স্পর্ধা প্রযোজিত শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণ দেখতে ১৫ মার্চের দ্বিতীয় প্রদর্শনীতে গিয়েছিলাম। জাতীয় নাট্যশালার মূল প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করতেই মঞ্চের যতদূর স্থান রয়েছে তার সবটাই ব্যবহারের ইঙ্গিত চোখে পড়ে। হালকা নীল আলো ছড়ানো প্রায় নেপথ্যগৃহ পর্যন্ত। মঞ্চের দুইপাশের পর্দাও ওধাও। সৈয়দ জামিল আহমেদ মঞ্চে বড় পরিসর নিয়ে কাজ করতেই পছন্দ করেন। তাঁর পূর্ববর্তী কাজের ধারা এমতো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে আমাদের বাধ্য করে। আমরা অবাক হয়ে দেখি শূন্য একটি তল মাত্র কুড়িজন কলাকুশলীর পদচারণায় কীভাবে মুখরিত হয়ে উঠছে। কঠিন একটি টেক্সটকে তাঁরা আবৃত্তি করে যাচ্ছেন অবলীলায়।
বর্ণনাত্মক রীতির যে শক্তি তাই অভিনেতাদের চলনে–বলনে ফুটে উঠছিল। দুই ঘণ্টাব্যাপ্তির নাট্যে অভিনয়ের ভাগ সে অর্থে বেশি নয়। বিবৃতিই ছিল প্রধান চালিকাশক্তি। তার নেপথ্য কারণ হয়তো বা, নির্দেশক উপন্যাসের কাঠামোকে না ভেঙ্গেই মঞ্চে নিয়ে আসতে চেয়েছেন। নাট্যরূপে তার ব্যত্যয় ঘটত নিঃসন্দেহে।
নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের একাডেমিক প্রয়োজনে সেলিম আল দীনের নির্দেশনায় ২০০২ সালে আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ মঞ্চায়ন করেছিলাম। ২৩তম মঞ্চায়ন শেষে সেলিম স্যারের ইচ্ছেতেই সে নাট্যের মঞ্চায়ন সমাপ্ত করা হয়। ‘উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণ’ শীর্ষক অভিধায় চিহ্নিত সেই নাট্যেও উপন্যাসটি নাট্যরূপ ব্যতিরেকেই মঞ্চায়িত হয়েছিল। ঢাকা থেকেও কেউ কেউ দেখতে গিয়েছিলেন ওই প্রযোজনা। সেখানে একটি আত্মহত্যার দৃশ্যের তিন থেকে চারবার পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়েছিল।
এসব বলার কারণ রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নাট্যে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেন? কেউ কেউ বলছেন বর্ণনাত্মক নাটক দেখতে দেখতে ‘শ্বাসরোধী’ অবস্থার কালে ‘বর্ণনাহীন’ এই নাট্য খানিক ‘উপশম’।
তো যে কথা বলছিলাম, অভিনয়ের ভাগ হ্রস হওয়ার পরও বদু মওলানার চরিত্রে শরীফ সিরাজের অভিনয় নজরকাড়া। কিশোর আবদুল মজিদরূপী সউদ চৌধুরী, যুবক আবদুল মজিদ শোভন দাস এবং মোমেনা চরিত্ররূপী মহসিনা আক্তারের অভিনয় ভালো লেগেছে। সংলাপ কিংবা বর্ণনাদানে অভিনেত্রীদের যে প্রক্ষেপণ কৌশল, জামিলস্যারের পূর্ববর্তী প্রযোজনা ‘রিজওয়ান’-এও তাই ছিল। এ থেকে ধারণা অমূলক নয় যে, টেনে টেনে বলার এই ধারাই সম্ভবত তিনি রাখতে চান। হয়তো এরমধ্য দিয়ে তিনি দর্শককে সচকিত রাখতে চান এই কারণে যে, দর্শক থিয়েটার দর্শনে এসেছে এ বিষয়টি প্রতিনিয়ত যেন ক্রিয়াশীল থাকে। এ নিয়ে আমি আপত্তির কিছু দেখি না। ভিন্নস্বাদ হিসেবে ভালোই লেগেছে আমার।
রাজাকার পুত্রের অতিকায় মূর্তিরূপে মঞ্চপ্রবেশ, তার বিশাল কালো হাতের মধ্যদিয়ে নির্দেশক তাদের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড আর ষড়যন্ত্রের জালবিস্তারে সিদ্ধহস্ততার বিষয়কেই যেন বা ইঙ্গিত দিয়ে যান। তাতে দর্শক হিসেবে ভেতরে ভয় জেগে ওঠে!
অভিনেতাদের শারীরিক সক্ষমতা, একইসঙ্গে সবকিছু করে ওঠার যে যান্ত্রিকতা তারও একটি নান্দনিকতা রয়েছে। এই ঐকতান আমাদের থিয়েটারে খুব একটা চোখে পড়ে না ইদানিং। ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’য় তা ছিল পুরোপুরি। সেটের অভিনব ব্যবহার চমকিত করে। যেনবা ওই সময়টুকুকে ভেঙ্গে নতুনকিছু গড়ে উঠুক, হেলে পড়া সেটের বিন্যাস থেকে এমন একটি বার্তা উড়ে আসছিল।
সৈয়দ জামিল আহমেদের প্রযোজনায় আলো বড় ভূমিকা রাখে। এবার অবশ্য সেই দিকে চোখ যায়নি আলাদা করে। অর্থাৎ আলো পুরো প্রযোজনার সঙ্গে মিশে গিয়ে তার পৃথক অস্তিত্ব খুইয়েছে।
সৈয়দ জামিল আহমেদ সবসময়ই নতুন চিন্তা-দর্শনের বিচ্ছুরণ ঘটাতে চান তাঁর নাট্যে। এমনটাই দেখে এসেছি। তাঁর কাছে প্রত্যাশাও তাই। না হতাশ হইনি এবারও। এ ভূখণ্ডের বাঙালি মানসকে তিনি যথার্থই পাঠ করতে পেরেছেন। নইলে একটি মহল্লার গল্পের ভেতর দিয়ে সারা দেশের মানুষের দ্বিধাগ্রস্ততার চিত্র তুলে ধরতে পারেন কীভাবে? আমরা দেখি উপন্যাসের দ্বিধাগ্রস্ত মানুষ নাট্যের ছাঁচে কেমন সামনে-পেছনে দুলতে থাকে। জাতি হিসেবে আমরা এমনই দোদুল্যমান। বিভক্তও বটে। জামিল স্যারকে অভিনন্দন নতুন একটি কাজ আমাদের উপহার দেবার জন্য।
তবে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ভেতরে। শহীদুল জহির তাঁর উপন্যাসে রাজনৈতিক নেতা আজিজ পাঠান ও বদু মওলানার মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে কথোপকথন লিখেছেন এভাবে, ‘আজিজ পাঠান ব্রাশ দিয়ে দাঁত ঘষছিল আর বারে বারে জানালা দিয়ে রক্ত আর লালা মাখানো পেস্টের আবিল ফেনা ফেলছিল। সে মুখের ভেতর জড়ো হয়ে আসা লালা আর ফেনা মেঝেয় পড়ে যাওয়া রোধ করতে করতে ভাঙা ভাঙাভাবে বদু মওলানাকে এবার ভালো হয়ে যেতে বলেছিল, সে বলেছিল যে, তার নেতা যেহেতু বদু মওলানাদের মাফ করেছে, তার নিজের কোনো প্রতিহিংসা নাই ।’
আবার, আবদুল মজিদের সঙ্গে যখন আজিজ পাঠানের দেখা হয় তখনকার বর্ণনা শহীদুল জহির দেন এভাবে, ‘এই কথা শুনে তখন আজিজ পাঠান যেন তার মর্মস্থল দেখতে পায় এবং বিষণ্নভাবে হেসে আবদুল মজিদের কাঁধের ওপর প্রাচীন বৃক্ষ শাখার মতো তার শিরা-ওঠা হাত রাখে। সে তাকে বাসায় নিয়ে যায় বহুদিন পর এবং তার সঙ্গে এত কথা বলে যে, আবদুল মজিদ তার প্রায় কিছুই বুঝতে পারে না, শুধুমাত্র একটি কথা ছাড়া, তা হচ্ছে এই যে, রাজনীতিতে চিরদিনের বন্ধু অথবা চিরদিনের শত্রু বলে কিছু তো নেই, কাজেই অতীত ভুলে যাওয়া ছাড়া আর কিইবা করার থাকে মানুষের।’
উপরোক্ত অংশ দু’টি সৈয়দ জামিল আহমেদ ঔপন্যাসিকের মতো করে নয়, তাঁর মতো করে ব্যবহার করেছেন। এতে করে অর্থচ্যুতি কী ঘটেছে? এখন জিজ্ঞাসা দুটি।
এক. যদি তাঁর মতো করে ব্যবহার করেই থাকেন তবে, সাধারণ ক্ষমা যে সবার প্রাপ্য ছিল না সে প্রসঙ্গ নিয়ে আসা যেত। কারণ এটি, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা প্রচার করে থাকে যে, সাধারণ ক্ষমা সবাইকেই করা হয়েছিল।
দুই. অর্থচ্যুতি যদি ঘটে থাকে তবে সেই দায়টুকু কার? কেনই বা তা হবে।
এসবই আমার একান্ত বিবেচনা। কেউ কেউ ভিন্নভাবে ভাবতেই পারেন। সবকিছুর পরও সবাইকে বলবো, নাটকটি দেখুন। অন্যকারো বলা থেকে নয়, নিজের চোখে দেখে তারপরই না হয় খোলাসা হলেন।
ছবি: রিয়াজুল রিজু