অনুষ্ঠানটি আড্ডার। যার সঙ্গে আড্ডা তার বর্ণাঢ্য শিল্প জীবন। মঞ্চ কিংবা টেলিভিশনে তার বিশাল ব্যাপ্তি। অভিনয়ে-নির্দেশনায়। সে তুলনায় সিনেমায় তার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। ‘সিনেমায় আমার অভিনয় করতে ভয় লাগে। কন্টিনিউটির ভয়। সেই কন্টিনিউটি যে পোশাকে তা নয় অভিনয়েরও অভিব্যক্তির কন্টিনিউটি থাকে।’ আড্ডার অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলছিলেন খ্যাতিমান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের।
আড্ডায় উঠে আসে তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ। তিনি বলেন, ‘এখন ৯৫ পারসেন্ট টেলিভিশন নাটক দেখা যায়না। অসুস্থতায় কাটিয়েছি দীর্ঘদিন। সেখান থেকে অনেকটা সুস্থ হয়েছি। তবে যেটা হয়েছে ভোর ৪ টার দিকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ৮টার আগে ঘুম আসেনা। সে সময় টেলিভিশনে বিভিন্ন চ্যানেলে নাটক দেখা আমার কাজ। তাতে যা অবস্থা দেখি তাতে খারাপ লাগে। কোন একটি নাটকে এমন একটি সংলাপ রয়েছে যে, নাটক ঘরের মধ্যেই হয়া যাইব বাইর হওয়া লাগবনা। পুরো পরিস্থিতি তাই হয়ে গেছে।’
এদিকে চ্যানেল আই অনলাইনের দুটি প্রশ্ন উপস্থাপিত হয় আলী যাকের সমীপে। প্রথম প্রশ্ন, ‘আপনি নিজে বলছিলেন সেই ৭২ এ বহু বচনের ভাঙ্গনের কথা। এই ভাঙ্গা গড়া মঞ্চে কতখানি অনিবার্য? সেটা কি শিল্পের স্বার্থে নাকি কেবলই ব্যক্তিত্বের তথা ইগোর সংঘাত? আপনার সাড়ে দশকের অভিজ্ঞতা কি বলে?’ দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, ‘আপনার মতে শিল্পীর জীবনে শিল্পে রাজনৈতিক অভিঘাত কিভাবে ছাপ ফেলে? তিনি উত্তর দেন দারুণ স্থিরতায়। বলেন, ‘যখন দেখব আমার চিন্তা কিংবা দক্ষতা আমি ঠিকমত প্রয়োগ করতে পারছিনা পূর্ণ মেধা থাকা স্বত্বেও তখন ইগোও তৈরি হবে দলও ভাঙ্গবে। সেক্ষেত্রে মঞ্চে দল ভাঙ্গা দোষের কিছু নয়! যদি তাতে শিল্পসম্মত কিছু তৈরি হয়। কোলকাতার বাংলা মঞ্চ নাটকের দিকে তাকালেও এ সত্য প্রতিভাত। নান্দীকার ভেঙ্গেছে। বিভাস রায়ের দলের ভাঙ্গনে তো অকাল মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।’ অন্য প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করি। যা হয়তো কোন দলের সঙ্গেও মেলে। কিন্তু রাজনীতি আমার চিন্তাকে খর্ব করতে চাইলে তা আমি করবোনা। দরীয় কার্যক্রম করার জায়গা মঞ্চ নয়। আমি মঞ্চে রাজনীতিকে দেখি শিল্পের চোখে।’
‘নাট্য নির্মাণ ও চরিত্র সৃজনে দুঁদে কারিগর আলী যাকের’র সাথে কিছুক্ষণ’ শীর্ষক এই ভিন্নমাত্রার আড্ডার আয়োজন করে ঢাকার মঞ্চে নতুন নাট্যদল থিয়েটার ফ্যাক্টরি। শুক্রবার দুপরে শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার হলে জমে ওঠে আড্ডা। যার সূচনা হয় অভিনেতা ড. ইনামুল হক এবং মফিদুল হকের আলোচনার মধ্য দিয়ে। তারা দুজনে আলী যাকের সম্পর্কে নিজেদের কিছু অভিজ্ঞতা এবং মতামত তুলে ধরেন।
ড. ইনামুল হক বলেন, আমি তাকে ছোটলু বলেই ডাকি। এত স্মৃতি যে বলে শেষ করা যাবেনা। চরিত্রকে বিশ্লেষণ করে তুলে ধরার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে তার। ডিরেক্টরিয়াল জায়গায় কখনও রাগতনা। যার ভেতরে ন্যুনতম অভিনয় ক্ষমতা দেখেছে তাকে তুলে এনেছে। তবে তার আরও অনেক নাটক লেখা উচিত ছিল। যা সে করেনি। ফলে মঞ্চ বঞ্চিত হয়েছে।
প্রায় তিন ঘণ্টার আড্ডায় ‘গ্যালিলিও গ্যালিলিও’ এর গ্যালিলিও কিংবা ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ এর নূরলদীন আলী যাকের তার দীর্ঘ নাট্য অভিযাত্রার অভিজ্ঞতার বয়ানে নানান মাত্রায় উদ্ভাসিত হয়েছেন। বলেছেন নিজের গড়ে ওঠার পথ পরিক্রমা কিংবা দিয়েছেন স্বীকারোক্তি। বলেছেন, ‘আমাদের মত দেশে ব্যবসায়িক সব ব্যাপারে সৎ না হলেও প্রাণের কাজের ব্যাপারে সৎ ছিলাম সবসময়। থিয়েটারকে খেয়ে ফেলার অসৎ ব্যবসায়িক প্রয়াস রয়েছে। তবে জীবন যতদিন আছে ততদিন ঠেকিয়ে যাব।’
আড্ডায় আরও উপস্থিত ছিলেন নাট্যজন ম.হামিদ, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের আক্তার হোসেন, নির্মাতা কাওসার চৌধুরী, আপন মাহমুদ, অভিনেতা আশীষ খন্দকার, ত্রপা মজুমদার, শতাব্দী ওয়াদুদ প্রমুখ।