নেপালের বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির (ইউনাইটেড মার্কস-লেনিন) সভাপতি খাজা প্রসাদ শর্মা ওলি (কে পি শর্মা ওলি) নেপালের ৩৮তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। গত ২০ সেপ্টেম্বর পাস হওয়া প্রথম গণতান্ত্রিক সংবিধানের আলোকে নেপালের সংসদ সদস্যরা আজ ১১ অক্টোবর নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন।
রোববার বিকালে নেপালের স্পিকার সুবাস চন্দ্র নেমবাং নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কেপি ওলি’র নাম ঘোষণা করেন। ৫৯৭ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ১০ জন ভোটদানে বিরত থাকেন। প্রদত্ত ভোটের মধ্যে ওলি পেয়েছেন ৩৩৮ ভোট, সুশীল কৈরালা পেয়েছেন ২৪৯ ভোট। প্রধানমন্ত্রী হতে দরকার ছিল ২৯৯ ভোট, তার চেয়েও ৩৯ ভোট বেশি পেয়েছেন ওলি। নির্বাচিত হয়েই তিনি সবাইকে নিয়ে সংকট মোকাবেলায় কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
এমন এক সময়ে ওলি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন, যখন প্রায় ৭০ বছরের অপেক্ষার পর নেপালবাসী তাদের প্রথম গণতান্ত্রিক সরকারের অধীন সংবিধান পাস করেছে। কিন্তু বহুল প্রতীক্ষিত ও প্রত্যাশিত সংবিধানটি ভারতের রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (আরএসএস) সমর্থিত বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মনপুত হয়নি।
ভারতের আপত্তি উপেক্ষিত হওয়ায় সংবিধান পাস করার দিন থেকেই নেপালের ওপর অনৈতিক অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে ওলি’ই নেপালের প্রথম সরকার গড়তে যাচ্ছেন।
কেপি শর্মা ওলির সরকারের প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে ভারতের অনৈতিক অবরোধ মোকাবেলা করা। সমুদ্রবন্দর না থাকায় নেপাল পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের উপর নির্ভরশীল। আর এই নির্ভরশীলতার ফলে ভারত প্রায়শই নেপালকে জিম্মি করে। চীনের সঙ্গে যে স্থল বন্দর রয়েছে, সেটি ব্যয় সাপেক্ষ হওয়ায় বাধ্য না হলে নেপাল সে পথ এড়িয়ে চলে।
কিন্তু এখন আবারও চীন হয়ে পণ্য আমদানির দিকে ঝুঁকছে নেপাল। ভারত ও চীন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় চীনও খুব দ্রুত নেপালে পণ্য সরবরাহ করতে উন্মুখ হয়েছে, চীন সরকার ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এদিকে ভূমিকম্প পরবর্তী সহযোগিতাসহ সংকট মোকাবেলায় এগিয়ে আসায় চীন-এর প্রতি নেপালীদের সহানুভূতি ক্রমশ বাড়ছে।
অন্যদিকে ভারতের বর্তমান সরকার, বিশেষত মোদি’র ওপর নেপালীদের ক্ষোভও সমানতালে বাড়ছে। কাঠমন্ডুতে প্রতিদিনই ভারতের বর্তমান সরকার তথা মোদি বিরোধী সভা-সমাবেশ হচ্ছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী ওলি’র সঙ্গে মোদী’র সম্পর্ক কেমন হবে, তা বুঝতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
তবে আদর্শিক কারণে ওলি’র কমিউনিস্ট পার্টি ও মোদির বিজেপি বিপরীতমুখী। ওলি আজন্ম ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। অন্যদিকে মোদি গোড়া হিন্দুত্ববাদী। যদিও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি’ই প্রথম ব্যক্তি হিসাবে ওলিকে ফোন করে অভিনন্দন জানান এবং ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানান।
নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে না পারা মোদি সরকারের অন্যতম ব্যর্থতা, এ বিষয়ে মোদি’র ওপর চাপও ছিল। এ কারণেই ক্ষুব্ধ হয়ে ভারত স্থল বন্দর বন্ধ করে দেয়। শতাংশের দিক থেকে পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে বেশি হিন্দুর বাস নেপালে হলেও অধিকাংশ মানুষই ধর্মনিরপেক্ষ। এখানে সব বড় হিন্দু মন্দিরের সঙ্গে বৌদ্ধ মন্দির যেমন আছে, তেমনি সব বড় বৌদ্ধ মন্দিরে হিন্দু মন্দিরও আছে। অধিকাংশ মানুষ দুটি ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানই উদযাপন করে একসঙ্গে। হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে বিয়ের প্রথাও এখানে খুব সাধারণ বিষয়। মুসলমান ও খ্রিস্টান এখানে সংখ্যালঘু হলেও পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে।
যদিও অবরোধ আরোপ করার বিষয়টি অস্বীকার করছে ভারত। তারা বলছে তরাই এলাকায় মধেসীদের আলাদা রাজ্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ রয়েছে। কিন্তু নেপালবাসী জানে, মধেসীদের এই আন্দোলন যখন জোরালো ছিল, তখনও মালবাহী গাড়িগুলো নিরাপদে এসেছে।
তাছাড়া অভিযোগ রয়েছে, ভারত সীমান্তবর্তী নেপালের তরাই অঞ্চলে মধেসীদের আন্দোলনে ভারতের বর্তমান সরকারের ইন্ধন রয়েছে। মধেসীদের আশংকা, ৭টি রাজ্য হলে জাতীয় সংসদে (ন্যাশনাল এসেম্বলি) তাদের প্রতিনিধিত্ব খর্ব হবে। কিন্তু সংবিধানে খুব স্পষ্ট ভাষায় সব ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী ও ব্যক্তির ধর্ম-ভাষা ও সংস্কৃতির সম-অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে শুধু মধেসী নয়, কোনো আদিবাসী গোষ্ঠীরই ভয়ের কারণ নেই।
এছাড়া তাদের দাবি মেনে নিলে অন্য এলাকার আদিবাসীরাও আলাদা রাজ্য গঠনের দাবি জানাবে। অর্থনীতি ও জিডিপি’র পরিধি, জাতীয় ও গড় আয়, প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদ, প্রযুক্তি ও কারিগরি দক্ষতা ইত্যাদি অনেক দিক থেকে নেপাল বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু সংবিধানে ইতিবাচক বিষয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশকেও টেক্কা দিয়েছে।
এশিয়ায় নেপালই প্রথম দেশ, যাদের সংবিধানে সমকামী, উভয়কামী ও তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, ক্ষুদ্র আদিবাসীসহ সব জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, সব ভাষা-ধর্ম ও সংস্কৃতির সুরক্ষা, সব ধরণের বৈষম্য বিলোপ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সব নাগরিকের মর্যাদার সঙ্গে বসবাস-রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠন করার অধিকার, সমতা ও সাম্য, ন্যায় বিচার প্রাপ্তি ও প্রাথমিক চিকিৎসা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্য-আবাসন ও পরিবেশ সুরক্ষাকে অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুরক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ বিষয় উঠে এসেছে নেপালের সংবিধানে।
প্রগতির দিক থেকে উন্নত দেশের চাইতেও আধুনিকতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় মিলেছে। এছাড়া সংবিধানে ভোক্তাদের অধিকার ও দরিদ্রদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। ভারতে অনৈতিক অবরোধে বাংলাদেশও বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন ২০০ এর বেশি মালবাহী ট্রাক বাংলাবান্ধ সীমান্ত দিয়ে নেপাল আসে যা বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের অনেক পণ্য নেপালে পাওয়া যায়। এছাড়া ২০১৬ সালের মার্চ থেকে এশিয়ান হাইওয়ে চালু হবার কথা রয়েছে যা নেপাল, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত করবে।
কিন্তু ভারত যদি খেয়াল খুশিমত তাদের পথ রুদ্ধ করে, তবে সবগুলো দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নেপালের গণমাধ্যমগুলো প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত অবরোধ আরোপ করার মাধ্যমে ৮টি আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। এর মধ্যে ল্যান্ড-লকড্ দেশ (সমুদ্রবন্দরবিহীন দেশ) ট্রানজিট ও বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে ১৯৬৫ সালের ভিয়েনা কনভেনশন, যা নেপালকে পাশ্ববর্তী দেশের বন্দর ব্যবহার করে পণ্য আমদানির অধিকার দিয়েছে। ১৯৭৩ সালের জাতিসংঘের সমুদ্র বিষয়ক আইন, যা নেপালকে ভারতের সমুদ্র ও সীমানা ব্যবহার করার আইনী অধিকার দেয় এবং ভারত ও নেপাল দু’দেশই এই চুক্তি মানতে বাধ্য।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও) এর শর্তানুযায়ী ভারতের সীমানা ব্যবহার করার অধিকার রয়েছে নেপালের। ১৯৮৯ সালে চীন থেকে অস্ত্র কেনার পর ভারত প্রথম এক বছরের জন্য অবরোধ আরোপ করেছিল। সে সময়ে পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল সল্প হওয়ায় তার প্রভাব তুলনামুলক কম হয়। কিন্তু ট্রানজিট চুক্তির মাধ্যমে ভারত অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। ভারতের বর্তমান অবরোধে সেই চুক্তিও লঙ্ঘিত হচ্ছে। এছাড়া এশিয়ান হাইওয়ে চুক্তি, সাফটা চুক্তি, বিমসটেক চুক্তির শর্তও লঙ্ঘন করছে ভারত।
নেপালবাসী ঐতিহাসিকভাবেই স্বাধীনচেতা, এ অঞ্চলে নেপালই একমাত্র দেশ যারা কখনও কোনো পরাশক্তির অধীনস্ত ছিল না। ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্র হওয়ার পরও মোদির বার্তাকে উপেক্ষা করে নেপাল সংবিধান পাস করে। মূলত ভারতে কংগ্রেস সরকারই ছিল নেপালের ঐতিহাসিক বন্ধু। কিন্তু বিজেপি সরকারের সঙ্গে নেপালের প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের বনিবনা হচ্ছে না।
যার ফলে সংকট এবং এই সংকট মোকাবেলাই নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রীর প্রথম কাজ। মাত্র ২ কোটি ৮২ লক্ষ মানুষের দেশ নেপালবাসীর গড় আয় মাত্র ৭৩০ ডলার (একই সময়ে বাংলাদেশের গড় আয় ছিলো ১০৮০ ডলার)। প্রত্যাশিত গড় আয়ু, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এর মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক বাৎসরিক প্রতিবেদন ২০১৪ অনুযায়ী ১৮৬টি দেশের মধ্যে নেপালের অবস্থান নীচের দিকেই, ১৪৫তম।
পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হিমালয়ের মূল অংশের অবস্থানই শুধু নয়, উঁচু ১০টি পর্বতের মধ্যে ৮টির অবস্থানই নেপাল-এ। রাজনীতিতে ওলি সর্বজনশ্রদ্ধেয়। ১৯৬৬ সাল থেকে মার্কস-লেলিনপন্থী প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। ৭০ সালে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। ৭০ সালে প্রথমবারের মত রাজনৈতিক নেতা হিসাবে আটক হয়েছিলেন।
৭১ সালে স্থানীয় জেলা কমিটির নেতা নির্বাচিত হন এবং ৭২ সালে ঐতিহাসিক ঝাপা আন্দোলনের সাংগঠনিক কমিটির প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ফলে ১৯৭৩ থেকে ৮৭ সাল পর্যন্ত, ১৪ বছর তাকে কারাগারে থাকতে হয়। ৮৭ সালে মুক্তি পাবার পরই পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে যুক্ত হয়ে ৯০ সাল পর্যন্ত গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী এলাকায় কাটান।
৯১ সালে প্রথম ঝাপা জেলা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৯২ সালে তিনি পার্টির আন্তর্জাতিক শাখার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পান। ৯৯ সালেও একই জেলা থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি রাজতন্ত্রের অধীন ৯৪-৯৫ সালে প্রথম কমিউনিস্ট সরকারে রাষ্ট্র মন্ত্রী এবং পরবর্তী সময়ে উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রীর যৌথ দায়িত্ব পালন করেন।
গত সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৪ সালে পার্টির সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন। ওলি বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে শুধু তার দলকেই নয়, নেপাল সরকারকেও প্রতিনিধিত্ব করেন। নেপালবাসী আশাবাদী, নতুন প্রধানমন্ত্রী দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলবেন। কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বে নেপাল সবক্ষেত্রেই এগিয়ে যাবে এটাই তাদের বিশ্বাস।