করোনার থাবায় আক্রান্ত যখন বিশ্ব তখন এ থেকে মুক্তি পেতে ভ্যাকসিন এসেছে। কয়েকটি দেশে এর প্রয়োগও শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও এই ভ্যাকসিন এসেছে। গত বৃহস্পতিবার ভারত সরকারের উপহারের বিশ লাখ চার হাজার ডোজ ভ্যাকসিন বাংলাদেশ গ্রহণ করেছে। ভ্যাকসিন আসার আগে একধরনের আলোচনা ছিল, আসার পর শুরু হয়েছে অন্য আলোচনা।
আগে ভ্যাকসিনের অগ্রাধিকার নিয়ে যে আলোচনা ছিল সে স্থান দখল নেওয়ার পথে এখন অবিশ্বাস। এখন গুজব আর অপপ্রচারের মুখে আছে দেশ। অপপ্রচারে শামিল নন যারা তাদের অনেকেই পড়ে গেছেন বিভ্রান্তিতে। এরসঙ্গে আছে রাজনৈতিক বক্তব্যও। সবমিলিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থা, মনস্তাত্ত্বিক এক লড়াইয়ের মুখোমুখি দেশ। করোনায় পর্যুদস্ত জনজীবনে যে ভ্যাকসিন আলোর রেখা দেখানোর কথা সেখানে এমন পরিস্থিতি বিস্মিত হওয়ার মতই।
বিজ্ঞানীরা করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করছেন এখনও। প্রয়োগ পর্যায়ে কিছু কোম্পানির ভ্যাকসিন উপনীত হলেও এটা নিয়ে কাজ করার সুযোগ এখনও আছে বলে সে সব নিয়ে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। দেশে-দেশে প্রয়োগকৃত ভ্যাকসিনে যেখানে যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে সেগুলোও নিয়ে কাজ চলছে। আশা করা যায় ফাস্ট জেনারেশন এই ভ্যাকসিনের এই পর্যায় সম্পন্ন হলে তখন সেকেন্ড জেনারেশন ভ্যাকসিন পাবে বিশ্ব, তখন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হারটাও কমে যাবে নিশ্চিতভাবেই। এখন যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সেটা মূলত মাত্র এক বছর কিংবা তার চেয়েও কম সময়ের মধ্যে উদ্ভাবিত বলে এখানে যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়নি।
ভ্যাকসিন নিয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন, করবেনও। এটা বায়োলজিক্যাল ব্যাপার। এ সম্পর্কিত বহুল আলোচনা-সমালোচনা-অনিশ্চয়তা সাধারণের জন্যে ক্ষেত্রবিশেষে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারও হয়ে দাঁড়ায়। এ লড়াইয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে অনেক কিছুই করতে হয় দেশে-দেশে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের। এখানে মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরির একটা ব্যাপার জড়িত থাকে, সে কাজটা করতে হয় অনেক সময়। এই যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্টকে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রসারিত অনুষ্ঠানে ভ্যাকসিন নিতে দেখা গেছে। ৭৮ বছর বয়স্ক জো বাইডেন নিজে ভ্যাকসিন নিয়ে কম সময়ের মধ্যে উদ্ভাবিত এই ভ্যাকসিন যে কার্যকর সে বার্তা জনগণকে দিতে চেয়েছেন। একই কাজ করেছেন দেশটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস, তারও উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ ভ্যাকসিন গ্রহণে উৎসাহিত হয়েছে নিঃসন্দেহে।
৭৮ বছর বয়স্ক জো বাইডেন ও কমালা হ্যারিস নিয়েছেন ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন। এই একই কোম্পানির ভ্যাকসিন গ্রহণ করে নরওয়েতে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে। নরওয়ের মেডিসিন এজেন্সি বলেছে, ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা নেওয়ার পর জ্বরসহ বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তাদের। জো বাইডেনই কেবল নন জনগণকে উদ্বুব্ধ করতে ভ্যাকসিন নিয়েছেন ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ এবং ডিউক অব অ্যাডিনবার্গ প্রিন্স ফিলিপ। রানির বয়স ৯৪ বছর আর তার স্বামীর বয়স ৯৯ বছর। এখন পর্যন্ত ফাইজার-বায়োএনটেক এবং মডার্নার ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাজ্য। এগুলোর মধ্যে যেগুলোই তারা নিন না কেন এই ভ্যাকসিন যে অকার্যকর ও ক্ষতিকারক নয় সেটা তাদের বর্তমান শারীরিক অবস্থা থেকেই প্রমাণিত। বাইডেন, রানি এলিজাবেথের বাইরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু, পোপ ফ্রান্সিসও নিয়েছেন করোনার ভ্যাকসিন। ভ্যাকসিন নিয়েছেন সৌদি আরবের ৯৪ বছর বয়েসি বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ। চীনের তৈরি সিনোভ্যাক ভ্যাকসিন নিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো। এছাড়াও দেশে-দেশে আরও অনেক নেতা তাদের দেশের জনগণকে উদ্বুব্ধ করতে ভ্যাকসিন নিয়েছেন, এবং অন্যদের ভ্যাকসিন নিতে অনুপ্রাণিত করছেন। খ্রিস্ট ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ত বিশ্ববাসীকে ভ্যাকসিন গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে এটাকে নৈতিক দায়িত্ব বলেও মন্তব্য করেছেন।
ভ্যাকসিন কার্যকর কি না এই আলোচনা এখন সবচেয়ে বেশি চলছে আমাদের এই উপমহাদেশে। ভারতে ভ্যাকসিন গ্রহণে মানুষের অনাগ্রহের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসছে। এই অনাগ্রহের কারণে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই ভ্যাকসিন নিতে পারেন বলে খবর বেরিয়েছে। মোদিসহ ভারতের অনেক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এই ভ্যাকসিন গ্রহণের কাতারে শামিল যে হবেন সেটা বলাই যায়, কারণ সবার আগে মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করতে হবে, তা না হলে পুরো কর্মসূচিই ব্যর্থ হয়ে যাবে। আর এই গণভ্যাকসিনেশন ব্যর্থ হলে করোনার ঝুঁকি বাড়বে নিশ্চিতভাবেই।
ভারতে গণভ্যাকসিনেশনের এই পর্যায়ে কিছু মানুষের দেহে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার যে খবর আসছে সেটা গণহারে নয়। ভ্যাকসিন গ্রহণের পর একজন মানুষও অসুস্থ হলে সেটা নিশ্চিতভাবেই সংবাদমূল্য পাওয়ার দাবি রাখে, তবে এই সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে এখানে উদ্বেগ বাড়ছে ব্যাপকভাবে। এর ওপরও গণভ্যাকসিনেশনের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করছে। মানুষ ভয় পেয়ে গেলে সমস্যা। এই ভয়ের বিষয়টি কেবল ভারতেই প্রভাব ফেলছে না, এরপ্রভাব বাংলাদেশেও এসে পড়ছে। এতে করে আমাদের এখানে ভ্যাকসিন আগে পাওয়ার দাবি নিয়ে যে বা যারা অপেক্ষার কথা বলছিল তাদের অনেকের মাঝেও শঙ্কা কাজ করছে। এটা শুভ লক্ষণ নয়। এই শঙ্কা দূর করতে হবে আমাদের। এখানে সরকারি পর্যায়ের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা দরকার যেমন তেমনই দরকার উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির। এই উদ্বুব্ধকরণ কর্মসূচির সবকিছুর যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকতে হবে সেটাও না। এজন্যে এ কাজে এগিয়ে আসতে পারেন মন্ত্রী, এমপি, আমলা, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা।
লক্ষণীয় বিষয় হলো দেশে করোনার ভ্যাকসিন আসার দিনই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল শুরুতেই এই ভ্যাকসিন নেওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তার এই আগ্রহ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তার এই আগ্রহ সাধারণকে ভ্যাকসিন গ্রহণে উৎসাহ জোগাবে। তার বাইরে আরও কোন মন্ত্রী কিংবা এমপির আগ্রহের কথা অন্তত এই লেখাটা সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত চোখে পড়েনি। বলছি না তাদেরকে নিতেই হবে, কিন্তু তারা অর্থমন্ত্রীর মত এমন ঘোষণা দিলে এর প্রভাব প্রান্তিক পর্যায়েও পড়ত ব্যাপকভাবে।
ভ্যাকসিন নিয়ে দেশে যে অহেতুক সন্দেহের বীজ বপন করা হয়েছে সেটা আমাদের জন্যে সুখের খবর নয়। এই সন্দেহ আর অবিশ্বাস ডালপালা মেলছে এ সম্পর্কীয় কিছু রাজনৈতিক বক্তব্যে। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সম্প্রতি বলেছেন, “বিএনপি যদি আগে ভ্যাকসিন নিতে চায় আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করতে পারি বিএনপিকে যেন আগে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।” এর জবাব দিতে দেরি করেননি বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভি। তার মন্তব্য, “কোনো কোনো মন্ত্রী যখন বলেন, বিএনপি চাইলে করোনার টিকা তাদেরকে সবার আগে দেওয়া হবে, তখন এই টিকার প্রতি মানুষ গভীর ষড়যন্ত্র খুঁজে পায়।” পাশাপাশি রিজভি আরও বলেন, “আমি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে আহ্বান জানাব, পৃথিবীর দেশে দেশে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা যেভাবে টিকার প্রথম ডোজ নিয়ে মানুষকে আস্থা ও ভরসা দিচ্ছেন, আশ্বস্ত করছেন আপনারাও সেই পথ অনুসরণ করুন। তাদের মত আপনারাও সাহসী পদক্ষেপ নিন। টিকা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা কাটাতে সহায়ক হবে। অনাগ্রহ কাটিয়ে দেশবাসীকে টিকায় আগ্রহী করে তুলবে।” আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন বলছেন, “দেশে ভিআইপিরা নয়, যাদের আগে প্রয়োজন তাদেরই করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।”
ভ্যাকসিন রাজনৈতিক বিষয় না হলেও কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীন কিছু বক্তব্যের কারণে এটাও রাজনৈতিক বিষয় হয়ে ওঠার পর্যায়ে। এরসঙ্গে যুক্ত রয়েছে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা। এখানে আবেগের ব্যাপার জড়িত হয়েও পড়েছে। ভ্যাকসিনের এই পর্যায়ে এখানে মানুষ ভেদে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলেও সেটা এখন পর্যন্ত প্রাণনাশের হুমকির পর্যায়ে যায়নি বলে বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রক কোন সংস্থা এর বিরুদ্ধে বলছে না, বরং তারা ভ্যাকসিন গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে চাইছে। দেশে-দেশের নেতারা ভ্যাকসিনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়াতে নিজেরা এগিয়ে আসছেন, বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এখানে সন্দেহ, গুজব, অপপ্রচার এবং সহজাত আস্থাহীনতার যে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই সে লড়াই জেতা জরুরি হয়ে পড়েছে। এখানে যেখানে দরকার উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি সেখানে সেটাই করা উচিত আমাদের।
জনগণকে ভ্যাকসিন গ্রহণে অনুপ্রাণিত করতে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সামনে রেখে প্রচার-প্রচারণা চালালে সাফল্য আসবে বলে বিশ্বাস হয় না। কারণ তিনি তার নানা কথার ফাঁকে গত আগস্টে করোনাভাইরাস বাংলাদেশ থেকে এমনিতেই চলে যাবে, বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের দরকার পড়বে কি না জানি না- এমনও মন্তব্য করেছিলেন। এছাড়াও করোনার পুরোটা সময় ধরে তিনি অনবরত নানা বিতর্কিত মন্তব্য করে গেছেন যা মানুষের আস্থার জায়গায় ফাটল ধরিয়েছে। আস্থাহীনতার যে জায়গা সেটা তার মাধ্যমে বেড়েছে দিন-দিন। ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনৈতিক বাগযুদ্ধে না দিয়ে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধকরণ পন্থা অবলম্বন করুন। মানুষের মাঝে ভ্যাকসিনের আগ্রহ তৈরি করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানো জরুরি। স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিতদের এই প্রচারণার আওতায় আনা দরকার। তাদের প্রচারণাগুলো দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে ইতিবাচকভাবে পৌঁছাবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচারণাগুলোর অধিকাংশই নেতিবাচক। নেতিবাচক এই প্রচারণা ব্যাপকভাবে বিস্তারের আগে সমাজের প্রভাববিস্তারকারী মানুষদের ইতিবাচক প্রচারণায় আনা দরকার। নেতিবাচক প্রচারণাগুলো সমাজে বিশ্বাস কিংবা সিদ্ধান্ত হিসেবে প্রভাব বিস্তারের আগে ইতিবাচক প্রচার দিয়ে সেগুলো মোকাবেলা করতে হবে। কেবল বিশেষ কোনো অ্যাপ দিয়েই ভ্যাকসিন নিবন্ধন কার্যক্রম সফল হবে না। নিবন্ধন কার্যক্রমে ইউনিয়ন পর্যায়ের ডিজিটাল সেন্টারগুলোকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে হবে। এই ডিজিটাল সেন্টারগুলোতেও নিবন্ধন করা যাবে এটার ব্যাপক প্রচার করতে হবে, পাশাপাশি সেন্টারগুলোর উদ্যোক্তাদের জনবান্ধব ভূমিকা পালন করতে হবে।
করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে যে বা যারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ না হয়েও স্রেফ সন্দেহের বশে ভুল প্রচারণায় নেমেছেন তারা কাকে শত্রুজ্ঞান করে এসব করছেন সে প্রশ্ন তাদের উদ্দেশ্যে। যারা গুজবে মত্ত তারা নিজেরাও করোনার ঝুঁকির বাইরে নয়, অন্য সকলের মত তারাও ভ্যাকসিনে খুঁজে পেতে পারেন জীবনের রসদ। মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে জেতা যায় না, পরাজয় অবধারিত। পরাজিতের কাতারে নাম না লিখে তাই সবাইকে নিয়ে জয়ী হওয়ার চেষ্টা করুন!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)