চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ভালো না বাসার শহর!

সত্যি সত্যি, এই শহরকে কি আমরা ভালোবাসি? নিজের শহর মনে করি? বিগত কয়েক মাসে, গরম আর বৃষ্টিকালে, এই শহরের সংবাদকর্মী, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী, রিকসা চালক, স্কুটার-বাস ড্রাইভার, ঘামে মাখামাখি বাসের নিত্য প্যাসেঞ্জার – যার সঙ্গেই কথা হয়েছে দেখেছি এই শহরের নানা অব্যবস্থাপনা, অসঙ্গতি নিয়ে তারা তিতিবিরক্ত। তারা বলেছেন, ‘যদি একটু সুযোগ থাকতো, তাহলে আজই এই শহরকে ‘গুডবাই’ বলে চলে যেতাম। এই শহরে মানুষ থাকে!’

প্রশ্ন, তাহলে এই শহরে আমরা যারা থাকছি, ধরা যাক বাধ্য হয়েই বসবাস করছি; জন্ম নিচ্ছি, বেড়ে উঠছি, পড়ছি, জীবন গড়ছি, চাকরি করছি, ব্যবসা করছি, প্রেম করছি-বিয়ে করছি, ঝগড়া করছি, মারামারি করছি, বাড়ি বানাচ্ছি, গাড়ি কিনছি, সন্তান জন্ম দিচ্ছি, তাদের বড় করার স্বপ্ন দেখছি এবং একদিন অনিবার্য টানে চলে যাচ্ছি – তারা কি একটুও ভালোবাসি না এই শহরটাকে? একবার মনে করি না এই শহর আমার শহর। এই শহরের সব কিছু আমার!

বাংলা গানের অসাধারণ এক গানঅলা সুমন চট্টোপাধ্যায় (পরে কবীর সুমন), তার একটি অসাধারণ গান আছে শহর কলকতাকে নিয়ে। ‘এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু/ পালাতে চাই যত সে আসে আমার পিছু পিছু।’ কলকাতা, সুমনের শহর। সে শহর তার প্রথম সব কিছু জানে। সেই শহর নিয়ে এমন গান। আমাদের এই শহর ঢাকা, বয়স কম নয়, কলকাতার সিনিয়র না হলেও কাছাকাছি। অনেক ইতিহাস আর ঐতিহ্যের এই শহর নিয়ে অমন একটা গান কি আজোও লেখা হয়েছে? কেউ কি একবারও বলেছি এই শহর আমার, আমাদের। এই শহরকে ভালোবাসা, ঘৃণা করার অধিকার আমাদের আছে!

প্রশ্ন হচ্ছে, যে শহর আমাকে বেঁচে থাকার এক ধরনের প্রণোদনা দেয়, জীবিকার সংস্থান করে দেয়, সেই শহর ছেড়ে পালাতে চাই কেনো আমরা? উত্তরটা সোজা। ১৫ মিনিটের পথ পারি দিতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর শহরের সড়কজুড়ে লেগে থাকে সময়খেকো, জীবনখেকো ট্রাফিক জ্যাম। গণমাধ্যমে পথের এ অব্যবস্থা, মানুষের ভোগান্তির কথা উঠে আসে, তারপরও সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেয় না কর্তৃপক্ষ! বর্ষাকালে এদেশে, এশহরে বৃষ্টি হবে এটা স্বাভাবিক। তাই বলে একটু বৃষ্টিতেই ডুবে যাবে শহরের প্রধান সড়ক? এবার বিশ্বময় বৃষ্টি আর বন্যার দাপট একটু প্রবল দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতাধর দেশ আমেরিকার ট্যাক্সাস, হিউস্টন ডুবেছে প্লাবনের পানিতে। বন্যায় ভেসে গেছে ভারতের অনেক রাজ্য। দুদিন ধরে ডুবে আছে দেশটির বানিজ্যিক নগরী মুম্বাই। বন্যা হয়েছে চীনে। আর এবছর আগাম বন্যায় ভেসে গিয়েছিলো আমাদের হাওর অঞ্চল। এরপর বন্যা নেমে আসে উত্তরের জেলাগুলোতে। সেই ধকল এখনো পোহাচ্ছে বানভাসি মানুষ। প্রাকৃতিক এমন দুর্যোগ নেমে আসতেই পারে। তবে ক্ষয়-ক্ষতি কমানোর জন্য সার্বিক প্রস্তুতি থাকাটা জরুরি। সেই প্রস্তুতি কি আমাদের কোনো কালেই ছিলো? থাকলে বার বার বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেলো কেনো ঢাকা শহর? কে জবাব দেবে? ঢাকা শহরে উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে রয়েছে দুটি সিটি করপোরেশন। সেখানে দুজন নির্বাচিত মেয়র রয়েছেন। দফায় দফায় নানা প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছেন। তবে, উত্তরের মেয়র আনিসুল হক (তিনি এখন লন্ডনে, রোগশয্যায়, তার আশু রোগমুক্তি চাইছি) পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলেছিলেন, তার হাতে আলাদিনের চেরাগ নেই যা দিয়ে রাতারাতি ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করে দিতে পারবেন!

কথা সত্য, তার চেয়েও আরো সত্য ঢাকা একটা শহর। এখানে সিটি করপোরেশ আছে, আছে অনেক সেবা সংস্থা; তবে প্রায় দু’কোটি মানুষের এই শহরে কোনো পরিবহন ব্যবস্থাপনা নেই! যে-যার মতো করে রুট করে নিয়ে চালাচ্ছে বাস, ট্যাক্সি, স্কুটার, হিউম্যান হলার, লেগুনা আরো কত ধরনের যানবাহন। একটা গরীব দেশে, গরীব মানুষের শহরে সরকারের ব্যবস্থাপনায় থাকবে না পরিবহন?

কোথায়, কোন দানবের হাতে যেনো জিম্মি হয়ে আছে পুরো দেশের পরিবহন খাত, কেউ জানে না, কেউ কি জানে? এতোসব অসঙ্গতির সঙ্গে এই শহরে আছে বিরামহীন শব্দ-যন্ত্রণা। সম্প্রতি উচ্চ আদালত একটা হুকুম দিয়েছেন হাইড্রলিক হর্নের বিরুদ্ধে, প্রয়োজনে ওইসব হর্ন ব্যবহারকারী গাড়ি জব্দেরও নির্দেশ এসেছে। এখন কেবল দেখার পালা এটা কতটা কার্যকর করতে পারে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী! শহর হলে সেখানে মানুষ থাকবে; মানুষের জন্য প্রার্থনার জায়গা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে, কোথায় কোথায় তা গড়া হবে; সেখানে মাইক কতো শব্দ করে বাজবে এটা দেখার জন্য নিশ্চয়ই একটা কর্তৃপক্ষ থাকা উচিত? না হলে হর্ন আর মাইকের শব্দে কর্নের দফারফা হতে বাধ্য। শব্দ যন্ত্রণার সঙ্গে এ শহরের বায়ু দুষণের বিষয়টিও মারাত্মক। বৃষ্টির দিনগুলো বাদে অহর্নিশি শহর ডুবে থাকে ধূলার সমুদ্রে। সমস্যা আরো আছে। মাদক-ছিনতাইকারীর ছোবল আছে শহরের কোনায় কোনায়। আর ঈদ এলে বেড়ে যায় ‘মলমপার্টি’র দৌরাত্ম্য। দেখা গেলো এবার মলম পার্টির খপ্পরে পড়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে অনেককে যার মধ্যে পুলিশ সদস্যও আছেন। আর এরই মধ্যে প্রাণ গেছে অনেকের। তো এমন শহরকে কি ভালোবাসা যায়?

যায় না তো? তাহলে জিজ্ঞাসা, নদীঘেরা এই শহরের এমন দশা করেছে কারা? বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু আর ইছামতি নদীকে হত্যা করেছে কারা? একটা শহর থেকে আমরা সব নেবো অথচ তার কথা ভাববো না, তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করবো না, এটা কেমন কথা? আমি কেবল প্রেম চাইবো, দেবো না এক বিন্দু, এটা হতে পারে? আর যতই চাই, যতই ঘৃণা করি, এই শহর থেকে পালিয়ে যাবো কোথায়; কেউ কি আমাকে, আমাদের নেবে?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)