দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে ভার্চুয়াল মাধ্যমে দেড় বছর চলার পর আজ শারীরিক উপস্থিতিতে ফেরে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এদিন বিকেলে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন শোনালেন ভার্চুয়াল আদালত প্রতিষ্ঠার সাফল্য-সংগ্রামের পেছনের গল্প।
সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে ‘ডিজিটাল আর্কাইভিং এবং ই-ফাইলিং ব্যবস্থাপনার উদ্বোধন’ অনুষ্ঠানে বুধবার বিকালে প্রধান বিচারপতি বলেন: আমার এখনও খেয়াল আছে করোনাকালে ২০২০ সালের ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আমরা জজ সাহেবেরা ১০ লাখ টাকা প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে দিয়ে বললাম, আমাদের কোর্ট তো চলছে (ফাংশান করছে) না। কিন্তু সারা পৃথিবীতে কোর্ট চলছে। তখন প্রধানমন্ত্রী বললেন ভার্চুয়াল কোর্ট করেন। কিন্তু দেখা গেল করোনার প্রেক্ষাপটে মন্ত্রীসভা বৈঠক আর হচ্ছে না। তখন প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করার পরে তিনি তিনজন মন্ত্রীকে নিয়ে গণভবনে মন্ত্রীসভার মিটিং করেন আইনটির জন্য। আর মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন যেদিন আমার কাছে আসবে সেই দিন সাথে সাথে (অর্ডিন্যান্সটি) সই করে দিব। একপর্যায়ে রাষ্ট্রপতির অর্ডিন্যান্স জারির পর ভার্চুয়াল আদালতের যাত্রা শুরু হয়।’
করোনার দূর্বিষহ সময়ের বাস্তবতা তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন: তখন বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে একদিন বললেন, জেলখানা কন্ট্রোল করা সম্ভব হচ্ছে না। কিছু একটা করেন। পরবর্তীতে এক লাখ লোকের জামিন হয়েছে ভার্চুয়াল কোর্ট থেকে। তখন লজিস্টিকের এত অভাব ছিল যে, নিম্ন আদালতের জাজেরা ফ্রি অ্যাপস দিয়ে কাজ করেছে। আমি তাদেরকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিব।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের কথা স্মরণ করে প্রধান বিচারপতি বলেন: একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীকে বললাম যে, আপনি তো ভার্চুয়াল কোর্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু ভার্চুয়াল কোর্ট তো ভালোভাবে চলছে না লজিস্টিকের অভাবে। তখন প্রধানমন্ত্রী বললেন এটা তো আমাকে প্রথমেই বলা উচিত ছিল। কত টাকার প্রয়োজন বলেন? আমি বললাম আপাতত ১০ কোটি টাকা দিলে অ্যাপস-ট্যাপস এগুলা কিনবো। তখন তিনি বললেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে কি কেউ ১০ কোটি টাকা চায়? এরপর তিনি আইসিটি প্রতিমন্ত্রীকে বললেন, প্রধান বিচারপতি যা কিছু চাইবে তা তাৎক্ষণিক দিতে হবে। এরপর প্রতিমন্ত্রী সব দিয়েছেন। আমি সব কিছু চালু করতে পেরেছি। তবে (করোনার সময় কিছুদিন) কোর্ট বন্ধ থাকার চেয়ে দূর্ভাগ্যজনক আমার জীবনে বোধ হয় আর কোনো ঘটনা ঘটেনি। সুতরাং, আমি যে পরবর্তীতে কোর্ট চালু রাখতে পেরেছি সেজন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, আইসিটি উপদেষ্টা ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর কাছে চির কৃতজ্ঞ। আর আমার উত্তরসূরি যিনি (প্রধান বিচারপতি) আসবেন তাকে এটা (ডিজিটালাইজেশন) অনেক সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তিনি যদি তা করেন তবে বিচার বিভাগে একটা বিপ্লব ঘটে যাবে। আর আগামী ৫ বছরের মধ্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এমন জায়গায় যাবে যে জুডিশিয়ারিতে কোন পেন্ডিং মামলা থাকবে না।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন: আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকারকে অব্যাহত রাখতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিচার বিভাগের আধুনিকায়ন অপরিহার্য। ই-জুডিসিয়ারি প্রজেক্ট এর মাধ্যমে সারাদেশের সকল আদালতে ই-ফাইলিং ব্যবস্থা চালু করা হবে। ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে মামলা দায়ের করা হলে বিচারপ্রার্থী জনগণ ও আইনজীবীদের সাথে আদালতের প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপিত হবে এবং বিচার প্রক্রিয়ার শুরুতেই বিচারপ্রার্থী জনগণের অংশগ্রহণ বাড়বে। সুপ্রীম কোর্টে ডিজিটাল ফাইলিং বাস্তবায়নের মাধ্যমে সকল মামলা সংশ্লিষ্ট ফাইল দ্রুততার সাথে অন লাইনে দায়ের, গ্রহণ ও অনুমোদন করা যাবে। ফলে সাশ্রয় হবে আদালতের কর্মঘণ্টার। তাছাড়া বিচারপ্রার্থীর বিচারপ্রাপ্তির অধিকার অধিকতর স্বচ্ছ, দ্রুত এবং সহজলভ্য হবে।
আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেন: সুপ্রিম কোর্টের ডিজিটাইজ করার জন্য বাজেটের বাইরে প্রধানমন্ত্রী অতিরিক্ত ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। যেখান থেকে ১৫০ কোটি টাকা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ডাটা সেন্টার করা হবে। বিচার প্রার্থী মানুষের সেবার কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী এই বিশেষ বরাদ্দটা দিয়েছেন।
এই অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মোঃ আলী আকবর, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের এটুআই প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) পরিচালক (সিএ অপারেশন ও নিরাপত্তা) তারেক এম বরকতউল্লাহ, আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো: গোলাম সারওয়ার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম।