শাসনের সুবর্ণজয়ন্তীর বছর ১৮৮৭ সালে ব্রিটেনের রাণী ভিক্টোরিয়া নিজেকে তৈরি করছিলেন তার শাসনভুক্ত বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে সম্মাননা ও আনুগত্যের নিদর্শনের ঢেউ সামলানোর জন্য।
ভারতীয় উপমহাদেশে তার শাসনকাল ২৯ বছর হয়ে গেছে। তাই এ উপলক্ষে সুবর্ণজয়ন্তীর উপহার হিসেবে ভারত থেকে ভিক্টোরিয়ার জন্য উপহার হিসেবে মোহাম্মদ বকশ ও আব্দুল করিম নামের দু’জন ভারতীয় ভৃত্য পাঠানো হয়।
আগ্রার কারাগারের কেরানি ২৪ বছর বয়সী আব্দুল করিমকে ব্রিটেনে পাঠানো হয়েছিল মাত্র মাস দুয়েকের জন্য। কিন্তু সেই দু’মাস পরিণত হয়েছিল প্রায় দু’দশকে।
দাস বা ভৃত্যের দায়িত্ব নিয়ে রাজপ্রাসাদে যোগ দেয়া আব্দুল এক বছরেরও কম সময়ে হয়ে যান রাণীর ‘মুনশি’ বা শিক্ষক। রাণীকে হিন্দি ভাষা শেখাতেন তিনি। ভারতবর্ষের সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া অঞ্চলটির প্রতি ভীষণ কৌতুহলী এবং আকৃষ্ট হলেও কখনো সেখানে পা রাখেননি। তাই ভারত সম্পর্কে জানা আর তৎকালীন প্রচলিত হিন্দি শেখার জন্য আব্দুলের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন তিনি।
বয়সের ভারে ক্লান্ত, স্থূল, বিধবা, একাকিত্বে জর্জরিত আর জীবনের ওপর বিরক্ত ভিক্টোরিয়া হতাশা দূর করতে সারাক্ষণ খাওয়ার মাঝেই ডুবে থাকতেন। বুঝতে পারতেন তার নয় ছেলেমেয়ে কেউই তার আপন নয়। সবাই সাম্রাজ্য পাওয়ার লোভে একে অন্যের শত্রু হয়ে আছে। তাদেরই একজন তৎকালীন প্রিন্স অব ওয়েলস বার্টি লাম্পট্যের সীমা ছাড়িয়ে চেষ্টায় আছেন কীভাবে রাণী ভিক্টোরিয়াকে সরিয়ে সপ্তম এডওয়ার্ড হিসেবে সিংহাসনে বসা যায়।
এতসব অশান্তির মাঝে আব্দুল করিমকে যেন একবিন্দু প্রশান্তির আলো হিসেবে পেলেন বৃদ্ধা রাণী। মুনশি ছাড়াও আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ভারতীয় মুহুরি হিসেবে নিয়োগ দেন তিনি। প্রতিদিনের ভাষা শিক্ষা ক্লাস, বেতনবৃদ্ধি, রাজপরিবারের সদস্য এবং গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের মতো পোর্ট্রেট তৈরির নির্দেশ এবং ভারতীয় কারির প্রতিদিনের রয়্যাল মেনুর অংশ হয়ে যাওয়া – সবকিছুই আব্দুলের প্রতি রাণীর মুগ্ধতাকেই নির্দেশ করছিল। ভারতীয় কারির সঙ্গে আব্দুলই রাণীর পরিচয় করিয়েছিলেন।
আব্দুলের প্রতি রাণীর মায়া বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল রাজপ্রাসাদে আব্দুলের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ। একদিকে ওই সময় ঘরে-বাইরে সর্বত্রই বর্ণবাদের ছড়াছড়ি ছিল। তার মাঝেই আব্দুলকে ভারত থেকে আসা সব ভৃত্যের প্রধান করে দিলেন রাণী, দিলেন থাকার জন্য আলাদা কটেজ, স্ত্রী-শাশুড়িকে ভারত থেকে তার কাছে এনে রাখার ব্যবস্থা করলেন, রাজ-রেলে তার জন্য নিজস্ব বগির ব্যবস্থা করা হলো, এমনকি আগ্রা জেলের মেডিক্যাল সহকারী তার বাবাকে নাইট খেতাবে পর্যন্ত ভূষিত করা হলো।
অথচ ভিক্টোরিয়ার ভীষণ ঘনিষ্ঠ ভৃত্য জন ব্রাউন সবকিছুর পরও একজন ভৃত্যই ছিলেন। রাণীর বিশেষ আচরণে আব্দুলের মাঝেও একটা অহংবোধ তৈরি হয়েছিল। সব মিলিয়ে রাজ পরিবারের প্রায় সবাই চলে গিয়েছিল আব্দুলের বিরুদ্ধে। বার্টি তো মায়ের এই নতুন বন্ধুকে দেখতেই পারতেন না।
আব্দুল রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। কিন্তু ওই সময় পদমর্যাদা এবং অতীত পরিচয়ই ছিল সবকিছু। তাই খুব দ্রুতই আব্দুল প্রসঙ্গে সবাই রাণীর বিপক্ষে চলে যায়।
আর এ কারণেই রাণীর মৃত্যুর পর ব্রিটেনে আব্দুলের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে রাণীর কাছ থেকে পাঠানো কয়েকশ’ চিঠির সবগুলোই নষ্ট করে ফেলেন ক্ষমতায় বসা বার্টি। আব্দুলকে ভারতে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়।
বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে অবশ্য রাণীর মুনশিকে রাণীর কফিনের সঙ্গে কিছু একান্ত সময় কাটানোর অনুমতি দেয়া হয়েছিল। সেই সময়টুকু কাটানোর পরই ভারত পাঠিয়ে দেয়া হয় তাকে।
আগ্রায় আব্দুল করিম ফিরে আসেন ধনাঢ্য সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে। রাণীর উপহার দেয়া জমিতেই বসবাস শুরু করেন। তবে ভারতে ফিরেই স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে তার। আট বছর রোগে ভুগে ৪৬ বছর বয়সে মারা যান আব্দুল। জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি কাটিয়েছিলেন রাণী ভিক্টোরিয়ার একটি ভাস্কর্যের পাশে বসে আর তাজমহলের পেছনে সূর্যাস্ত দেখে।
তবে সেদিন চিঠিগুলো নষ্ট করলেও হিন্দিতে লেখা রাণীর ১৩ খণ্ডের জার্নাল নষ্ট করার কথা ভাবেনি কেউ। উইন্ডসর ক্যাসলের আর্কাইভে গচ্ছিত ছিল সেগুলো। ভারতীয় লেখক শ্রাবণী বসু প্রথম খোঁজ পান সেগুলোর।
খোঁজখবর করে শ্রাবণী বসু আব্দুলের আত্মীয়দের কাছ থেকে ট্রাংকভর্তি আব্দুলের নিজের লেখা জার্নালও আবিষ্কার করেন। এরপর এ নিয়ে একটি বই লেখেন তিনি। সেখান থেকেই প্রকাশ পায় আব্দুল করিম আর রাণী ভিক্টোরিয়ার বন্ধুত্বের কাহিনী। আর এবার এই কাহিনী অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্রও তৈরি হতে যাচ্ছে, যার নাম ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আব্দুল।