২০১২ সাল। সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়ে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা ঝাঁকে ঝাঁকে সমুদ্রপথে বাংলাদেশে আসছিলো। এর আগে ৯০ এর দশকেও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অত্যাচারে নিজ দেশ মিয়ানমার ছাড়তে বাধ্য হওয়া লাখখানেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছিলো। কিন্তু এবার বাংলাদেশ একেবারে ‘না’ করে দিলো তাদের।
এতো রোহিঙ্গাকে স্থান দেওয়া সম্ভব ছিলো না বাংলাদেশের পক্ষে। ঘরছাড়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলে বাংলাদেশ তাই অনিচ্ছার কথা জানায়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সেসময় বাংলাদেশকে আরো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে বলেছিলো, কিন্তু অপারগ ছিলো বাংলাদেশ।
এখন সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো অভিবাসী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বিমুখ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। আন্তর্জাতিক চাপ আসছে তাদের উপরও। বিশ্বসংস্থাগুলো বলছে, এসব বিপদগ্রস্ত অভিবাসীকে যেনো তারা জায়গা দেয়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের উপর একতরফা আন্তর্জাতিক চাপ অনেকটাই কমছে। তবে সেটা বাড়তি কোনো কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়াই। মানবপাচার ইস্যুতে সারাবিশ্বই এখন বুঝতে পারছে, হাজার হাজার রোহিঙ্গার যে ভার এতোদিন শুধু বাংলাদেশ বহন করেছে; এখন সেই ভার বহনের দায় অন্যদেরও।
তবে জাতিসংঘ বা অন্যান্য সংস্থার চাওয়াগুলোকে চাপ হিসেবে নয়, বরং আবেদন হিসেবেই দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, ৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ হলো তখন যদি ভারত তার সীমান্ত বন্ধ করে দিতো তা হলে বাংলাদেশের অসহায় মানুষগুলো কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো?
‘একইভাবে মিয়ানমারের সামরিক চাপের কারণে বিপদগ্রস্ত মানুষ বা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার আহবান জানিয়েছিলো বিশ্ব সংস্থা। চেয়েছিলো সমুদ্রপথে আসা মানুষগুলোকে যেনো আমরা আবারও মৃত্যুর দিকে ঠেলে না দিই। এখনো ঠিক একইভাবে আবেদন করা হচ্ছে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার কাছে,’ এভাবেই তখনকার এবং এখনকার অবস্থা বিশ্লেষণ করছেন ড. ইমতিয়াজ।
তিনি বলেন, বিষয়টা পুরোপুরি মানবিক দিক থেকেই বিবেচেনা করা দরকার। চাপটা এখন শুধুমাত্র বাংলাদেশের উপরই না; বরং অন্যান্য দেশের উপরও বর্তাচ্ছে।
বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া বার্নিকাটও বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। শ্রম প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, মানবপাচার ইস্যুতে সারাবিশ্বের নজর পড়াটাও এক অর্থে ইতিবাচক।
বাংলাদেশের জন্য সেটা আরো জরুরি কারণ সরকারিভাবে এখনো বাংলাদেশে ২৭ হাজার রোহিঙ্গা থাকলেও অনেকে এ সংখ্যাকে পাঁচ লাখ পর্যন্ত মনে করেন।
অন্য দেশগুলোরও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া উচিত মন্তব্য করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক আমেনা মহসীন বলেন, মানুষের বিপদের মুখে কেউই দরজা বন্ধ করতে পারে না। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সমস্যাটা তৈরি হয়েছে পরে, ক্যাম্প মনিটরিংয়ের অভাবে। অনেকেই রোহিঙ্গাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে, টাকার অভাবে তারা নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়েছে। এসব দিক থেকেই মূলত: বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
‘সেসব দিক থেকে দেখতে গেলে আরো বেশি সচেতন থাকলে এই সমস্যার সমাধান টানতে পারতো বাংলাদেশ। এমনকি হয়তো এতোটা সমস্যায়ই পড়তে হতো না,’ এমন মন্তব্য করে এখন যারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবে তাদের এসব বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই অধ্যাপক।
সমস্যাতো তৈরি হয়েছে, এখন সমাধান আসবে কি করে? বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন জাতিসংঘ, ইইউয়ের মতো বিশ্বসংস্থাগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে সমস্যার সমাধানে।
‘আগে জীবন বাঁচান, পরে না হয় বিচার করবেন,’ এমন মন্তব্য করে ড. আমেনা মহসীন বলেন, ‘যে দেশেই হোক আগে আগে তাদের উদ্ধার করে ক্যাম্প মনিটরিংয়ে রাখতে হবে। সারা বিশ্ব নিশ্চয়ই এখন বুঝছে বাংলাদেশের পক্ষে তখন এতো মানুষকে জায়গা দেওয়া সম্ভব ছিলো না। কিন্তু এখন তাদের উদ্ধার করতে হবে, পরে যে দেশে পাঠানো উচিত সেখানে পাঠাতে হবে।’
ড. ইমতিয়াজ আহমেদও বললেন, বাংলাদেশের অভিবাসীদের বা রোহিঙ্গাদের নিশ্চয়ই সেসব দেশে আজীবন রেখে দেওয়ার কথা কেউ বলবেন না। তাদের আগে উদ্ধার করা হোক। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে তাদের কিভাবে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
আগামী ২৯ মে থাইল্যান্ড চলমান এই সমস্যা নিয়ে যে বৈঠক আহবান করেছে, সেখানে কোনো না কোনো সমাধান বের হয়ে আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন।