বিষয়টা হয়ে গেছে কুরবানির ঈদের গরুর বাজারের মত। কারো হাতে রশি ধরা অবস্থায় বাজার থেকে গরুটা বের হলেই হলো- ‘ভাই গরুর দাম কত’সহ নানা কথা শুনতেই হবে। এখন আপনি গরুটা বিক্রি করতে গিয়েছিলেন কিনা, এটা জানাও তাদের জন্য জরুরী না। জানতে হবে দাম কত? এটাকে বলা হয় ‘বাঙালির গরু রোগ’। টেলিটকের সিমের কথা মনে আছে নিশ্চয়? ৩ থেকে ৪ দিন দিন-রাত লাইন ধরেও সিম কেনা হয়েছে। অথচ একটু ধৈর্য্য ধরলেই হতো। এটা হলো বাঙালের অধৈর্য্য রোগ।
বাঙালির বিশ্বকাপ ফুটবলের মৌসুম শুরু হয়ে পেকে একেবারে লাল হয়ে গেছে। চারদিকে সাজ সাজ রব। অথচ যাদের দেশে বিশ্বকাপ অর্থাৎ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বা নতুন রাশিয়ায় কিন্তু এখনো এত লাল হয়নি। এমনকি যারা অংশ গ্রহণ করছে বা করবে তারাও এতোটা পেকে লাল হয়নি।
একজন জিজ্ঞেস করলো ভাই কোন দল? জিজ্ঞেস করলাম, মানে কী? জানতে চাইলো আর্জেন্টিনা নাকি ব্রাজিল? বললাম, কোনটাই না। তখন উনি বললেন, বুঝছি তার মানে আপনি জার্মানি। বললাম, না। জিজ্ঞেস করলো, তাহলে? বললাম, বিশ্বকাপে ব্যক্তি পুতিনের সাপোর্টার আমি। ওনার কোন পতাকা আছে? লোকটি আমতা আমতা করে চলে গেল। সবাই যে এক তা নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির একই স্বভাব। অতি আবেগ।
সেদিন ফুটবলে আর্জেন্টাইন ভক্ত একজনকে জিজ্ঞেস করেলাম, আর্জেন্টিনা কোন মহাদেশে অবস্থিত? উত্তরে সে বলেছিল, দক্ষিণ আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত। ফুটবলে ম্যারাডোনা ছাড়া আর কারে চিনেন? উত্তরে শুধু মেসি শুনেই আর কথা বাড়াইনি। অথচ গত দু’দিন ধরে আর্জেন্টাইন পতাকা পতপত করে উড়ছে তার বাড়িতে। সে আর্জেন্টিনার একজন ভক্ত!
এছড়া এক ব্রাজিল ভক্তকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্রাজিল বিশ্বকাপে থিম সং’য়ের নাম কী ছিল? বললো, ওয়াকা ওয়াকা…। উত্তর শুনে কথা বলতে আর ইচ্ছে হলো না। কারণ সে জানেই এটা। এখন আমি যদি তারে বলি We Are One নামে ছিল, তাহলে সে করবে তর্ক। তাই বাদ দিলাম।
একটা লেখা পড়লাম, জার্মান প্রবাসী এক বাঙালি ছেলের ইরান ভ্রমণ নিয়ে। ইরান ভ্রমণের আগে সে টোটাল এক্সাইডেট ছিল, তবে খামেনীর ইরান এয়ারপোর্টেই সেই বাঙ্গালের গালে বসিয়ে দিল চড়। কিভাবে সেটা ? ট্যুরটা ছিল এডুকেশন গ্রুপ ট্যুর। সে ছাড়াও ওই গ্রুপে ছিল ইউরোপসহ আফ্রিকার দারিদ্রতম দেশ সেনেগাল ও উগান্ডার আরো দুইজন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে তেহরান বিমান বন্দর ইমিগ্রেশন আফ্রিকার গরীবসহ সবার পাসপোর্ট ছেড়ে দিলেও লাল সবুজ পাসপোর্ট ছাড়লো না। পরে দেনদরবার বুঝে শুনে ইমিগ্রেশন পাসপোর্ট ছেড়েছে, তবে অপবাদ খানা ছিল চরম অপমানজনক। কী সেটা? সেটা হলো বাঙালরা নাকি মাদক বহন করে। এটা নাকি তাদের পেশা। এজন্য ওই ইরানী কর্মকর্তা তার দেশে ঢুকতে দিতে চায় না, তারা হোক মুসলিম তাতে কী? তাই বলে এক ইরানী কর্মকর্তার বাঙালভীতির কারণে সকল ইরানীকে যেমন দোষারোপ করা যাবে না, তদ্রূপ মুসলিম জাহানের পতাকাবাহী সৌদি মুসলিম কর্তৃক আমাদের নারী গৃহকর্মী নির্যাতন কিংবা প্রবাসী ভাইদেরকে ফকির মিসকিন চোখে দেখা নিয়ে সকল সৌদিয়ানকে কম্পেয়ার করবো না। বাঙালদের বুঝানোর জন্য প্রাসঙ্গিক ছিল তাই বললাম মাত্র।
যে কথা বলছিলাম, বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে বাড়ির ছাদে, বাথরুমের ছাদে, অলি গলিতে পত পত করে উড়ছে এখন আর্জেন্টাইন, ব্রাজিল আর জার্মানি পতাকা। এটা কতটা যৌক্তিক অযৌক্তিক সেটা নিয়ে অবশ্যই তর্ক হতে পারে কিংবা তর্ক থাকতে পারে। বাট বাঙাল ওয়াজ ভেরি ডিফিকাল্ট প্রজাতি তারা ওই সব তর্কে যাবে না, কারণ জন্মগত ভাবেই এরা কুতর্কে বিশ্ব সেরা।
কেউ একজন হাইকোর্টে এসব পতাকা ক্যান্সার থেকে মুক্ত হতে রিট করেছে। আর এতেই নাকি কিছু বাঙাল ওই লোকের গুষ্ঠি উদ্ধার শুরু করেছে ফেসবুকের মাধ্যমে। লোকটা মুক্তিযোদ্ধা ছিল, এই দেশের নিজস্ব পতাকার জন্য জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছে। তবুও খাসলতে ভিন্ন বাঙালদের কিছু যায় আসে না, কারণ ওরা রেডি বাংলাদেশ পেয়েছে, জন্মের পরে শুনেছে ম্যারাডোনা আর পেলে নামের নামের লোক বিশ্বকাপ ফুটবলে গোল দিয়েছিল। ব্যস, এটাই হলো সিগনেচার, আর কিছুর দরকার নাই। পতাকা না উড়ালে হবে নাকি?
এসব লোকদের কাছে যদি জানতে চান, আর্জেন্টিনাওয়ালারা তাদের কতটা চিনে? ব্রাজিলিয়ান সাম্বারা তাদের কতটা জানে? কিংবা জার্মানিরা কতটা রেসপেক্ট করে তাদের? উত্তর পাবেন, তারা না জানুক তাতে কী? আমরা তো চিনি ওদের। যদি আরো ভিতরে যেতে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেন কাকে চিনে? উত্তরে পাবেন দুই একজন ফুটবল তারকার নাম। এর বাইরে আর কিছু না। তাদের সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি কিছুই বলতে পারবে না। গ্যারান্টি।
খোজ নেওয়াটা খুব প্রাসঙ্গিক ছিল তাই খোজ খবর নিলাম। লাতিনের দেশ আর্জেন্টিনার সাথে আমাদের কূটনৈতিক যোগাযোগ কতটা আছে? যা জানলাম তা হলো লাতিনের দেশ ব্রাজিলেই কেবল আমাদের একটা পূর্ণাঙ্গ হাইকমিশন আছে। যেখান থেকে পরিচালিত হয় আর্জেন্টিনার একটি কনসুলেট অফিস। যেই কনসুলেট অফিসের দায়িত্বে আছে মহাদেব নামের একজন। সম্ভবত কোন ইন্ডিয়ান হবে। এই হলো আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক।
ব্রাজিল থেকে অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশে দুই ধরনের খাদ্যদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে আমদানি হতো চিনি আর সয়াবিন। এবারের রমজানে আর্জেন্টিনা থেকে প্রচুর সয়াবিন আমদানি হয়েছে। এই হলো তাদের সাথে আমাদের বাণিজ্য। তার মানে মোটেও এইরকম নয় যে ক্রিকেট বিশ্বে আমাদের জয়জয়কার ভূমিকায় উচ্ছ্বাসিত আর্জেন্টাইন বা ব্রাজিলিয়ানরা তাদের অলি গলি বাথরুমে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে গর্ব করে কিংবা পতাকা থাকবে কিনা থাকবে সেটা নিয়ে মারামারি করে। অর্থনৈতিকভাবে সাবেক পর্তুগীজ উপনিবেশিক ব্রাজিলের অবস্থান ভালো হলেও ব্রিটিশদের চুষে খাওয়া আর্জেন্টিনা খুবই অনগ্রসর একটি দেশ। কাজেই বৈশ্বিক চিন্তা ভাবনায় এই দুই দেশের কোন ভূমিকা কোনভাবেই শক্তিশালী নয় শুধু মাত্র বিপ্লবের কারণে বিখ্যাত লাতিনে কিউবার গুরুত্ব যতটা বহন করে।
আকাশ সংস্কৃতির দাপটে সারাবিশ্বের যেকোন ধরনের লিজেন্ড বা বিখ্যাত বিপ্লবীর সেটা যেকোন স্তরের হোক না কেন, তাদের ফ্যান হতে সমস্যার কিছু দেখি না। তবে ফ্যান হওয়া আর পতাকা উড়িয়ে ভালোবাসা দেখানো এক নয়, ইহা স্রেফ পাগলামি প্রদর্শনের পর্যায়ের। আর কপাল ও জন্মগুণে বাঙালরা এই কাজটা করতে পারে বেশি।
অবশ্যই বলছি না, নিজ দেশের প্রতি আপনার ভালোবাসার কমতি আছে। আপনি আপনার দেশকে ভালোবাসেন। তবে সমস্যাটা হলো, আপনি বিশ্ব রাজনীতির মডেল হিসেবে একনায়ক মাহাথিরকে যতটা উঁচুতে রাখেন ঠিক তার বিপরীতে রাখেন নিজের দেশের নেতা নেত্রীদের। আপনি কথায় কথায় ম্যান্ডেলাকে যতটা এগিয়ে রাখেন ঠিক ততটা পিছিয়ে রাখেন নিজের দেশের জাতির পিতাকে। এই হলো আপনার আপনাদের দেশপ্রেম।
আমাদের এখানে যখন গৃহকর্মী নির্যাতন শুরু হয় তখন পরপর কয়েক সপ্তাহ শুধু গৃহকর্মী নির্যাতনের খবর মিডিয়ায় আসে। একইভাবে ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, চাঁদাবাজি, মাদক ইত্যাদির মত বিষয়গুলো। কথা হচ্ছে তার মানে কী? সারা বছরের অন্য সময় এই ধরনের ঘটনা কি ঘটে না? অবশ্যই ঘটে, কিন্তু প্রচারের আলো বাতাস পায় না। অর্থাৎ ট্রেন্ড ফ্যাক্টর।
আজ নিজের দেশে ভিন দেশের পতাকা উড়িয়ে আপনি বা আপনারা যা বুঝাতে চাচ্ছেন, বিষয়টা একইরকম ট্রেন্ড ফ্যাক্টর। এর মানে আপনি খাসলতি পাগল, করছেন শুধুই পাগলামি। এর ভিতরে নিজ দেশ বা অন্য দেশ, কোন জায়গার দেশপ্রেম নাই।
সম্ভব হলে নিজের হাতে টানানো ভিন দেশের পতাকা নামিয়ে ফেলুন, ভিন দেশের পতাকা উড়িয়ে আপনি যা বুঝাতে চাচ্ছেন, দুর্ভাগ্য হলো- আপনার পক্ষে বা বিপক্ষে ওই সব দেশ বা তাদের জনগণ এগুলো দেখছে না। যদি দেখতো তাহলে আপনাদের পাগল বলে আপনাদের বিরুদ্ধেই তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতো।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)