একজন গ্রন্থকীট তিনি। দুষ্প্রাপ্য পুরাতন বইয়ের রক্ত মাংস তিনি উদ্ধার করেন। পুরনো বই পত্র-পত্রিকা ও পুস্তিকার প্রতি তার প্রচণ্ড আগ্রহ। অষ্টাদশ শতকের কাঠের টাইপে ছাপা বই থেকে শুরু করে শতাব্দী প্রাচীন পত্রিকা তার নখদর্পনে।
শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের ইতিহাস তিনি অনর্গল গল্পচ্ছলে বলে যান। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এমন সুহৃদ সচরাচর চোখে পড়ে না। নীরব সাধক তিনি। আজীবন অধ্যাপনা করেছেন। কিছুকাল সাংবাদিকতা। আর অল্প বিস্তর গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন। নিয়মিত লেখেন না কেন? হাসতে হাসতে সত্তর উর্ধ্ব এই ব্যক্তি মিষ্টি করে বললেন, ভাইরে আমার ভাষা নাই। ভালোবাসা নাই। আবেগ নাই। লিখতে পারি না।
আপনার স্মৃতিকথা লেখা খুব জরুরি। আপনি সময়ের সন্তান। শিল্পসাহিত্যের ঘোড়সওয়ার। লিখে ফেলুন।
লিখতে পারি না।
অকপট স্বীকারোক্তি তার। নিরাভরণ ব্যক্তি তিনি। নিজের তৈরি খাঁচায় প্রকৃত ‘গর্তজীবী’ বলা যায়।
তিনি ভূঁইয়া ইকবাল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন কর্মজীবনে। দীর্ঘকাল চট্টগ্রামে অবস্থান। স্বেচ্ছায় আত্মমগ্ন থেকেছেন। এখন ঢাকায় অবসর জীবন যাপন করছেন। থাকেন নিরিবিলি। বইয়ের মধ্যে আকণ্ঠ ডুবে থাকেন।
করোনা সংকটের এই বন্দিদশায় ভূঁইয়া ইকবালের সঙ্গে টেলিফোন আড্ডা জমে ওঠে। কথা বলতে বলতে আমরা শতাব্দী প্রাচীন আত্মীয় হয়ে যাই। গত ষাট বছরের স্মৃতি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। আর আমি সেই টেলিফোন আড্ডায় ভূঁইয়া ইকবালের চোখ দিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের দেখতে থাকি। ঢাকা শহরের বিদ্ব্যৎসমাজ পত্রিকা অফিস ও তৎকালীন বিখ্যাত ব্যক্তিদের সচিত্র গল্প তিনি অনর্গল বলে যান। তিনি তথ্যের ভাণ্ডার। আড্ডায় যে প্রসঙ্গই আসে তিনি তার সঙ্গে কোনো গল্প জুড়ে দেন প্রাসঙ্গিকভাবে।
আলী ইমাম ভাইয়ের ডাক নাম হেলাল। ভূঁইয়া ইকবাল তার ছোটবেলার বন্ধু। আলী ইমামকে নিয়ে জসীম উদদীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। প্রসঙ্গক্রমে ভূঁইয়া ইকবাল বললেন, জসীম উদদীনের পেছনে বাঁশের সাঁকো দিয়ে মেঠো পথ দিয়ে পলাশবাড়ি যাওয়া হতো। জসীম উদদীন তার জীবনীতে বা কোথাও ঠিকানা দিলে লিখতেন,
ঢাকার পার্শ্ববর্তী গ্রামে, পলাশবাড়ি।
টেলিফোনে তিনি আরও বললেন,
আমরা তখন ‘পূর্বলেখ’ পত্রিকা বের করব। প্রচ্ছদ আঁকানোর জন্য গেলাম শিল্পী জয়নুল আবেদীনের কাছে। তার বাসায় তিনি নিজের রুমে মুখোমুখি বসে আছেন কবি জসীম উদদীন। সেদিন রোজার দিন। কিন্তু দুজনের সামনে চা আর চানাচুর। সংস্কারচ্ছন্ন মনে ব্যাপারটা কেমন যেন ঠেকল। তারপর শিল্পীকে বললাম আমাদের আবদার। শিল্পী জয়নুল আবেদীন খসখস করে কয়েকটা নকশী পিঠা এঁকে ফেললেন। কোনো কাজে সেই মুহূর্তে কাইয়ুম চৌধুরী তার রুমে প্রবেশ করেছেন।
জয়নুল আবেদীন ছবিগুলো কাইয়ুম চৌধুরীকে দিয়ে বললেন, আমার হাতের লেখা তো সুন্দর না। তুমি পত্রিকার নামটা লিখে দাও। আর পিঠার ছবিগুলো সাজিয়ে দাও।
কাইয়ুম চৌধুরী একটা কাগজে দ্রুত আঠা মেরে সাঁটিয়ে ‘পূর্বলেখ’ নামটা লিখে দিলেন। সেটিই পূর্বলেখ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ।
ভূঁইয়া ইকবাল টেলিফোনের অপর প্রান্তে হেসে বললেন, আমীরুল শোনেন, শিশুসাহিত্যের আলোছায়া পড়ছি মন দিয়ে। একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে। ভুলত্রুটি আছে। সেগুলো গবেষকরা পরে ঠিক করে নেবে। কিছু একটা কাঠামো দাঁড়াল। এটাই বড় কথা। কেউ তো আগে লেখেনি। আর আপনি প্রাণ খুলে প্রশংসা করতে পারেন। এটা খুব বড় ব্যাপার। আপনাকে অভিনন্দন।
আমি লজ্জায় শরমে কুঁকড়ে যাই। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্য আলোচনায় প্রবেশ করি। আপনি বই সংগ্রহ করে থাকেন কিভাবে?
ভূঁইয়া ভাই হাসলেন। পঞ্চাশের শেষে বা ষাটের শুরুতে সদরঘাটে যেতাম মাঝে মধ্যে। তখন প্রচুর পুরনো বই পাওয়া যেত সদরঘাটে। একবার হলো কি আমীরুল। শোনেন পুরনো বই কিনতে কিনতে সদরঘাটে পেয়ে গেলাম শিবনাথ শাস্ত্রী সম্পাদিত ‘মুকুল’ পত্রিকার এক বছরের বাঁধাই সংখ্যাগুলো।
তখন আমি কাজি আফসার উদ্দিনের বাড়িতে খুব যাই। তিনি ‘খেলাঘর’ নামে ছোটদের মাসিক পত্রিকা বের করতেন। সেই পত্রিকা কেন্দ্র করে অনেক লেখক তৈরি হয় সে যুগে।
কাজি আফসার উদ্দিন আহমদ ‘মুকুল’ এর কথা শুনে সংকলনটি উনি সংগ্রহের জন্য উদগ্রীব হলেন। আমি ‘মুকুল’ বাঁধাই খণ্ডটি তাকে উপহার দিলাম। তিনি পরে খেলাঘরের প্রতি সংখ্যায় ‘মুকুল’ থেকে বাছাই একটা করে লেখা ছাপতেন। বলতেন ভালো লেখা হচ্ছে চিরকালের লেখা। তাই বারবার এসব লেখা পড়তে হয়। তাই এইসব ভালো পুনর্মুদ্রিত হওয়া প্রয়োজন।
ভূঁইয়া ইকবাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ শেষে কিছুকাল দৈনিক বাংলায় চাকরি করেছেন। তার পরিচিতের জগত তাই অনেক বড়। আর তিনি নিজেও খুব অনুসন্ধিৎসু। কলকাতার বিখ্যাত পুরনো বইয়ের দোকান সুবর্ণরেখার স্বত্বাধিকারী ইন্দ্রনাথ মজুমদারের সঙ্গে তার পত্র যোগাযোগ ছিল। অনেক দুষ্প্রাপ্য বই লেনদেন করেছেন। তার কাছে অমিয় চক্রবর্তী, শামসুর রাহমান প্রমুখের অনেক চিঠি সংগ্রহে আছে।
ভূঁইয়া ইকবাল নিজে চলমান এক আর্কাইভ। তার সঙ্গে টেলিফোন আড্ডায় আমাদের সময় জ্ঞান থাকে না। আমরা অনর্গল কথা বলি। স্মৃতিকাতর হই। ভূঁইয়া ইকবাল প্রসঙ্গক্রমে বললেন, আমীরুল শোনো, তুমি তো শিশুসাহিত্যের আলোছায়া লিখেছ। চমৎকার বই। একটানা পড়েই চলেছি। তুমি কি কবি সানাউল হকের ছড়া ঘরে ঘরে-বইটা পড়েছ?
আমি বললাম, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তার ছেলেবুড়োর ছড়া পড়েছি। ছড়া ঘরে ঘরে- এর নামই শুনিনি।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
তিনি বললেন, ৭২-এ বইটি ছাপা হয়। তাই ঠিকমতো মার্কেটিং হয়নি। বইটার একটা কপি আমি সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের কাছে দেখেছিলাম।
এরপর তিনি অনর্গল বলতে লাগলেন,
আমীরুল তুমি আজিজুর রহমানের ছড়ার বই দেখেছ?
বললাম, না।
আবুল হোসেন মিয়ার ছড়া?
বললাম, হ্যাঁ। তার একটি বই তাল বেতাল। পড়েছি।
তুমি আল ফারুকের গল্প পড়েছ? বাংলা একাডেমিতে কাজ করতেন। আব্দুল্লাহ আল মূতীর সহোদর।
বললাম, হ্যাঁ। উনি হাসির গল্প লিখতেন। গরু নিয়ে গড়াগড়ি তার একটা গল্পের কথা খুব মনে আছে।
আমি বললাম, বইটিতে অনেক অপূর্ণতা আছে ইকবাল ভাই। আমি পরে আরেকটি বই লিখছি। সেই বইতে বন্দে আলী মিয়া, আব্দুল্লাহ আল মূতী, গোলাম রহমান, আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দিন, সত্যেন সেন, হোসেন মীর মোশাররফ, দ্বিজেন শর্মা এদের নিয়ে লেখা থাকবে। লেখা প্রায় শেষের দিকে। যা ইচ্ছা লিখে যাচ্ছি।
না, না। লিখে যাও। লেখাটা জরুরি। সেটা পারি না বলেই তো কিছু হলো না।
কী যে বলেন ইকবাল ভাই।
টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে তখন ভূঁইয়া ইকবাল বললেন,
আমীরুল তুমি প্রজেশ কুমার রায়ের কথা শুনেছ?
শুনেছি।
তাকে নিয়েও লিখতে পারো।
তার তো কোনো বই নাই। কোথা থেকে লেখাগুলো পাব?
পুরনো পত্র পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
কঠিন কাজ।
আমি আরও বললাম,
অনেকে বাদ আছে। হয়তো টুকটাকভাবে লিখেছি তাদের কথা। যেমন লায়লা সামাদ।
ভূঁইয়া ইকবাল বললেন,
তাকে দেখেছি সন্ধানী প্রেসে।
হ্যাঁ এরা আজ বিস্মৃত প্রায় লেখক।
তুমি তো অনেক বড় কাজ করে ফেলেছ। আমার ছেলেবেলাকে ফিরিয়ে দিয়েছ। আমার শৈশব ফিরে এসেছে। তোমার শিশুসাহিত্যের আলোছায়া নিয়ে আমি লিখব। তবে নিন্দা নয়। প্রশংসা করব।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। শোনো, বশীর আল হেলালের লেখা পড়েছ? ছোটদের বই আনারসের হাসি।
পড়েছি।
জানো তো উনি প্রায় ৩০০ বইয়ের আলোচনা লিখেছিলেন। কিন্তু তার আলোচনায় কখনো নিন্দা থাকত না। একবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে তার সাথে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম,
খালি প্রশংসা করেন কেন?
মিষ্টি হেসে বশির আল হেলাল জবাব দিলেন,
আলোচনা লেখার সময় আমি ভালোটুকু লেখার চেষ্টা করি। একজন লেখক কত পরিশ্রম করে একটা বই লেখেন। কত অর্থ অপচয় করে বইটা প্রকাশ করে থাকেন। বই দেখলেই আমার মায়া হয়।
দুর্দান্ত কথা।
হাসতে হাসতে বললাম।
ভূঁইয়া ইকবাল বললেন
আরো আছে। শোনো,
বশির আল হেলাল বললেন,
নিন্দাটুকু থাকল মহাকালের কাছে। মহাকাল নিরুপণ করবে যদি মন্দ হয় তবে সেই বই হারিয়ে যাবে।
আমি এ প্রান্ত থেকে বললাম,
দারুণ কথা।
বশির আল হেলালের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল আমার।
ভূঁইয়া ইকবাল বললেন, তোমার মধ্যে সেই ব্যাপারটা আছে। ভালোটাই তুমি খঁজছ। খারাপের ভার মহাকালের ওপর।
টেলিফোনে খুব ছটফট করেন ভূঁইয়া ইকবাল। বারবার বলতে থাকেন, শোনো, শোনো আমীরুল। আরেকটি কথা শোনো।
তিনি শোনালেন, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর গল্প। ইবরাহীম খাঁ খুব কট্টরপন্থী ছিলেন। বাংলা গদ্যে ইংরেজি ব্যবহার পছন্দ করতেন না। এ তার এক ধরনের আভিজাত্য। একদিন গিয়েছেন গীতিকবি আজিজুর রহমানের বাসায়। মালিবাগে।
কবি আজিজুর রহমান ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠলেন।
এ্যাই জলদি করে ডিম পোচ নিয়ে আসো। স্যারকে খাওয়াবো।
ইবরাহীম খাঁ উপেক্ষার হাসি হেসে বললেন,
আমি তো ডিম পোচ খাই না।
থতমত খেয়ে গেলেন কবি আজিজুর রহমান। তখন ইবরাহীম খাঁ বললেন,
আন্ডা ভাজা নিয়ে আসো। আমি ডিম পোচ খাইতে পারি না। আন্ডা ভাজা খাই।
কী অসাধারণ দরদ বাংলাভাষার প্রতি। এই প্রেমই স্বাজাত্যবোধে উদ্বুদ্ধ করে আমাদের।
কাল রোববার যাবে
আজকাল আমরা ইবরাহীম খাঁকেও প্রায় ভুলে গেছি।
শিশুসাহিত্যের আলোছায়া বইটার মূল সীমাবদ্ধতা কী?
ভূঁইয়া ইকবাল ভাই বললেন, আরে আমীরুল আহমাদ মাযহারই তো ভূমিকায় বলে দিয়েছে- দ্রুততাই আমীরুলের শক্তি। আবার দ্রুততাই আমীরুলের দুর্বলতা। মাযহারের কথার সঙ্গে আমি একমত।
বলেই হা হা করে হাসতে লাগলেন ভূঁইয়া ইকবাল।
আবার কথা হবে। আবার আড্ডা হবে আমীরুল। ভালো থাকবা।
কিন্তু আপনার সঙ্গে আর দেখা হলো না, ইকবাল ভাই।