণেই দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলের যেমন আমাদের অনেক সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়েছে না জানি আবার স্যাটেলাইটেও তেমন কিছু লিখতে হয়!
সরকার ওই ব্যক্তির চুক্তি বাতিল করেছে। কিন্তু সময় নষ্ট এবং সম্ভাবনা অপচয় করার মাধ্যমে যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে তার দায় কে নেবে?
এতোশতের পরেও আমি আশাবাদী। কারণ জানি, বুকভরা আশাবাদ আর গর্ব নিয়ে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচিয়ে চলতে পরার অর্জন স্যাটেলাইট। গতকাল উৎক্ষেপণ হয়নি, তাতে কি? আজ হবে। মহাকাশে যাওয়ার পথে সাফল্য ধরা দেবেই। আর সে কারণেই মহাকাশে বাংলাদেশকে স্বাগতম জানাচ্ছি। বাংলাদেশের স্যাটেলাইট রাজত্ব বিস্তৃত হোক। প্রস্ফুটিত হোক সাফল্যগাথা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)