নেপালের নতুন সংবিধান প্রণয়নকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আন্দোলন এবং সেই সাথে ভারতের সাথে বাণিজ্যে অচলাবস্থা নেপালের অর্থনীতিতে বড় ধরণের অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে। আর এই বাস্তবতায় নেপালের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে চীন।
সংবিধান রচনাকে কেন্দ্র করে ভারতের সঙ্গে অপ্রকাশিত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে নেপাল। এর জের ধরে হাইওয়েতে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে নেপালের ওপর অঘোষিত বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করে ভারত। ফলে তীব্র জ্বালানি সংকটে পড়ে লাখ লাখ নেপালি।
তবে ভারতের অবারোধের পর এই প্রথমবারের মতো নেপালে জ্বালানি সরবরাহ করতে যাচ্ছে চীন। গত শনিবার নেপালের অয়েল কর্পোরেশন ঘোষণা করেছে, চীন তাদের দেশে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন লিটার পেট্রোল সরবরাহ করবে। ১০০শ’ মতো এই পেট্রোলের ট্যাঙ্কার সীমান্ত হয়ে কাঠমুন্ডুতে পৌঁছাবে।
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় নেপালের সংবিধান পাস হওয়ার পর অনেকটা প্রকাশ্যে এর প্রতিক্রিয়া দেখায় ভারত। এরপরই নিরাপত্তার কথা বলে স্থলপথে সবধরনের বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়। এটি নেপালের ওপর ভারতের অঘোষিত বাণিজ্য অবরোধ।
ওই মাসের শেষের দিকে এক বিবৃতিতে ভারতের অসন্তোষের কথা স্বীকার করেন নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লক্ষ্মী প্রসাদ ধাকাল। তিনি বলেন, আমাদের নতুন সংবিধানে ভারত খুশি নয়। আর এই কারণেই তারা বাণিজ্য অবরোধ করেছে, কিন্তু অফিসিয়ালি তা ঘোষণা করেনি।
নেপাল সরকার ও ভারতীয় অনেক মিডিয়া এটাকে বাণিজ্য অবরোধ বললেও ভারতীয় সরকার এটা বাণিজ্য অবরোধ বলতে অস্বীকার করে। তারা বলছে, নেপালের সীমান্ত এলাকায় প্রতিবাদ বিক্ষোভের কারণে ট্রাকগুলো সীমান্ত পাড়ি দিতে পারছে না। তবে ভারতের এই ব্যাখায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি নেপাল।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবর অনুযায়ী এই ঘটনার পর কিছু প্রতিবাদকারী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কুশপুত্তলিকা বহন কাঠমান্ডুতে মিছিল করে। যেটা আগে কখনোই ভারতীয় কোনো প্রধানমন্ত্রীর বেলায় দেখা যায়নি।
নেপালের শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকা ‘হিমালিয়ান টাইমস’ জানায় নেপালে প্রতিদিন যেখানে ২৫০ ট্যাঙ্ক জ্বালানি দরকার ছিলো সেই মুহূর্তে ভারত মাত্র হাতেগোনা অল্প কয়েকটি ট্যাঙ্কার সীমান্ত অতিক্রম করতে দেয়। এই ঘটনার পর জ্বালানি সংকটের কারণে রাজধানী কাঠমন্ডু সহ পুরো নেপালে যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ জারি করা হয়। এমপি-মন্ত্রী ও সরকারি অনেক বড় বড় কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার পর্যন্ত বন্ধ করে দেন।
ভারতের অঘোষিত বাণিজ্য অবরোধ, জ্বালানি সংকট এবং নেপালের জনগণের প্রতিক্রিয়া চীনকে নেপালে প্রবেশের সুযোগ করে দেয়। আর জ্বালানি সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বন্ধ করে দিয়ে নেপালের ওপর থেকে প্রভাব হারায় ভারত।
কিন্তু সুযোগ এলেও চীন-নেপাল সীমান্তে জটিলতা রয়েছে। নেপালের উত্তর সীমান্তে চীনের সাথে ৯টি স্থল বন্দর রয়েছে। এপ্রিলের ভূমিকম্পের পরে এসব বন্দরের সবগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এসব বন্দর চালু করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তবে চলতি মাসের গোড়ার দিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, অক্টোবর মাসের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ জিলুয়াং সীমান্ত বন্দর চালু হবে। আর খুব শীঘ্রই এই বন্দর দিয়ে নেপালে জ্বালানি সরবরাহ করবে তারা। নেপালে জ্বালানি সরবরাহের কথা নিশ্চিত করেন চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুয়াভিং।
অনেক ঝক্কি-ঝামেলার পর চীন এখন নেপালে জ্বালানি সরবরাহ করতে প্রস্তুত। হুয়া বলেন, নেপাল সরকারের অনুরোধের পর বন্ধপ্রতীম প্রতিবেশী দেশে জ্বালানিসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠাতে চীন প্রস্তুত। তিনি আরেকটু যোগ করে বলেন, চীনা ও নেপাল দুইপক্ষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে।
এরই মধ্যে চীন কিছু স্থলবন্দর দিয়ে জরুরী ভিত্তিতে নেপালে মালামাল পৌঁছে দিচ্ছে, তারপর নেপাল তার মত করে সেগুলি বিভিন্ন স্থানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। তবে এগুলো প্রয়োজনের তুলনায় এখনো অনেক কম।
সোমবার চীনের একটি অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টের বরাত দিয়ে ‘চায়না পিপলস ডেইলি’ এক প্রতিবেদনে বলেছে, জ্বালানি সংকট নিয়ে চীন ও নেপালের কর্মকর্তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আর ‘হিমালিয়ান টাইমস’ জানিয়েছে, জ্বালানি সংকটের আলোচনায় দুই দেশের হাইপ্রোফাইল কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
নেপালি অয়েল কর্পোরেশনের মুখাপাত্রের রবাত দিয়ে পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন সফরের ওই দলে ছিলেন নেপালের বাণিজ্য, অর্থ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবরা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন চীনে নিযুক্ত নেপালের রাষ্ট্রদূতও। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, চীন সফরে নেপালের প্রতিনিধি দল জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় বিকল্প বের করতেই আলোচনা করেছেন। এই আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিলো জ্বালানির দামও।
নেপালের বাণিজ্যমন্ত্রী গণেশ মান পুনে জানিয়েছেন, চীন এবং নেপালি প্রতিনিধিদের সোমবারের আলোচনায় ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন লিটার পেট্রোল সরবরাহের বিষয়টি বাইরে ছিলো। কারণ এটা আগেই নেপালে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন।
তিনি বলেন, প্রতিশ্রুত জ্বালানি আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই সরবরাহ করবে চীন। আর নেপাল-চীনা প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে নিয়মিত এবং দীর্ঘ মেয়াদী জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে।
নেপালের সাথে চীনের সড়ক যোগাযোগ মেরামত ও পুনরায় চালু করতে চীন সাহায্য করছে এবং দ্রুততার সাথে কয়েকটি স্থলবন্দর পুরোপুরি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এ বন্দরগুলো পুরো মাত্রায় চালু হলে, ভারতের উপর নেপালের বানিজ্য নির্ভরতা আনুমানিক প্রায় ৪০ ভাগ কমে যাবে। আর চীনের সাথে ৯টি স্থলবন্দরই পুরো মাত্রায় চালু করতে পারলে ভারতের উপর নির্ভরতা আনুমানিক প্রায় ৭০ ভাগ কমে যাবে। ভারত-নেপালের মধ্যে আন্ত:দেশীয় বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।