‘আবার তোরা মানুষ হ’ থেকে সর্বশেষ ‘গেরিলা’। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী এরকম চলচ্চিত্রগুলোতে নানা আঙ্গিকে চিত্রায়িত হয়েছে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। তবে মুক্তির সেই যুদ্ধকে কেবল একটি সময়ের বেড়াজালে আটকে রাখা যায় না, উপস্থাপন করা যায় না কেবল স্টেনগান-থ্রি নট থ্রি রাইফেলের বহু দেখানো একঘেয়ে যুদ্ধের দৃশ্যে। কারণ গণযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার বীরত্বগুলো গাঁথা হয়েছিলো প্রেম-ভালোবাসার সাহসী অনুপ্রেরণার বিনি সুতায়।
সেই সুতার টানেই স্বাধীনদেশে ২০১৩ সালেও রাজপথে নেমেছিলো জনতা, মুক্তির অপূর্ণতা পূরণে। সংগ্রামী সময়ের সেতুবন্ধন গড়তে এবং যুদ্ধ দামামায় অন্তরের মানবিকতা আর পশুত্বের দ্বন্দ্ব নিয়ে সত্য কাহিনী নির্ভর চলচ্চিত্র হিসেবে পর্দায় আসবে ভালোবাসা-যুদ্ধের ‘ভুবন মাঝি’।
সরকারি অনুদানে যুদ্ধ পটভূমিতে ভালোবাসার চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে নিজের ভাবনা তুলে ধরেছেন ছবির পরিচালক ফাখরুল আরেফিন খান। জানিয়েছেন এক যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধার বাউল হওয়ার সত্য গল্পকে পর্দায় নিয়ে আসার পেছনের কথা। প্রকাশ করেছেন এপার-ওপারে জনপ্রিয় অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়কে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ চরিত্রে ফুটিয়ে তোলার ভাবনাটি।
১৯৭০ থেকে ২০১৩, যেনো সময় নদীর সেকূল আর একূল। নদীর এই দুই কূলের যোগসূত্র স্থাপনে দরকার ছিলো একজন মাঝির। গড়াই নদীর স্রোতের সঙ্গে লড়াই করা এই মাঝিই জুড়ে দেয় সম্পর্ক একাল আর সেকালের মধ্যে।
হ্যাঁ, গড়াই নদীর জনপদ মানবপ্রেমী লালন সাইয়ের কুষ্টিয়ার গণযুদ্ধ, দুই সময়ে দুই যোদ্ধার অন্তরের ভেতরকার যুদ্ধ নিয়েই ‘ভুবন মাঝি’।
পরিচালকের কথায় এমন চলচ্চিত্র নির্মাণের ভাবনাটি এসেছিলো অনেকটাই ভুবনেশ্বরের ইচ্ছায়। বাউলদের জীবন নিয়ে ‘হকের ঘর’ নির্মাণের সময়ই এক বাউলের কথা জানতে পারেন, যিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। যে বাউলরা পশুপাখিও হত্যা করে না সেই বাউল কিভাবে যুদ্ধে যায়? কেনো ফিরে এসে অস্ত্র ধরা হাতে একতারা? এমন প্রশ্নগুলোর উত্তর তিনি দিতে চেয়েছেন ‘ভুবন মাঝি’তে।
বাস্তবতাকে চলচ্চিত্রে রূপ দিতে কুষ্টিয়ার একাধিক মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাতকার নিতে শুরু করেন গড়াই পাড়ের সন্তান ও ‘ভুবন মাঝি’র পরিচালক। মতিউর রহমান নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং একজন যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধার বাউল হওয়াকে কেন্দ্র করেই সত্য-কল্পনার মিশ্রণে তৈরি করেন চিত্রনাট্য।
এই চিত্রনাট্য লেখার শুরুটাও হয়েছিলো অদ্ভুতভাবেই। গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎই কাহিনী চিত্রটি মনে আসতে শুরু করে বলে জানান পরিচালক। ব্যস ঝটপট গাড়ি থামিয়ে ঢুকে পড়েন একটি রেস্টুরেন্টে, চেয়ে নেন টিস্যু। সেই টিস্যুতেই মাথায় আসা ধারণাসংক্ষেপ নোট আকারে লিখে ফেলেন। এরপর এই টিস্যুতে লেখা নোট থেকেই ‘ভুবন মাঝি’ চিত্রনাট্যের খসড়া তৈরি করেন তিনি।
পটভূমি ৭০’র উত্তাল সময় এবং ২০১৩’র নবজাগরণ হলেও ‘ভুবন মাঝি’কে কেবল প্রচলিত যুদ্ধ-সংগ্রামের ছবি বলতে চান না পরিচালক। বরং যুদ্ধে ভালোবাসার মানবিক দিকটি তুলে ধরে ছবিটিকে ভালোবাসার ছবি হিসেবেই দাঁড় করাতে চেয়েছেন তিনি।
চলচ্চিত্রটিতে দেখা যাবে ১৯৭১ এবং ২০১৩’র ভালোবাসা। দু’টি ভালোবাসার গল্পেই মূল চালিকা শক্তিটা হচ্ছে নারী। দুই সময়ের দুই সাধারণ মানুষকে সাহস-শক্তির অনুপ্রেরণা যোগায় দু’টি নারী চরিত্র। ছবিটিতে ৭১ দৃশ্যপটে অনুপ্রেরণা দিয়েছে ‘ফরিদা’ নামের নারী চরিত্রটি। ২০১৩ সালে এই চরিত্রের প্রতিবিম্বই দেখানো হবে ‘অ্যালেই’ নামের আরেকটি নারী চরিত্রে।
এবার আসা যাক মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে পরমব্রতকে বেছে নেয়ার প্রসঙ্গে। পরিচালক জানালেন, কেন্দ্রীয় চরিত্রে ‘নহির’ হিসেবে যার মুখ কল্পনায় আসে পরম যেনো একেবারে সেই মানুষটি। তাই কোনো বিকল্প না ভেবেই পরমের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান থাকায় শেকড় সন্ধানী পরমব্রত এই ডাকে সাড়া দেন পরম আন্তরিকতায়। একমাস কুষ্টিয়াতে শ্যুটিং হয়েছে। এই সময়টাতেই পরম-পরিচালকের মধ্যে দূরত্বটা ঘুচে যায়। নামী তারকা হয়েও পরিচালকের একেবারে আপনজনে পরিণত হন কাহানি, ভূতের ভবিষ্যৎ,প্রলয়, হেমলক সোসাইটি, চতুষ্কোণ তারকা পরমব্রত।
কবিতা লিখতে,গান শুনতে আর প্রেমিকার সঙ্গ পছন্দ করা এই ‘নহির’ চরিত্রে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং মানবিকতার বীজ বুনেছেন ফাখরুল আরেফিন। ছবিটিতে সেই বীজ থেকে প্রত্যাশিত চারাটিই যেনো বড় করেছেন অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।
মুক্তিযুদ্ধ পটভূমিতে নির্মিত হলেও ভুবন মাঝি কোনো একমুখী চলচ্চিত্র নয়। আসলে গল্পটা এগিয়ে যাবে দু’টি সময়কে নিয়ে। সাধারণ বাংলা ছবিতে একটা সময়কে প্রাধান্য দিয়ে একমুখী গল্প দেখানো হয়। সে হিসেবে এই ছবিটি কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে হাজির হবে। তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র থাকার পরও দর্শক ভুবন মাঝি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে যাবে বলে আশা করেন পরিচালক।
এমন প্রত্যাশা সামনে রেখেই চমৎকার দৃশ্যায়ন এবং বাস্তবতা নির্ভর ছবিটিকে পর্দায় হাজির করতে ব্যস্ত সময় পার করছে ‘ভুবন মাঝি’ টিম। আগামী বছরের প্রথম দিকে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন অপর্ণা ঘোষ, মামুনুর রশীদ, সুষমা সরকার, মাজনুন মিজান, কণ্ঠশিল্পী ওয়াকিলসহ অনেকে। দর্শক-শ্রোতাদের জন্য ছবিটির চারটি মৌলিক গান তৈরি করেছেন পশ্চিমবঙ্গের সংগীত শিল্পী কালিকা প্রসাদ।