বাংলাদেশের ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের নিকটবর্তী ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যাবে দর্শকপ্রিয় সিনেমা ‘মনপুরা’র নাম। মানবিক প্রেম-বিরহের গল্পে নির্মিত সিনেমাটির নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম। সেসময় তরুণ ছিলেন, নির্মাতা হিসেবে। বয়সেও। প্রথম সিনেমা দিয়েই যিনি বাঙালির ‘বিত্ত’ভেদ করে পৌঁছে গিয়েছিলেন নিম্ন,মধ্য ও উচ্চবিত্তের ড্রয়িং রুমে। সব শ্রেণির মানুষই গোগ্রাসে নিয়েছিলেন ছবিটি। এরপর দীর্ঘদিন আর তাকে পাওয়া যায়নি। বড়পর্দায়। প্রায় নয় বছর পর এই মাধ্যমে ফিরছেন তিনি। তবে এবার আরো পরিণত, চিন্তায়। চেহেরায়ও কিছুটা বয়স্কতার ছাপ। শিগগির বড় পর্দায় আসছে তার দ্বিতীয় ছবি ‘স্বপ্নজাল’। ছবির খবরাখবর জানতেই গিয়াস উদ্দিন সেলিমকে চ্যানেল আই অনলাইনের ফোন…
হ্যালো…। কেমন আছেন?
জ্বী, ভালো আছি।
আনুষ্ঠানিকভাবে ‘স্বপ্নজাল’-এর প্রচারণা শুরু করলেন?
আনুষ্ঠানিকভাবে বলতে যা বোঝায়, তা না। আসলে আগামি পাঁচ তারিখে আমাদের ছবিটা প্রিভিউ কমিটি দেখবে। তারা দেখার পর সিনেমাটা আমরা সেন্সরে পাঠাবো। খুব তাড়াতাড়ি দর্শকের কাছে ছবিটি নিয়ে আসতে চাই বলে মঙ্গলবার আমরা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। এখন থেকে টুকটাক ছবিটির প্রচারণা করবো এরকমভাবে।
‘স্বপ্নজাল’-এর এখনো মুক্তি চূড়ান্ত করেননি?
ওইতো সেন্সর সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার পর মুক্তি চূড়ান্ত করবো।
সামনের সপ্তাহেই সেন্সর পেয়ে গেলে সেই ক্ষেত্রে সিনেমাটি নিয়ে মুক্তির পরিকল্পনা কী?
এরকম হলে সেন্সর পাওয়ার পর প্রমোশনের জন্য আমরা অন্তত পনেরো দিন টাইম নিবো। তারপর ছবিটি দর্শকের কাছে ছেড়ে দিবো।
ঠিকাছে। আমরা একটু মনপুরার সময়টায় যাই…
জ্বী…
মানুষকে হলমুখি করতে ‘মনপুরা’ ছবিটি উদাহারণের জায়গায় চলে গেছে। এটাকে কি নির্মাতা হিসেবে চাপ মনে করেন কিনা?
না আমি কোনো চাপ মনে করি না। একদমই চাপ মনে করি না। মনপুরা আলাদা একটি ছবি। স্বপ্নজালও আলাদা একটি ছবি। সবকিছু আলাদা। চাপের কিছু নাই।
তাহলে ২০০৯ সালে ‘মনপুরা’র পর ২০১৮ সালে ‘স্বপ্নজাল’ নিয়ে আসছেন, এই দীর্ঘ গ্যাপ কেনো?
প্রডিউসার পাইনি।
প্রডিউসার পাননি…!
জ্বী,মনপুরার পর আমি প্রডিউসার পাইনি। মনপুরার পর ‘কাজল-রেখা’ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু প্রডিউসার পাইনি। অনেকদিন লেইট করেছি, প্রডিউসার না পাওয়ায় সিনেমা করিনি। এরপর স্বপ্নজালে হাত দিয়েছি।
ব্যবসাসফলতার দিক থেকে ‘মনপুরা’র মতো ইতিহাস সৃষ্টি করা ছবি নির্মাণের পরও প্রযোজক পাননি, এটা শুনতেওতো কেমন লাগে?
কিন্তু এটাই সত্য। ট্রুথ! বিভিন্ন প্রডিউসার যোগাযোগ করেছে, ছবি করতে চেয়েছে। কিন্তু সেই ছবি করলে আমাকে প্রডিউসারের ছবিটায় করতে হতো আরকি! হয়তো উনার গল্প, বা উনার ভাই নায়ক বা উনার নায়িকা এরকম আরকি! এজন্য করিনি।
মানে সবকিছু প্রডিউসারের ইচ্ছাধীন!
আমিতো আমার মতো করে সিনেমাটা করতে চাই। এখন কোনো প্রডিউসার এসে যদি যদি বলে তার জীবনের গল্প দিয়ে একটা সিনেমা বানাতে, সেটা আমি কেন করতে যাবো! এরকম কাজ করার চেয়ে না করাই ভালো।
কিন্তু ‘মনপুরা’র পর পরইতো ‘কাজল-রেখা’র কাজে হাত দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, তখন এই ছবিটা করতে চেয়েছিলাম। এটার বাজেট একটু বেশি ছিলো। অনেক অপেক্ষার পর এটার জন্য প্রডিউসার পেলেও গণজাগরণের সময় দেশে যখন অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়েছিলো তখন প্রডিউসার পিছিয়ে গেল। সিনেমাটার প্রায় সব কিছুই গুছিয়ে এনেছিলাম, কিন্তু দেশে টানা দুয়েক বছর অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করায় আর হলো না। তবে সামনে ‘কাজল রেখা’ হবে বলে আশা রাখি।
প্রেম-বিরহকে ‘মনপুরা’তে চিত্রায়ন করেছেন। স্বপ্নজালেও এমনটার আভাস পাওয়া গেল। প্রেম-বিরহকেই সিনেমায় বারবার প্রসঙ্গ করার ফিলোসফিটা যদি জানতে চাই আপনার কাছে?
মনপুরার পর আমার দ্বিতীয় ছবিও লাভ স্টোরির। কিন্তু আমিতো ছবিতে শুধু লাভ স্টোরিই দেখাই না, সমাজেরও কথা থাকে। দেখা যাক এখন কি হয় এটাতে(স্বপ্নজাল-এ)। আর একভাবে বললে, প্রেমের মতো সহজ জিনিষ আর কি আছে জগতে! অনিন্দ্য সুন্দর একটা অনুভূতি তৈরি করে মানুষের মধ্যে। প্রেম নিয়ে কতো শত কবিতা, হাজার হাজার গল্প, লক্ষ লক্ষ উপন্যাস সৃষ্টি হয়ে আছে। আর আমি দুইটা ছবি বানাতে পারবো না!
অবশ্যই পারবেন সেলিম ভাই, আমি কিন্তু আপনাকে চার্জ করছি না যে আপনি কেনো ‘প্রেম’কে প্রসঙ্গ করছেন। আমি শুধু সিনেমায় প্রেমকে সাবজেক্ট করার ব্যক্তিগত কোনো ফিলোসফি আছে কিনা জানতে চাইছি!
আমার ফিলোসফি খুব সিম্পল। আমি চাই বর্তমানে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে যে অবস্থা তাতে আমার ছবি দেখতে দর্শক হলে যাবে। এটাই আমি চাই। আমি দর্শকের জন্য সিনেমা বানাই। দর্শক দেখলে আমার ইন্ডাস্ট্রি গতি পাবে।
এক ছবি নির্মাণের পর দীর্ঘ নয় বছর গ্যাপ। মাঝখানের এই গ্যাপে বাংলা সিনেমা নিয়ে আপনার অবজার্ভেশন কী?
আমি খুব বেশি ফলো করি নাই। তবে যা দেখেছি তাতে দেখেছি আমাদের মেইনস্ট্রিমে রেপ্লিকা সিনেমা বেশি হইছে। তামিল, তেলেগুর রেপ্লিকা ছবি। আর এর বাইরে যারা সিনেমা নির্মাণ করেছেন তাদের বেশির ভাগই আসলে বাইরের দর্শকের জন্য সিনেমা নির্মাণ করেছেন। বিভিন্ন পুরস্কার, ফেস্টিভাল নির্ভর ছবি বানিয়েছে। সাধারণ দর্শকের জন্য খুব একটা সিনেমা হয়নি। মেইনস্ট্রিমেরগুলোই সাধারণের জন্য হইছে, কিন্তু এগুলো অনেক বেশি তামিল তেলেগুলোর রেপ্লিকা।
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন মেইনস্ট্রিম যে সিনেমাগুলো হয়, এগুলোতো তামিল-তেলেগুর অবিকল বাংলা চিত্রায়ন, আর বাকিরা যা নির্মাণ করেন এগুলো ফেস্টিভালের জন্যই?
না না। আমি কিন্তু এরকম ভাগ করছি না। আমিও কিন্তু মেইনস্ট্রিমের লোক। এক্ষেত্রে আমি একেবারে বাংলাদেশের সিনেমা বানানোর চেষ্টা করছি। মানে তামিল-তেলেগুর রেপ্লিকা বানাতে চাই না আরকি। আর রেপ্লিকা সিনেমায়তো ফলো করার কিছু থাকেও না। এগুলোতো সারা বিশ্বেই ওপেন। এখন তামিল-তেলেগুর এই বাংলা রেপ্লিকা দেখার থেকে তামিল-তেলেগুর অরিজিনালটা দেখাই ভালো না!?(হাসি….) মারামারি, কাটাকাটি, অ্যাকশান!(একটু থেমে…) আসলে একটু জীবনমুখি সিনেমা হলেই ভালো।
গত নয় বছরে বাংলাদেশে আপনার কাছে কোনগুলোকে জীবনমুখি সিনেমা মনে হয়েছে?
(কিছুক্ষণ চুপ থেকে) দর্শকরা যে সিনেমাগুলো গ্রহণ করেছে এগুলোই জীবন মুখি সিনেমা(হাসি…)!
আপনি এসব জায়গায় খুব ডিপ্লোমেসি বজায় রাখছেন…!
না। আসলে একটা জায়গায় বিভিন্ন জনরার সিনেমা হবে। প্রত্যেকে তার নিজের মতো সিনেমা বানাবে। এগুলো বিচার করবে দর্শক। আমরা নির্মাতারা বিচারক না। দর্শক দেখলে সিনেমা ভালো, আর না দেখলে বিপদ। এই আরকি! আমি ফিল্ম ক্রিটিক হলে অবশ্য বলে দিতে পারতাম, এই ছবি হয়েছে, ওটা হয়নি। কিন্তু আমিতো মেকার।
যাইহোক, মনপুরা হিট করার জন্য গান বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু স্বপ্নজালের মুক্তি ঘনিয়ে আসলেও এটার ক্ষেত্রে এমন লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না?
স্বপ্নজালতো গানের সিনেমা না। আর সবকিছু ‘মনপুরা’ দিয়ে বিচার করাও ঠিক হবে না। স্বপ্নজাল তার নিজের মতো একটি ছবি। মনপুরার সাফল্যের ক্ষেত্রে গান ভূমিকা রেখেছে সত্য, কিন্তু সেটা সেই সিনেমায় ডিমান্ড করেছে। স্বপ্নজালেও গান আছে, কিন্তু এটা স্বপ্নজালের মতো গান। আর মনপুরার সময় সিডির একটা বাজার ছিলো। কিন্তু এখনতো সব অনলাইনে। আর এজন্যও স্বপ্নজালের গান আমরা বাজারে ছাড়িনি। তারপরেও একটা গান হয়তো প্রমোশনের সময় আমরা ব্যবহার করবো। আর বাদবাকিগুলো সিনেমা যারা দেখবেন তারা পাবেন। সিনেমার জন্যই গান আসলে, গানের জন্য সিনেমা নয়।
মনপুরার পরতো আপনি মাঝখানে টিভি ফিকশনও নির্মাণ করেছেন। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে শোনা যায়, সিনেমা থেকে ছোটপর্দায় নির্মাণে আসলে নাকি এর প্রভাব বড় পর্দায় কাটিয়ে উঠা যায় না?
তা না। আমার কাছে এরকম মনে হয়নি কখনো। টেলিভিশনে আমি সব সময় কাজ করতে চাই। এটা অনেক বড় একটা মিডিয়াম। এখানে কাজ করাকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখি। অনেক মানুষ একসঙ্গে বসে দেখতে পারে। ধরেন একটা ভালো নাটক যদি হয়…। ও আচ্ছা, আমি কিন্তু টিভি ফিকশন বলি না, টিভি নাটকই বলি বা টেলিভিশন নাটক বলি। আমাদের বাংলা টেলিভিশন নাটকের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। হুট করে কেউ এসে এটাকে টিভি ফিকশন বলে দিলো, এটা আমার বিশেষ পছন্দ না। আমি সেই পরম্পরায় বিশ্বাস করি।
টিভি নাটক দিয়েই কিন্তু আমার ক্যারিয়ার শুরু। আমি সুযোগ পেলেই টেলিভিশনের জন্য নাটক করতে চাই। কারণ টেলিভিশনের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে।
টেলিভিশন নিয়ে যেহেতু কথা ওঠলোই তাহলে বলা যেতে পারে, এখনতো টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলো টেলিভিশনে মানুষ কম দেখছে। ইন্টারনেটেই বেশি দেখছে। বা টেলিভিশনের কন্টেন্টগুলোই ইন্টারনেট ভিত্তিক বিভিন্ন প্লাটফর্মের মাধ্যমে দর্শকের কাছে যাচ্ছে। মিডিয়ামের এই বদলে যাওয়াকে কীভাবে দেখেন?
খুব পজিটিভলি দেখি। আমার ধারনা আমাদের দেশের টেলিভিশনের সঙ্গে জড়িত মানুষদের অদূরদর্শীতার কারণে বেশি তাড়াতাড়ি এটা অন্য প্লাটফর্ম নির্ভর হয়ে গেছে। এখনো পর্যন্ত ফ্যামিলি মিডিয়াম হিসেবে টেলিভিশনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যাদের সময় নাই, যারা ব্যস্ত, যারা মোবাইলে দেখেই অভ্যস্ত সেটাও একটা বিরাট সংখ্যা, কিন্তু তারপরেও এখনো কিন্তু দেখবেন প্রচুর মানুষ ইন্ডিয়ান চ্যানেল দেখছে। ওদের সিরিয়াল দেখছে। আসলে টেলিভিশনের এখনো দর্শক আছে, কিন্তু তাদের জন্য আমরা প্রপার কন্টেন্টটা দিতে পারছি না। টেলিভিশন সংশ্লিষ্টদের পলিসিগত দুর্বলতার জন্যই আমরা টেলিভিশনের দর্শক হারাচ্ছি। বাজেটের দৈন্যতা, মানহীন প্রোডাকশন, বাজে কন্টেন্ট, বিজ্ঞাপনের বিরক্তি সব মিলিয়ে আমরা দর্শক হারিয়েছি।
সাম্প্রতিককালে কোনো টিভি প্রোডাকশন করেছেন?
না, ইদানিং কোনো নাটক করিনি। গত দুই ঈদেও করিনি। না করার কারণ হলো বাজেটের দৈন্যতা। এই সময়ে এসেও যদি ২০০১ সালের বাজেট ধরিয়ে দেয়া হয় তাহলেতো আর হবে না।
ধরুন দুর্ভাগ্যক্রমে ‘মনপুরা’র মতো ব্যবসাসফল হলো না ‘স্বপ্নজাল’। বা ফ্লপ করলো ছবিটি, তাহলে পরবর্তী ছবি কতোদিন পরে আসবে? পরবর্তী ছবি কি ‘স্বপ্নজাল’-এর সফলতার উপর নির্ভর করবে?
না। স্বপ্নজাল মানুষ গ্রহণ করলে ভালো, আর না করলেতো কিছুই করার থাকে না। কাজতো আর থেমে থাকে না। কাজতো চালিয়ে যেতেই হবে। আমার পরের ছবির কাজও শুরু হয়ে গেছে। এরইমধ্যে স্ক্রিপ্ট-এর কাজ গুছিয়ে নিয়েছি।
ওটা কি ‘কাজল রেখা’?
না, ‘কাজল রেখা’ আরেকটু পরে করবো। এটা অন্য একটা ছবি। এই ছবির পরে ‘কাজলরেখা’ করার ইচ্ছে আছে। আপাতত এই ছবি নিয়ে কিছু বলতে চাইছি না। এখন ছবির বাজেট তৈরি হচ্ছে।
ছবি: সংগৃহিত