ভারতের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর মতো বাংলাদেশেও চলছে প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের অপপ্রচার। এক্ষেত্রে প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক।
কয়েকদিন আগেই ভারতে ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ উপন্যাসের জন্য বুকারজয়ী অরুন্ধতী রায়কে নিয়ে ছড়িয়ে পড়া অপপ্রচারে সরগরম ছিলো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। এমন অপপ্রচার চলছে বাংলাদেশেও।
সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কামালকে নিয়ে চলছে অপপ্রচারের তীর। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে টকশোতে উপস্থিত ছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানে সুলতানা কামাল ছাড়াও আলোচক হিসেবে ছিলেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য অপু উকিল, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার ও হেফাজতে ইসলামের প্রতিনিধি মুফতি সাখাওয়াত হোসেন।
সেই টকশোতে মুফতি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে কোন ধর্মীয় স্থাপনা থাকতে পারে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে সুলতানা কামাল বলেন, আমি আপনার সঙ্গে একমত। মূর্তির মতো মসজিদও তো ধর্মীয় স্থাপনা। তাহলে তো সেটিও সেখানে থাকার কথা না।
এরপরই বিষয়টা নিয়ে শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতিবাচক অপপ্রচার। এমনকি এর রেশ ধরে হেফাজতে ইসলামের নেতারা সুলতানা কামালকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের আল্টিমেটামও দেন। তাদের বক্তব্য, সুলতানা কামালের পরিণতি নির্বাসিত সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিনের মতো হবে। না হলে তার ‘হাড্ডি-মাংস’ থাকবে না।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ক্রমাগত এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচারে কারণে শুধু কোন ব্যক্তি নয়, বরং পুরো জাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এবং নিও মিডিয়া বিশেষজ্ঞ ড. ফাহমিদুল হক।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, উত্তম বড়ুয়া তার ফেসবুক একাউন্টে কোরআন শরিফ অবমাননা করেছেন- এই কথা ছড়িয়ে ২০১২ সালে রামুর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অনেক বাড়িঘর মন্দিরে হামলা চালানো হয়। কিন্তু পরে দেখা যায় তিনি নিজে সেটা শেয়ার করেননি, বরং কেউ তার টাইমলাইনে এসে শেয়ার করে গেছে। সেই অপপ্রচারের ফলও তো অনেককেই ভোগ করতে হয়েছিলো।
“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের কোন কন্ট্রোল নাই। ৫৭ ধারা আছে। সেটার প্রয়োগও কতোটা বা সেটাও হয় শেয়ার হওয়ার পরে। তাই এই সমস্যা সমাধানে, সবচেয়ে বেশি বাড়াতে হবে মিডিয়া লিটারেসি। অর্থাৎ আমি কোনটা বিশ্বাস করবো বা কোনটা বিশ্বাস যোগ্য না, কোনটা পড়া উচিত, কোনটা নয় সেটা বুঝে নিয়ে তারপরে নিউজ শেয়ারিংয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকতে হবে সবার। তাহলে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে।”
সমস্যা সমাধানে অনলাইন ব্যবহারকারীদের অনলাইন আচরণ আরেকটু সুচিন্তিত ও যৌক্তিক হওয়া দরকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বলেন: তাহলেই এসব সমস্যা কমে আসবে। চিন্তার ভিত্তিতে নিউজ করতে হবে গণমাধ্যমগুলোকেও। কোনটি নিউজ হবে আর কোনটি হবে না সেটা বুঝতে হবে। ফেক নিউজ ছড়িয়ে প্রায়ই কাউকে না কাউকে আক্রমণের শিকার করা হচ্ছে, সেটা কখনোই গ্রহণযোগ্য বিষয় না।
সম্প্রতি ভুয়া ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অরুন্ধতী রায়ের একটি ভুয়া সাক্ষাতকারকে কেন্দ্র করে ভারতে তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কঠোর সমালোচনা চলে, ছড়ানো হয় অপবাদ।
‘৭০ লাখ ভারতীয় সেনাও কাশ্মীরের আজাদী ফোর্সকে পরাজিত করতে পারে না’, শিরোনামে পোস্টকার্ড.নিউজ নামক পাকিস্তানি একটি সাইটে প্রকাশিত সংবাদকে কেন্দ্র করে এই অপবাদ চলেছে, যে সাইটটি এর আগেও বিতর্কিত সংবাদ প্রকাশে পরিপক্বতা দেখিয়েছে।
এই সাইটের সংবাদের ওপর ভিত্তি করে বিজেপি এমপি, অভিনেতা পরশ রাওয়াল টুইট করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এবং কড়া সমালোচনা করেছেন, যা তার সমর্থকদের মধ্যে টুইটার প্রজন্মকে উস্কে দেয়ার পরিবেশ তৈরি করে। এরপর সিএনএন-আইবিএন বিতর্কে ভুপেন্দ্র চৌবে বলেছিলেন, রাওয়ালের টুইটটি পরিবেশকে আরো বেশি ঘোলাটে করে তুলেছে এবং ঘটনাকে উস্কে দিয়েছে।
মূলত এই পোস্টের উৎস ছিলো পোস্টকার্ড নামক একটি ডানপন্থী ভুয়া সাইট যা কোন গ্রহণযোগ্য সূত্র দিতে পারেনি। পাকিস্তানের একটি জাতীয়তাবাদী সাইট দ্য টাইমস অব ইসলামাবাদ গত ১৬ মে একটি গল্প প্রকাশ করে। ওই পত্রিকাটিও অরুন্ধতী রায়ের ‘৭০ লাখ ভারতীয় সেনাও কাশ্মীরের আজাদী ফোর্সকে পরাজিত করতে পারে না’ বরাত দিয়ে সংবাদটি প্রকাশ করে। ১৬ মে রেডিও পাকিস্তান একটি শিরোনাম দেয় ‘অরুন্ধতী রায় অকুণ্ঠ কাশ্মীরে ভারতীয় আগ্রাসন লজ্জাজনক’।
অরুন্ধতী রায়ের মন্তব্যের জন্য রেডিও পাকিস্তান বা টাইমস একটি সূত্রও দেয়নি। পরবর্তীতে পাকিস্তানের আরএইচ চ্যানেল তাকে উদ্ধৃত করে একই সংবাদ প্রকাশ করে, যা আসলে ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট।
ছবি: সংগৃহীত