পিংপং আর আমার এই প্রথম ভ্যালেন্টাইন’স ডে। পিংপং মানে পিংকি। আমি পিংপং বলে ডাকি। বন্ধু হয়েছি মাস ছয়েক আগে। ফেসবুকে। পরে face টু face, আর face থেকে ব্যাপারটা গড়িয়ে বুকে। শুধু Facebook-এ আর থাকেনি বিষয়টা। বন্ধুত্ব এখন প্রেমের দিকে যাচ্ছে। মানে দুধ জ্বাল হচ্ছে। হাফ ওয়ে মার্ক। ১০০ ডিগ্রিতে ফুটেনি এখনো। কিন্তু আমার মাথাটা ১০০ ডিগ্রি ফুটে আছে। তা আবার এই ভালবাসা দিবসে।
ধানমন্ডি ৪ নম্বরে আমাকে দেখে রাগ অভিমান মেশানো মুখ বাঁকায় পিংকি। আমার প্রিয় ড্যাভিডফ কুল ওয়াটার পারফিউমটা ধরিয়ে দেয় হাতে।
বললাম, ‘থ্যাঙ্কু সিস্টার।’
চমকে বলে, ‘হো-য়া-ট? সিস্টার? কার সিস্টার?’
আমি: ক্লিনিকের।
পিংকি: মানে?
আমি: এমনভাবে তো ক্লিনিকের সিস্টার পেশেন্টকে ওষুধ দেয়।
পিংকি: পেশেন্টই তো। এমন করে কথা বলছো কেন? মুখটা করে রাখসো চিকেন ব্রোস্টের মত। আজকে কেউ এইরকম ছ্যাড়াব্যাড়া ভাবে আসে? তোমার আরমানির পার্পল শার্টটা কই?
আমি: লন্ড্রিতে। যেটা কাছে পেয়েছি সেটাই পরেছি। ওয়েট, পেশেন্ট-ই যখন, ওষুধটা খেয়ে নেই।
পারফিউম স্প্রে করি টপ টু বটম। পিংকির বিউটি বোন দুটোয়-ও ছ্যাত ছ্যাত করে মারি। হালকা পিংক কামিজ আর নাকফুলে দারুণ লাগছে পিংকিকে। খুশিতে রিকশা ডেকে উঠে বলে, ‘ওঠো।’ কথা ছিল আজ আমরা রিকশায় ঘুরব। আর অবশেষে পুরোনো সেই ভিয়েতনামি রেস্তোরাঁয় খাব। বাঙালির উৎসবের যেই মান্ধাতা ফর্মুলা।
ওঠার সময় গজর গজর করি, ‘শা-লা-র প্রে-ম!’ চমকে বলে পিংকি, ‘কিছু বললে?’
আমি: কই না তো?
পিংকি: শালা টালা কিছু শুনলামI guess?
আমি: ট্রাফিক জ্যামকে বললাম। অই চালা! শা-লা!
আমার ‘চালা’য় রিকশা চলে। পিংকি আড় চোখ তুলে তাকায়। সামথিং রঙ–এর গন্ধ খোঁজে। এবার শালা-টা শোনেনি। তাকিয়েই ফিক করে হেসে দেয়। বলে, ‘এই দ্যাখো, পাশের কাপলটাকে দ্যাখো। Made for each other!’ তাকিয়ে দেখি দুটো বেঢপ সাইজের ছেলেমেয়ে রিকশায় বসে যার যার মোবাইল ফোনের টাচস্ক্রিনে আঙুল ঘষছে। কারো দিকে কারোর খেয়াল নেই।
যেদিকেই চোখ যায় জোড়ায় জোড়ায় রঙিন হাসি সব। জ্যামে আটকা। বেশিরভাগই যার যার মোবাইল ফোন নিয়ে হাসিতে ব্যস্ত। দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে করে আবার বলি, ‘শা-লা-র প্রে-ম!’
‘অ্যাই!’ এবার খামচে ধরে পিংকি, ‘আমি স্পষ্ট শুনসি তুমি শালা বলেছো! কাকে বলেছো বলো?’
‘প্রেমকে বলেছি।’
‘কেন বলেছো? আজকের দিনে কেউ প্রেমকে গালি দেয়? প্রেম তোমার শালা হয়?’
‘হয়না, তোমার টোপলা ভাইটা হবে, তোমাকে বিয়ে করলে!’
কাঁদো কাঁদো গলায় পিংকি বলে, ‘এবার আমার টুপ্পুশ ভাইটাকে-ও গালি দিচ্ছো? কী হয়েছে তোমার আজকে?’
ওর কথার উত্তর দেই না। লেকচার দেওয়ার ভঙ্গিতে বলি, ‘শোনো পিংকি। মন দিয়ে শোনো। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখের কী জানো?
পিংকি: কী?
আমি: সিঙ্গেল থাকা। একা থাকা। সাথে কোন গেটিস না রাখা।
পিংকি: হো-য়া-ট? গেটিস? আমাকে বলছো? অ্যারেঞ্জ করে ডেকে এনে? ইটস টু মাচ! জাস্ট ওয়েট, ওয়েট!
ফেসবুকে যায় ও। আর আমার রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দেখে ভ্যা-অ্যা-অ্যা করে কেঁদে ফেলে। একটু তটস্থ হই। কেঁদে কেঁদেই বলে, ‘আমাকে তিনদিন আগেই সামারা বলেছিলো। আমি পাত্তা দেই নাই। এখন দেখি ঠিকই বলেছে। তুমি In a complicated relationship? বলো, আর ইউ ইন আ কমপ্লিকেটেড রিলেশনশিপ?’
হো হো করে হেসে দেয় রিকশাওয়ালা। কান্না ছেড়ে এবার রাগে রিকশাওয়ালার দিকে তাকায়। ‘এই, আপনি হাসছেন কেন?’
রিকশাওয়ালা শোনে না। হাসতে হাসতেই সামনে তাকিয়ে বলে, ‘হ্যাপি বালেন্টাইন বউ। তুমার সিলাই করা মাফলারটাই পরসি, নট ওরি লল!’ বলি, ‘ও বউকে উইশ করছে। ইয়ারফোন কানে। শোনো পিংপং। আমেরিকার রিসারচার বেলা ডি পলা গবেষণা করে দেখেছেন যে, সিঙ্গেল মানুষেরাই সুখী থাকে বেশি। তাদের ঝামেলা কম। তাদের পরিবার–আত্মীয়স্বজন, এসব চিন্তা মাথায় থাকে না। তারা ফ্রি লাইক বার্ডস। ওরা বড় বড় চিন্তা করতে পারে। ওরা যাকে ইচ্ছা তাকে ফ্রেন্ড বানাতে পারে, যা ইচ্ছা ভাবতে পারে, কাউকে জবাবদিহি করতে হয়না এজন্য। ভ্যালেনটাইন ফ্যালেনটাইন নিয়ে ওদের মাথা ব্যথা নেই!’
থামিয়ে দেয় পিংকি, ‘কিন্তু বেশির ভাগ ফ্যামিলি পার্টি আর গেট টুগেদারে তো এই খচ্চরদের ইনভাইট করেনা কেউ।’ মাথা নেড়ে বলি, ‘এই দামী খচ্চররা তার গুল্লিও মারে না। ওরা চায়ও না এসব সস্তা ইনভাইট। আমেরিকার ৫০ ভাগ মানুষ এখন সিঙ্গেল। কেউ কেউ সারাজীবনের জন্য। আবার কেউ বলতে পারেনা কখন কার বড়শিতে কে আটকা পড়ে। ফেসবুকের যুগ। তবে একা মানেই হচ্ছে বাতাসে ঈগলের মতো ভেসে বেড়ানো।’
হাত ছড়িয়ে দেই দুদিকে কাকতাড়ুয়ার মতো। ফোঁসফোঁস করে বাঁ হাতটা আস্তে নামিয়ে দেয় পিংকি। তাকাই। দুর্বল হয়ে পড়েছে কিছুটা। ওর নাকফুল দেখে আমিও দুর্বল হয়ে পড়ি। ওই একটা জিনিষই আমাকে দুর্বল করে। ঠোঁটটা একটু ফাঁক করে ভালবাসা দিবসে কী যেন ছোঁয়াতে চায়। আমি আসকারা দেইনা। এড়িয়ে যাই। চালাকি করে স্মোকার পিংকি। পার্স থেকে কারটিয়ার সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে। বলে, ‘ধরিয়ে দাও।’ বলি, ‘আই অ্যাম আ নন স্মোকার ইউ নো পিংপং।’ বলে, ‘জানি। শুধু ধরিয়ে দাও প্লিজ।’ আমি সিগারেট ধরিয়ে ওর হাতে দিয়ে আকাশের দিকে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ি। পিংকি আমার চুমু দেওয়া ফিলটারে চোখ মুদে গভীর টান দেয়। আস্তে করে বলি, ‘শা-লা-র প্রে-ম!’ বলেই চমকে পিংকির দিকে তাকাই। বলি, ‘থুক্কুরি শা-লী-র প্রে-ম! তোমার ভাইকে গালি দেই নাই।’
চোখ বড় করে এবার চিৎকার করে বলে, ‘মা-নে?’ মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে বলি, ‘বলছি ওয়েট। ট্রাকের হর্নের মত চিৎকার দেবে না। রিকশাটা ছাড়ি আগে।’
লেকের এ ধারের রাস্তাটা চমৎকার। নির্জন আর নির্মল। একটা উঁচু জায়গায় বসেছি। ভাপা পিঠার মতো গম্ভীর পিংকি নির্জনতা ভাঙে। বলে, ‘প্লিজ এক্সপ্লেইন ইওর শালা-শালী। আজকেই অ্যাসপার না হয় ওসপার। দিনটাও মনে থাকবে। তোমার গুর্দার একটা এক্সরেও করিয়ে রাখব!’ বলি, ‘শোন পিংপং। এক্সপ্লেইন না, স্বীকারোক্তির দিন আজ। গত ছয়মাস আমি তোমাকে মিথ্যা বলেছি, যা আমাকে তিলে তিলে পোড়াচ্ছিল।’
চমকে ওঠে পিংকি, ‘কী বললে? মিথ্যা বলেছো?’
মাথা নিচু করি, ‘শুধু মিথ্যা না, জঘন্য মিথ্যা। বলেছি যে আমার ওই এক্স গার্লফ্রেন্ড নিনার সাথে ব্রেকআপ হয়ে গেছে। আসলে হয় নাই। পুরো না শুনেই কথার মাঝখানে আবার হায়েনার ডাক দেবেনা। ওকে ছাড়তে চেয়েছি অনেক। কিন্তু ও একটা সুপার গ্লু। চামড়া ছিলবে, ছুটবে না। পাকা প্লেয়ার। গ্রুপ চ্যাটিং করে। চ্যাটিং না বলে চিটিং বলাই ভালো। চার বছরের রিলেশন, বুঝোই তো, আমিও একবার ছুটি আরেকবার আটকাই, ছুটি আর আটকাই। অথচ মন বিক্রি করে দিয়ে বসে আছি তোমাকে। তাই রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস লিখে দিয়েছিলাম কমপ্লিকেটেড। গতকাল পর্যন্ত মেজাজটা খিচকি মেরে ছিল। গতকালই নিনাকে ফেসবুক, ভাইবারসহ সবকিছুতে ব্লক করে দিয়েছি। আয় এইবার, কোনদিক দিয়ে ঢুকবি দেখি। ওর কথা যখনই মনে হচ্ছিল, শা-লা-র প্রে-ম বলে উঠেছি।’
‘আর শা-লী-র প্রে-ম বললে যে?’ চোখ মুছে বলে পিংকি, ‘ওকেই গালি দিচ্ছিলে?’
‘যখন তুমি আমার ধরানো সিগারেটে ভালবাসার চুমু দিচ্ছিলে, মনে হলো প্রেম আসলেই কত বড়। আর তখনই ওই শালীর কথা মনে পড়ে মেজাজ খিচকে গেল আবার। শালীর প্রেম বলে ফেলেছি। আই অ্যাম সরি!’
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে পিংকি, ‘ইটস অলরাইট জানটুশ। ওইটা এমন কোন খারাপ গালি না। ভেরি মাচ লজিক্যাল।’
বলি, ‘পিংপং, তুমি আজকে ড্যাভিডফ কুল ওয়াটারটা আনায় ভালোই হয়েছে। বাসায় গিয়ে ওর দেওয়া সব পারফিউম লাত্থি মেরে ড্রেনে ফেলে দিব। তোমার জন্য তেমন কিছুই আনতে পারি নাই। অনেক খুঁজে এই হাতির দাঁতের আংটি পেয়েছি। দাও, হাতটা দাও।’ পকেট থেকে আংটিটা বের করি।
আকাশ থেকে ভেঙে পড়ে পিংকি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়। অনামিকায় পরিয়ে দেই। বাচ্চা মেয়ের মত হেসে ওঠে। শার্টের কনুই দিয়ে ওর ভেজা চোখ মুছি। সুখের ভেজা গলায় বলে, ‘তোমার রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসে এখন এনগেজড লিখে দেই হানি বানি? পাসওয়ার্ডটা বলো।’ বলি, ‘ডিভোর্সড ও লিখে দিতে পারো।’ আতংকে ভ্রূ তুলে ও। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ‘ডিভোর্সড কেন? ডিভোর্সড কেন?’ বললাম, ‘নিনাকে আজ ভালোবাসার ডিভোর্স দিয়েছি না? তুমিই এখন আমার টানেলের শেষ প্রান্তের আলো!’ মনে মনে খুশি হয়ে বলে পিংকি, ‘থাক, ভালোবাসার দিনে গালাগালি করেনা সুইট পটেটো। কালকে যত ইচ্ছা ওকে দিয়ো।’
‘কারেক্ট।’ বলি আমি। ‘পটেটো বলায় খিদে লেগে গেছে। চলো, রেস্তোরাঁয় যাই। দেরি করলে ওদের স্যুপে জাল মেরেও মাশরুম পাওয়া যাবে না।’